কিন্তু এই হত্যা? এটা কি চিরজীবন তাঁর পিছু পিছু ঘুরবে? চিরদিনই কি অতীতের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে তাঁকে? সত্যিই কি শেষ পর্যন্ত তাঁক সবকিছু স্বীকার করতে হবে? কক্ষণো না কিছুতেই না। তাঁর অপরাধের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেওয়ার জন্যে মাত্র একটা জিনিস এখনো বেঁচে রয়েছে। সেটা হল ওই প্রতিকৃতি। হ্যাঁ, ওটাই হল শেষ সাক্ষী। ওটাকেই তিনি নষ্ট করে ফেলবেন। ওটাকে এতদিন তিনি রেখেছেনই বা কেন? একদিন ছবিটা দেখে তিনি আনন্দই পেতেন। কেমন করে ওটা দিন-দিন পালটে যাচ্ছে, বৃদ্ধ হচ্ছে দিন-দিন তাই তিনি দেখতেন। সম্প্রতি সেরকম কোনো আনন্দ আর তাঁর হয় না। ওটার কথা ভেবে ভেবে দুশ্চিন্তায় সারা রাত তিনি জেগে থাকেন। বাইরে গেলে ভয়ে তাঁর বুকটা ধড়ফড় করে–পাছে কেউ যদি তাঁর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে সেই ছবিটা দেখে ফেলে এই আশঙ্কায় সব সময় তিনি বিব্রত হয়ে থাকেন। তাঁর অনেক আনন্দের মুহূর্তগুলি এইভাবে বরবাদ হয়ে গিয়েছে। বিবেকের মতো ওটা তাঁকে চাবুক কষাচ্ছে। হ্যাঁ; ওটাই যেন তাঁর বিবেক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওটাকে তিনি ধ্বংস করে ফেলবেন।
চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন তিনি। যে ছোরা দিয়ে বেসিলকে হত্যা করেছিলেন সেই ছোরাটা তাঁর চোখ পড়ে গেল। ওটাকে তিনি অনেকবার পরিষ্কার করেছেন। এখন আর কোনো চিহ্ন নেই ওর গায়ে। চকচক করছে ছোরাটা। ওটা একদিন চিত্ৰকরকে হত্যা করেছে; এখন হত্যা করবে তাঁর ছবিকে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অতীত নিহত হবে। তারপরেই তিনি মুক্ত, স্বাধীন। এই ভয়ঙ্কর আত্মিক জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেলে প্রতিদিন যে সতর্কতার বাণী ও উচ্চারণ করছে তা চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাবে। শান্তি আসবে তাঁর জীবনে। তিনি ছোরাটাকে তুলে নিয়ে ছবিটার বুকে বসিয়ে দিলেন।
একটা আর্তনাদ শোনা গেল; সেই সঙ্গে একটা জিনিস ভেঙে পড়ার শব্দ হল, আর্তনাদটা যন্ত্রণার আর্তিতে এতটা জোরালো হয়ে উঠল যে ঘুম ভেঙে গেল চাকরদের। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে নিঃশব্দে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল তারা। নীচে পার্কের ভেতর দিয়ে দুটি ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন। সেই আর্তনাদ শুনে তাঁরাও থমকে দাঁড়ালেন তাকিয়ে দেখলেন সেই বিরাট বাড়িটার দিকে। হাঁটতে-হাঁটতে একটা পুলিশের সঙ্গে দেখা হল তাঁদের। তাকে সঙ্গে নিয়ে এলেন তাঁরা। পুলিশের লোক বারবার বেল বাজাল; কোনো উত্তর এল না ভেতর থেকে। একেবারে ছাদের কয়েকটা জানালা থেকে কিছুটা আলো বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিল। ওইটুকু ছাড়া গোটা ঘরটাই অন্ধকারে ঢাকা। কিছুক্ষণ পরে লোকটি সেখান থেকে সরে গিয়ে পাশের একটা বারান্দার ওপরে দাঁড়িয়ে বাড়িটাকে দেখতে লাগল।
দুজনের মধ্যে বয়স্ক ভদ্রলোকটি জিজ্ঞাসা করলেন, বাড়িটা কার কনস্টেবল?
মিঃ ডোরিয়েন গ্রের স্যার।
ভদ্রলোক দুটি দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন না করে পরস্পরের দিকে একবার তাকিয়ে নাসিকা কুঞ্চিত করে নিজেদের পথ ধরলেন। তাঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন স্যান হেনরি অ্যাসটনের কাকা।
বাড়ির ভেতরে যেখানে চাকররা থাকে সেখানে নীচু গলায় আলোচনা শুরু হল। বৃদ্ধা মিসেস লিফ নিজের হাত মোচড়াতে-মোচড়াতে কাঁদতে লাগলেন; ভয়ে নীল হয়ে গেল ফ্রান্সিস। কী যে ঘটল কেউ তা বুঝতে পারল না।
মিনিট পনেরো পরে সহিস আর একজন চাকরকে সঙ্গে নিয়ে সে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল। দরজায় ধাক্কা দিল তারা। ভেতর থেকে সাড়া পাওয়া গেল না কারো। তারা চিৎকার করে ডাকল। চারপাশ চুপচাপ। দরজা খোলার ব্যর্থ চেষ্টার পরে, তারা ছাদের ওপরে উঠে লাফিয়ে পড়ল বারান্দায়। গ্রিল পুরানো হওয়ার ফলে, জানালাটা সহজেই খুলে গেল।
ভেতরে ঢোকার পরে প্রথমেই নজরে পড়ল তাদের মনিবের প্রতিকৃতির দিকে। প্রথম যেদিন ছবিটিকে তারা দেখেছিল, যৌবন আর সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে সেই ছবিটি তখনো ঠিক তেমনিভাবেই ভাস্বর হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর দেখল মেঝেতে পড়ে রয়েছে একটি মৃতদেহ; পরনে তার সান্ধ্য পোশাক বুকের মধ্যে আমূল বিদ্ধ একটা ছোরা। শরীরটা তার শুকনো; গোটা গায়ে তার বার্ধক্যের কুঞ্চন; দেখলে ঘৃণা হয় মানুষের; কদাকার হাতের আঙটিটা পরীক্ষা করার আগে তারা কিছুতেই বুঝতে পারেনি ওই মৃত কদাকার মানুষটি আসলে কে?