পিয়ানো থেকে উঠে নিজের চুলগুলির ভেতর দিয়ে আঙুল বুলিয়ে নিলেন ডোরিয়েন; বললেন, হ্যাঁ, জীবনটা আমার কাছে সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে দেখা দিয়েছে। আমি সেই জীবন আর চাইলে, হ্যারি। তাছাড়া, আমাকে নিয়ে তুমি আর ওই উচ্ছ্বাস দেখিযো না। আমার সম্বন্ধে তুমি কিছুই জান না। যদি জানতে তাহলে বিষ্ণায় তুমি মুখ ঘুরিয়ে নিতে। হাসছ তুমি, হেস না।
তুমি বাজনা থামালে কেন, ডোরিয়েন? যাও, বাজাও। ওই ধোঁয়াটে আকাশের বুকে যে মধুচাঁদ উঁকি দিয়েছে তার দিকে একবার তাকিয়ে দেখা তোমার সঙ্গীতসুধা পান করার জন্যে ও অপেহষ্কা করছে তোমার গান শুরু হলেই ও পৃথিবীর কাছাকাছি নেমে আসবে। গাইবে না? তাহলে ক্লাবে চল। ক্লাবে তোমার সঙ্গে আলাপ করার জন্যে একজন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। সে হচ্ছে যুবক লর্ড পোল-বুর্নেসাইথ-এর বড়ো ছেলে। ইতিমধ্যেই সে তোমার নেকটাই পরার ঢঙটা রপ্ত করে নিয়েছে।
বিষণ্ণভাবে ডোরিয়েন বললেন, না, থাক। আজ আমি বড়ো ক্লান্ত, হারি। ক্লাবে আজ আর যাব না। প্রায় এগারোটা বাজে। আমি আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব।
আর একটু থাক। আজকের রাত্রিতে যে বাজনা তুমি বাজালে এমন সুন্দর বাজনা আর কখনো আমি শুনিনি।
ডোরিয়েন হেসে বললেন, তার কারণ, আমি ভালো হতে যাচ্ছি।
আমার কাছে তুমি পালটাতে পার না ডোরিয়েন। সব সময়েই আমরা পরস্পরের অচ্ছেদ্য বন্ধু।
তবু একবার একখানা বই পড়তে দিয়ে আমার মনকে তুমি বিষাক্ত করে তুলেছিলো তার জন্যে আমি তোমাকে মা করব না। হ্যারি প্রতিজ্ঞা কর, ওই বই তুমি আর কাউকে পড়তে দেবে না? এতে মানুষের ক্ষতি হয়।
হেনরি বললেন, বন্ধু, এবারে তুমি নীতি আওড়াতে শুরু করলো মনে হচ্ছে যে সব পাপ করে তুমি নিজে ক্লান্ত হয়ে পড়েছ সেই পাপ মানুষ যাতে না করে সেই বাণী প্রচার করার জন্যে পাদরীদের মতো তুমি শীঘ্রই রাস্তায় বেরিয়ে পড়বে। নিশ্চয় ওরকম কিছু করার মতো গাদ্যিক তুমি হবে না। তা ছাড়া লাভও নেই। তুমি আর আমি যা তা-ই এবং ভবিষ্যতেও তা-ই থাকব। আর বই পড়ে নষ্ট হওয়ার কথা যদি বল, ওটা কিছু নয়। মানুষের কাজের ওপরে আর্টের কোনো প্রভাব নেই। আর্ট একেবারে বন্ধ্যা। যে বইগুলিকে পৃথিবী জঘন্য বলে প্রচার করেছে সেগুলি পৃথিবীর লজ্জাকর ইতিহাস। যাকগে, বর্তমানে সাহিত্য নিয়ে আমরা আলোচনা করছিনে। কাল এস–এগারোটার সময় আমরা ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে যাব। আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ খাব। তারপরে আমি তোমাকে লেড ব্রাহ্মসালের বাড়িতে নিয়ে যাব। কিন্তু আমর ডাচেসের সঙ্গেও লাঞ্চ খেতে পারি। সে বলছিল আজকাল তোমার সঙ্গে তার নাকি আর দেখা হয় না? গ্ল্যাডিসকে তোমার কি আর ভালো লাগে না? জানি তার চত্বর কথা মানুষকে কষ্ট দেয়। যাই হোক, কাল বেলা এগারোটার সময় এখানে থেক।
সত্যিই কি আসতে হবে, হ্যারি?
