হায়রে, গর্ব আর কামনার কী ভয়ঙ্কর একটি মূহৃর্তেই না তিনি প্রার্থনা করেছিলেন যেন তাঁর জীবনের সমস্ত ঝড়-ঝাপটা আর কামনার কলঙ্ক বুকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকুক তাঁর প্রতিকৃতি, আর চির যৌবনের স্বাস্থ্য আর সৌন্দর্য নিয়ে বেঁচে থাকবেন তিনি। তাঁর জীবনের সমস্ত ব্যর্থতার জন্যে দায়ী সেই প্রার্থনাটি। প্রতিটি পাপ তাঁর ওপরে তার কলঙ্কের ছাপ রেখ। যাক–উচিত হত সেইটাই। শাস্তির মধ্যে দিয়েই হত তাঁর শুদ্ধি। ন্যায়পরায়ণ ভগবানের কাছে মানুষের সত্যিকার প্রার্থনা হচ্ছে আমাদের অপরাধের শাস্তি দাও প্রভু। আমাদের পাপ ক্ষমা কর–এরকম কোনো প্রার্থনা ভগবানের কাছে করা উচিত নয়।
অনেকদিন আগে লর্ড হেনরি অদ্ভুতভাবে খোদাই করা একটা আরশি তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। সেটি দাঁড় করানো ছিল তাঁর টেবিলের পাশে। সেটাকে তিনি তুলে নিলেন। ঠিক এমনিভাবে আর এক বিভীষিকামযী রাত্রিতেও তিনি এটিকে তুলে নিয়েছিলেন; অশ্রুতে ভরা চোখ দিয়ে এর চকচকে মুকুরের মধ্যে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে সেদিন তিনি আঁতকে উঠেছিলেন। একজন তাঁকে খুব ভালোবাসত, সে একবার তাঁকে উদ্দেশ্য করে পাগলের ভাষায় লিখেছিল, তোমার চেহারা হাতির দাঁত আর সোনা দিয়ে গড়া; তাইতো আমার চোখে পৃথিবীর এই পরিবর্তন। সেই কথাগুলি আবার তাঁর মনে পড়ে গেল। মনে-মনে বারবার আওড়াতে লাগলেন তিনি। হঠাৎ নিজের সৌন্দর্যের ওপরে তাঁর ঘৃণা জন্মাল। মুখ বিকৃত করে সেই রুপোর আরশিটাকে সজোরে আঘাড় দিলেন মেঝের ওপরে ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে গেল আরশিটা। এই সৌন্দর্য আর যৌবনের জন্যে তিনি ভগবানের কাছে প্রার্থনা। করেছিলেন। সেই সৌন্দর্য আর যৌবনই তাঁকে ধ্বংস করে ফেলল। ওই দুটি বস্তু না থাকলে তাঁর জীবন কলঙ্কমুক্ত হতে পারত। সৌন্দর্য তাঁর কাছে মিথ্যা একটা আবরণ ছাড়া আর কিছু নয়, যৌবন কিছু নয় বিদ্রূপ ছাড়া। আসলে যৌবনটা কী? একটা সবুজ, কাঁচা সময় কিছুই নয়। যৌবনে ভাবও গভীর নয়, চিন্তাও বড়ো রুগ্ন। সেই যৌবনের পোশাক তাঁর গায়ের ওপরে কেন? ওই যৌবনই তাঁকে নষ্ট করে দিয়েছে।
অতীতের কথা চিন্তা না করাই ভালো। কোনো কিছু দিয়েই তাকে বদলানো যাবে না। নিজের কথা, ভবিষ্যতের কথাই ভাবতে হবে তাঁকে। সেলবি কবরখানার একটা বেনামী গর্তের মধ্যে ডেমন্স ভেন-এর মৃতদেহ লুকানো রয়েছে। নিজের ল্যাবরেটরিতে অ্যালেন ক্যাম্পবেল একদিন রাত্রিতে নিজের বুকে গুলি করে আত্মহত্যা করেছে, কিন্তু যে গোপন সংবাদ জানতে সে বাধ্য হয়েছিল সেটিকে বাইরে প্রকাশ করে দেয়নি। বেসিল হলওয়ার্ড-এর অন্তর্ধান নিয়ে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে