ডোরিয়েন বললেন, ভুলে গিয়েছি। সম্ভবত দিয়েছিলাম। কিন্তু ছবিটা সত্যিই আমার ভালো লাগেনি। আমি দুঃখিত যে ওই ছবির মডেল হয়েছিলাম আমি। ছবিটা দেখে হ্যামলেট নাটকের দুটো লাইন আমার মনে পড়ে যায়-লাইন দুটো হচ্ছে–
“দুঃখের চিত্রের মতো
হৃদয়হীন একটা মুখ।”
হ্যাঁ, আমার প্রতিকৃতিটা ওই রকমই।
লর্ড হেনরি হেসে বললেন, জীবনকে যে চিত্রকরের দৃষ্টি দিয়ে দেখে তার কাছে মস্তিষ্কটাই হচ্ছে তার হৃদয়।
তারপরে তিনি চোখ দুটি অর্ধেক বুড়িচযে ডোরিযেলের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আচ্ছা ডোরিয়েন, মানুষ সারা পৃথিবী জয় করল কি হারাল তাতে কী যায় আসে? কে যেন বলেছিল–তার নিজের আত্মা?
ডোরিয়েন এতক্ষণ ঠুং ঠুং করে পিয়ানোর সুর তুলছিলেন, প্রশ্নটা শুনে তিনি তাঁর দিকে চোখ। দুটো বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইলেন; জিজ্ঞাসা করলেন, এ- প্রশ্ন কেন?
লর্ড হেনরি বললেন, প্রশ্নটা করেছি এই ভেবে যে তুমি হয়তো এর উত্তর দিতে পারবে। এ ছাড়া আর কিছু নয়। গত সোমবার আমি পার্কের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। মার্বেল আর্চের পাশে নোংরা পোশাক পরে একদল লোক ততোধিক নোংরা একটি ধর্মযাজকের বাণী শুনছিল। যেতে-যেতে শুনলাম ধর্মযাজকটি চিৎকার করে তাঁর শ্রোতাদের ওই প্রশ্নটি করছেন।
ব্যাপারটা আমার কাছে নাটকীয় বলে মনে হল। এই ধরনের কৌতুককর ঘটনা লন্ডন শহরে হামেশাই ঘটছে। ভিড়ে রবিবার, নোংরা ম্যাকিনটস পরা কোন ক্রিশ্চান পাদরী, তাঁর। চারপাশে ছাতা মাথায় দিয়ে একদল বিবর্ণ শ্রোতা দাঁড়িয়ে। ঠিক সেই সময় পাদরীর এই ধরনের উচ্ছ্বাসভরা প্রশ্ন তীক্ষ্ণভাবে সবাইকে গিয়ে আঘাত করছে। একদিন দিয়ে। ভালোই–পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে প্রশ্নটা সত্যিই আমাদের ভাবিয়ে তোলে। সেই ভবিষ্যৎ বক্তাকে আমি বলব বলে ভেবেছিলাম যে আর্টের আত্মা রয়েছে, তাঁর নেই। কিন্তু ভয় হল, মানুষটি সম্ভবত আমার বক্তব্যের নিগুঢ় তত্ত্বটি বুঝতে পারবে না।
থাক, থাক হারি। আত্মা হচ্ছে ভয়ঙ্কর বাস্তব সত্য। একে কেনাও যায় না, বিক্রি করাও যায় না; একে নিয়ে খেলা যায় না ছিনিমিনি। একে বিষাক্ত করা যায় অথবা করা যায় নিখুঁত। আমাদের প্রত্যেকেরই আত্মা রয়েছে। আমি তা জানি।
ডোরিয়েন, এ বিষয়ে তুমি নিশ্চিত?