নিশ্চয়। পার্ক এখন বড়ো মনোরম। আমার ধারণা তোমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে এত সুন্দর লিল্যাক আর কখনো ওখানে ফোটেনি।
তাই হবে। কাল এগারোটার সময় এখানে আমি আসবা শুভরাত্রি, হ্যারি।
দরজার কাছে গিয়ে তিনি একটু দাঁড়ালেন; মনে হল, আর কী যেন বলবেন। তারপরে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেলেন।
.
বিংশ পরিচ্ছেদ
বড়ো সুন্দর রাত্রি, গরম। এত গরম যে কোটটা খুলে তিনি হাতের ওপরে চাপালেন; গলায় সিল্ক স্কার্ফও উড়ালেন না। সিগারেট ফুঁকতে-ফুঁকতে যখন তিনি বাড়ির দিকে হেঁটে আসছিলেন সেই সময় দুটি যুবক সান্ধ্য পোশাক পরে তাঁর পাশ দিয়ে চলে গেল। একজন আর একডনিকে বলল, এই লোকটি ডোরিয়েন গ্রো সেই কথা কানে গেল তাঁরা কেউ তাঁকে নির্দেশ করলে, অথবা তাঁর দিকে তাকালে বা তাঁর সম্বন্ধে আলোচনা করলে তিনি যে বেশ খুশি হতেন সেকথাটা তাঁর মনে পড়ল। অন্য লোকের মুখে নিজের নাম শুলে এখন তাঁর ভালো লাগল না। এই ছোটো গ্রামটিতে তিনি প্রায়ই আসতেন। এখানে আসতে তিনি ভালোবাসতেন এই জন্যে যে এখানে তাঁকে কেউ চিনত না। তাঁকে ভালোবাসতে যে মেয়েটিকে তিনি প্রলুব্ধ করেছিলেন তাকে বলেছিলেন যে তিন দরিদ্র। মেয়েটি সে-কথা বিশ্বাস করেছিল। তিনি তাকে একবার বলছিলেন যে তিনি দুষ্ট প্রকৃতির; সেকথা শুনে মেয়েটি হাসত: বলত দুষ্ট লোকেরা চিরকালই বড় ত্রার কদাকার। কী হাসিই না সে হাসত! মনে হত থ্রাস পাখি গান করছে তুলোর পোশাক পরা আর মাথার ওপরে বড়ো টুপি চাপানো মেয়েটিকে কী সুন্দরই না দেখাত। মেয়েটি কিছুই জানত না; কিন্তু সমস্ত সম্পদই তার ছিল; সে-সব তিনি হারিয়েছেন।
বাড়িতে ফিরে দেখলেন তাঁর চাকর তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। তাকে শুতে বলে লাইব্রেরির সোফাতে গিয়ে তিনি বলেন। তারপরে লর্ড হেনরি যে-সব কথা তাঁকে বলেছিলেন সেই সব কথা নিয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন।
মানুষের কোনোদিন পরিবর্তন হয় না এটা কি সত্যি কথা? শিশুকালের কলঙ্কহীন শুচিতা আর গোলাপ-শুভ্র শৈশবের দিনগুলি ফিরে পাওয়ার জন্যে প্রাণ তাঁর আকুল হয়ে উঠল। তিনি জানতেন যে নিজেকে তিনি কলুষিত করেছেন, আবর্জনায় বোঝাই করেছেন নিজের মনকে, তাঁর কল্পনাকে করে তুলেছেন ভয়ঙ্কর। অপরের ওপরে কুৎসিত প্রভাব বিস্তার করেছেন। তিনি; আর সেজন্যে ভয়ানক আনন্দও পেয়েছেন তিনি। আর তাঁর সহচর্যে যে-ই এসেছে, সে। যত সুন্দর অথবা সম্ভবনামযই হোক না কেন, তারই জীবনে অপমানের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন। এরকম একটা জীবনকে কি সংশোধন করা যায় না? তাঁর কি কোন আশা নেই?