তা শীঘ্রই মিলিয়ে যাবে। এখনই তা স্তিমিত হয়ে এসেছে। সেদিক থেকে তিনি নিরাপদ। তা ছাড়া, বেসিল হলওয়ার্ড-এর মৃত্যুটাও তাঁর মনের ওপরে বোঝা দাঁড়ায়নি। আসলে যে জিনিসটা তাঁকে কষ্ট দিচ্ছে সেটা হচ্ছে তাঁর আত্মার অপমৃত্যু। বেসিল যে প্রতিকৃতিটা এঁকেছিলেন সেইটিকে তাঁর জীবন নষ্ট করে দিয়েছে। তার জন্যে তিনি তাঁকে ক্ষমা করতে পারবেন না। এই প্রতিকৃতিটাই যত নষ্টের মূল। বেসিল তাঁকে সব কথা বলেছিলেন যেগুলি তিনি সহ্য করতে পারেননি। সেই কথাগুলি আজও তিনি ধৈর্যের সঙ্গে সহ্য করে চলেছেন। হত্যাটি সংগঠিত হয়েছে নিছক মুহূর্তের উত্তেজনাযা অ্যালেন। ক্যাম্পবেলের কথা যদি ধরা যায়, তাহলে নিজেকেই নিজে সে হত্যা করেছে। এ-পথটা বেছে নিয়েছে সে নিজেই। এর জন্যে তিনি দায়ী নন।
একটি নতুন জীবন! এইটিই তিনি চেয়েছিলেন। তারই জন্যে তিনি অপেক্ষা করেছেন। সেদিক থেকে প্রথম পদক্ষেপ তিনি আগেই ফেলেছেন। যাই হোক, একটি নিষ্পাপ জীবনকে তিনি কলুষিত করেননি। আর কখনো নিষ্পাপকে তিনি পাপের পথে টানবেন না। তিনি সৎ হবেন।
হেটি মার্টনের কথা ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ আর একটা কথা তাঁর মনে এল, বন্ধ ঘরের মধ্যে যে প্রতিকৃতিটা রয়েছ সেটার ওপরেও কি পরিবর্তন দেখা দিয়েছে? আগের মতো এখন নিশ্চয় সেটা অতখানি ভয়ঙ্কর দেখাবে না। তিনি যদি পবিত্র হতে পারেন তাহলে সম্ভবত ছবিটার মুখ থেকে এ যাবৎ যত কালিমা জমেছে তা ধীরে ধীরে মুছে যাবে। ব্যাপারটা নিজের চোখে একবার দেখে আসবেন তিনি।
টেবিল থেকে বাতিটা নিয়ে পা টিপে টিপে তিনি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন। দরজা খোলার সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর যৌবনোদ্দীপ্ত মুখের ওপরে একটা আনন্দের জ্যোতি ফুটে বেরোল। তাঁর ঠোঁটের চারপাশে সেই জ্যোতি মুহূর্তের জন্যে পড়ল ছডিযে। হ্যাঁ, তিনি সৎ হবেন, ভালো হবেন, যে ভীতিপ্রদ জিনিসটাকে তিনি ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন সেটা আর। তাঁর কাছে ভোল মুর্তিতে দেখা দেবে না। মনে হল বুকের ওপর থেকে একটা ভারী বোঝা যেন অনেকদিন পরে নেমে গেল।
যথারীতি ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে তিনি নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন; তারপরে প্রতিকৃতির সামনে থেকে লাল পর্দাটা দিলেন সরিয়ে। যন্ত্রণার আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি, ঘৃণায় রি-রি করে উঠল তাঁর সারা শরীর কোনো পরিবর্তন ঘটেনি প্রতিকৃতিটির–একমাত্র চোখ দুটি ছাড়া, চোখ দুটোর ভেতর থেকে একটা ধূর্ত চাহনি ফুটে বেরিয়েছে, মুখের ওপরে ছড়িয়ে পড়েছে প্রবঞ্চকের তির্যক বলিরেখা। ছবিটা