নিশ্চয়।
তাহলে ওটা একটা মরীচিকা ছাড়া আর কিছু নয়। যে জিনিস মানুষ একেবারে সত্যি বলে। বিশ্বাস করে তা কোনোদিনই সত্যি হতে পারে না। বিশ্বাসের মারাত্মক পরিণতি আর রোমান্সের শিক্ষা হল ওই। খুব গম্ভীর হয়ে পড়লে দেখছি। না, না, অতটা সিরিয়াস হওয়ার দরকার নেই। আমাদের যুগের কুসংস্কারদের নিয়ে তোমার কী করার রয়েছে; আমারই বা। রয়েছে কী? কিছু নেই। আয়ায় আমরা বিশ্বাস হারিয়েছি। ওসব কথা থাক। তুমি বরং কিছু বাজাও বাড়াতে বাজাতে বল, তোমার ওই যৌবনের গোপন রহস্যটা কী? তোমার চেয়ে আমি মাত্র বছর দশেকের বড়ো। আমাকে দেখ, আমি একেবারে বুড়িয়ে গিয়েছি। হয়ে গিয়েছি, ফ্যাকাশে। কিন্তু তোমার সৌন্দর্যের আগুণ এতটুকু কমেনি। আজ তোমাক যেমন সুন্দর দেখছি চিরকালই তুমি সেইরকম। পরিবর্তন তোমার হয়েছে, কিন্তু চেহারায় ন্য। তোমার। গোপন রহস্যরটা কী জানলে আমি খুশি হতাম। শারীরিক পরিশ্রম করা, সকালে ওঠা, আর সম্ভ্রান্ত হওয়া ছাড়া, যৌবন ফিরে পাওয়ার জন্যে আমি সব কিছু করতে পারি। যৌবনের মতো জিনিসু আর নেই। যৌবনের অজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করা হাস্যকর। একমাত্র তাদের কথা আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে শুনি যারা আমার চেয়ে বয়সে কম। মনে হয় তারাই আমার পথিকৃৎ। ভীবন তার নতুনতম সঞ্চযের ভাণ্ডার তাদের কাছে খুলে দিয়েছে। নীতিগতভাবেই, বৃদ্ধদের আমি প্রতিবাদ করি। গতকাল কী ঘটেছে সে সম্বন্ধে যদি তাদের মতামত চাও তাহলে তারা গম্ভীরভাবে যে মতামত দেবে তা হচ্ছে ১৮২০ সালের থেম না, বাডাও। আভা রাত্রিতে আমি সঙ্গীতে ডুবে থাকতে চাই। আজ মনে হচ্ছে তুমি যেন যুবক অ্যাপোলো; আর আমি। মার্সিয়াস, তোমার গান শুলে মাতোয়ারা। আমারও দুঃখ রয়েছে, ডোরিয়েন; এমন দুঃখ যা তুমি ভান না। বার্ধক্যের ট্র্যাজেডি এই নয় যে সে বৃদ্ধ; ট্র্যাভেডি হচ্ছে আর একজন যুবক। মাঝে মাঝে নিজের সৎ ভাষণে আমি নিজেই চমকে উঠি। আঃ, ডোরিয়েন, তুমি জীবনের সব সুরা তুমি পান করেছ। আঙুরের নির্যাসে ভরিয়ে দিয়ে তোমার আত্মা। কিছুই তোমার কাছে গোপন লেই। সবই তুম সঙ্গীতের মতো উপভোগ করেছা এত ভোগের পরেও তোমার ক্লান্তি নেই, বিকৃতি ঘটেনি চোমার চেহারায়। তুমি সেই আগের মতো অপরূপ সুন্দর।
আমি সেই আগের মানুষ আর নেই, হ্যারি।
আছ; সেই আগের মতোই অবিকল। তোমার বাকি জীবনটা কীভাবে কাটবে তাই আমি অবাক হয়ে ভাবি। আত্নত্যাগ করে এ জীবনকে তুমি নষ্ট করে দিয়ো না। তুমি একেবারে নিখুঁত ঘাড় নেড়ে আমার কথার প্রতিবাদ করে লাভ নেই। তুমি জান আমার কথাই ঠিক। তাছাড়া, প্রতারণা করো না নিজের সঙ্গে। ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরে জীবন নির্ভর করে না। জীবনটা হচ্ছে স্নায়ু আর তন্নীর ঘন সন্নিবেশ; এদের মধ্যে মানুষের চিন্তারা লুকিয়ে থাকে। কামনা বা স্বপ্নের জাল বোনে। নিজেকে তুমি নিরাপদ অথবা সবল বলে ভাবতে পার; কিন্তু আমি তোমাকে বলছি ডোরিয়েন আমাদের জীবন দাঁড়িয়ে রয়েছে ছোটো ছোটো মুহূর্তের ওপরে-ঘরের বিশেষ কোনো রঙ, সকাল বেলাকার আকাশের মোহ, বিশেষ কোনো সুগন্ধ, একটা ভুলে যাওয়া কবিতা–এরাই আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে তোমার সঙ্গে জায়গা পরিবর্তন করতে পারলে আমি খুশি হতাম ডোরিয়েল। আমাদের দুজনের বিরুদ্ধেই পৃথিবী সোচ্চার হয়ে উঠেছে–কিন্তু সে সব সময়েই তোমার জন্যে পূজার উপকরণ সাজিযে রেখেছে। আমি খুশি যে তুমি কোনোদিন কোনো মূর্তি গড়নি, কোনো ছবি আঁকনি, নিজেকে বাদ দিয়ে আর কিছুই সৃষ্টির কাজে অনর্থক সময় নষ্ট করনি তুমি। জীবনটাই হচ্ছে তোমার কাছে একটা আর্ট; তোমার দিনগুলিই তোমার সনেট।