আরো জঘন্য হয়েছে, আগের চেয়েও কদাকার। যে লাল ফুটকিগুলো তার হাতের ওপরে কায়েমি হয়ে বসেছিল সেগুলো আরো বেশি লাল হয়ে উঠেছে–মনে হচ্ছে নতুন কোনো রক্তপাতের স্বাক্ষর তারা। ভয়ে কাঁপতে লাগলেন তিনি। তাহলে যে ভালো কাজটা তিনি করেছেন সেটা কি নিছক দম্ভ প্রকাশ করার জন্যে? কিন্তু ঠাট্টা করে লর্ড হেনরি না বলেছিলেন–নতুন কোনো অনুভূতির আকাঙ্খায়? অথবা হৃদয়ের পরিবর্তন না হওয়া সত্ত্বেও মানুষ মাঝে মাঝে ভালো কাজ করে ফেলে। এটা কি সেই ধরনেরই কিছু একটা কাজ। কিন্তু এর পেছনে রয়েছে সব কিছুর সমষ্টি? আচ্ছা, ওই লাল ছাপটা আরো বড়ো হয়েছে কেন? ওর ওই জরাগ্রস্ত বিকৃত আঙুলগুলির ওপরে ওই লাল ছোপটা রোগের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। রঙ দিয়ে আঁকা পায়ের ওপরে রক্ত ঝরে-ঝরে পড়েছে–হাতের ওপরেও রক্তের ছিটে–অথচ ওই হাতে তার কোলো ছোরা নেই। স্বীকার করবেন? এর অর্থ কী এই যে যে-পাপ তিনি করেছেন তা নিজের মুখে স্বীকার করতে হবে? আত্মসমর্পণ করে ফাঁসিকাঠে বাডিয়ে দিতে হবে তাঁর গলাটা? হেসে ফেললেন তিনি; ওই রকম কিছু করার চিন্তাটাই তাঁর কথা বিপজ্জনক বলে মনে হল। তা ছাড়া, স্বীকার করলেই বা তাঁর কথা বিশ্বাস করবে কে? নিহত মানুষটির কোথাও কোনো চিহ্ন নেই। তার সমস্ত জিনিসপত্র নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। নীচের ঘরে সে সব জিনিস ছিল সেগুলি তিনি নিজেই পুড়িয়ে ফেলেছেন। বিশ্বের লোক বলবে তিনি একটি উন্মাদ। তা সত্ত্বেও যদি তিনি তাঁর কাহিনিটা বলতে থাকেন। লোকে তাঁকে ঘরের মধ্যে আটকে রাখবে…তবু, অপরাধ স্বীকার করে জনসাধারণের দেওয়া অপমান নিজের ঘাড়ে তুলে নেওয়াই তাঁর কর্তব্য প্রকাশ্যে প্রায়শ্চিত্ত করার প্রযোভনীয়তা রয়েছে তাঁর। স্বর্গ আর মর্ত্য দু’জায়গাতেই পাপের কথা স্বীকার করার জন্যে ভগবান মানুষকে নির্দেশ দিয়েছেন। যাই তিনি করুন না কেন, যতক্ষণ না তিনি তাঁর পাপ স্বীকার করছেন ততক্ষণ তিনি নিজেকে পরিচ্ছন্ন করতে পারবেন না। পাপ! অবহেলায় কাঁধ কোঁচকালেন তিনি। বেসিল হলওয়ার্ডের মৃত্যুটা তাঁর কাছে কিছু নয়। তিনি ভাবছিলেন হেটি মার্টনের কথা। কারণ তাঁর হৃদ্যমুকুর–যার দিকে তাকিয়ে নিজেকে বোঝার চেষ্টা করছিলেন তিনি–সেই মুকুরটা ভেজাল। দম্ভ? কৌতূহল? প্রবঞ্চনা? তাঁর তথাকথিত আত্মত্যাগের মধ্যে সত্যিকার কিছু আর কি নেই? আরো কিছু ছিল–অন্তত তাই তিনি ভেবেছিলেন। কিন্তু কে বলবে না। আর কোনো প্রবৃত্তি ছিল না। দম্ভের খাতিরেই তিনি মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়েছেন। প্রবঞ্চনা করার প্রয়োজনে তিনি ভালোমানুষের মুখোশ পরেছেন। কৌতূহলই তাঁকে আত্মত্যাগে প্ররোচিত করেছে। এতক্ষণে সব বুঝতে পারলেন তিনি।