ঘরের এক কোণে জঞ্জালের স্তূপের ওপরে একটা মৃতদেহ শোওয়ানো রয়েছে। তার দেহে মোটা শার্ট পরনে এক জোড়া নীল ট্রাইজার। তার মুখের ওপরে একটা ডোরা কাটা রুমাল। বোতলের মুখে লাগানো একটা বাতি জ্বলছে তার পাশে।
কেঁপে উঠলেন ডোরিয়েন গ্রে। মনে হল নিজের হাতে রুমালটা কিছুতেই তিনি সরাতে পারবেন না। একজন চাকরকে ডেকে তিনি বললেন, রুমালটা সরিয়ে নাও। আমি দেখতে চাই লোকটা কে?
চাকরটা রুমাল সরিয়ে নিল। তিনি দেখার জন্যে সামনে এগিয়ে এলেন। একটা আনন্দের আর্তনাদ তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এল। মৃত লোকটি ডেমস ভেন।
মৃতদেহটির দিকে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ড তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। বাড়ি ফেরার পথে তাঁর চোখ দুটি জলে ভরে উঠল। তিনি বুঝতে পারলেন এবার তিনি নিরাপদ।
.
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
গোলাপ জলে আঙুল ডোবাতে-ডোবাতে লর্ড হেনরি বললেন, তুমি ভালো হতে যাচ্ছ একথা আমাকে বলে লাভ নেই ডোরিয়েন। তুমি এমনিতে নিখাদ সোনা। অনুগ্রহ করে নিজেকে পরিবর্তন করো না।
ঘাড় নাড়লেন ডোরিয়েন, না হ্যারি। জীবনে আমি অনেক খারাপ কাজ করেছি। আর আমি করব না। গতকাল থেকেই আমি ভালো কাজ করতে শুরু করেছি।
গতকাল তুমি কোথায় ছিলে?
গ্রামে। একটা ছোটো সরাইখানা-একা।
লর্ড হেনরি হেসে বললেন, বন্ধু, গ্রামে যে-কোনো লোক ভালো থাকতে পারে। সেখানে কোনো প্রলোভন নেই। সেইডন্যই যারা শহরের বাইরে থাকে তারা অত অসভ্য। সভ্যতা অর্জন করা। সহজ ব্যাপার নয়। সভ্য হওয়ার উপায় রয়েছে দুটো: একটা হচ্ছে কৃষ্টি অর্জন করে আর একটা হচ্ছে নোংরামি করে। গ্রাম্য লোকের দুটোর মধ্যে একটা সুযোগও পায় না। তাই তাদের। জীবনের গতি রুদ্ধ।
ডোরিয়েন-এর কণ্ঠে প্রতিধ্বনি শোনা গেল, কৃষ্টি আর নোংরামি! দুটির কিছু কিছু আমি জানি। ওদের দুটি যে একসঙ্গে থাকে সেটাই আমার কাছে এখন ভয়ঙ্কর বলে মনে হয়। কারণ, এখন আমি নতুন আদর্শে বিশ্বাসী। আমি আমার পথ পরিবর্তন করার চেষ্টা করছি; করেওচ্ছি। কিছুটা।
কী ভালো কাজটা তুমি করেছ সেকথা এখনো তুমি বলনি। অথবা, একটার বেশি ভালো কাজ তুমি করেছ তাই কি তুমি বললে?
তোমাকে বলছি, হ্যারি। একথা আর কাউকে আমি বলতে পারব না। একজনকে আমি ছেড়ে দিয়েছি। আত্মম্ভরিতা বলে মনে হবে, কিন্তু আমি কী বলতে চাই তা নিশ্চয় তুমি বুঝতে পেরেছ। মেয়েটা খুবই সুন্দরী, সাইবিলের মতো অপরূপা। মনে হয়, তার লাবণ্যই আমাকে প্রথম আকর্ষণ করেছিল। সাইবিল ভেনকে তোমার মনে রয়েছে? ওঃ, কতদিন আগের কথা! অবশ্য হেটি ঠিক আমাদের সমাজের ন্য। সে হচ্ছে সরল একটি গ্রাম্য বালিকা। সত্যি সত্যিই আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম। হ্যাঁ, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সারা মে মাস থেকে প্রতি সপ্তাহেই দু’বার করে আমি সেই গ্রামে যেতাম তার সঙ্গে দেখা করার জন্যে। গতকাল একটা ছোটো বাগানে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আপেলের ফুলগুলি লুটিয়ে পড়েছিল তার চুলের ওপরে। সে হাসছিল। আজ সকালেও আমাদের দুজনের এক জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল। হঠাৎ আমি মনস্থির করে ফেললাম–না, থাক। নিষ্পাপ কুসুম আর আমি ছিড়ব না।
বাধা দিয়ে লর্ড হেনরি বললেন, আমার ধারণা, ভাবাবেগের নতুনত্বে তোমার মনে সত্যিকার আনন্দের বান ডাকছিল। যাই হোক, এই রূপকথার উপসংহার আমি টেনে দিতে পারি। সৎ উপদেশ দিয়ে তুমি তার হৃদ্যটিকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। তুমি যে আত্মশুদ্ধির পথ ধরে এটাই তার প্রথম পদক্ষেপ।
ছিঃ, ছিঃ; হ্যারি–এরকম ভয়ঙ্কর কথা বলা উচিত নয় তোমার হেটির হৃদয় ভাঙেনি। সে অবশ্য কেঁদেছিল ঠিক কথা। কিন্তু কোনো অসম্মানের বোঝা তার ঘাড়ে চাপেনি। সে তার স্বপ্নের উদ্যালে পারদিতার মতো বেঁচে থাকত পারে।
এবং অবিশ্বাসী ফ্লোরিজেলের কথা ভেবে কাঁদবো প্রিয় ডোরিয়েন, তুমি একেবারে ছেলেমানুষ। তুমি কি ভেবেছ সে আর কোনোদিন নিজের সমাজের কাউকে বিয়ে করে সুখী হবে? হয়তো কোনো রুক্ষ মেজাডি অথবা বদরাগী কোনো চাষিকে সে বিয়ে করবো তোমাকে ভালোবাসার ফলে সে তার স্বামীকে ঘৃণা করতে শুরু করবে। ফলে, সারা জীবন ধরেই কষ্ট পাবে মেয়েটা। নীতির দিক থেকে তোমার এই আত্মশুদ্ধির কোনো দাম নেই। এমন কি সূচনার দিক থেকেও এটা নগণ্য। তাছাড়া, তুমি কী করে জানলে যে সে এতক্ষণ ওফিলিয়ার মতো জলে ভাসছে না?
হারি, তোমার বাণী অসহ্য। প্রতিটি ব্যাপারেই তুমি ব্যঙ্গোক্তি কর; তারপরে উপসংহার কর করুণতম পরিণিতর কথা বলে কথাটা তোমাকে বলা উচিত হয়নি আমার। তুমি যা ইচ্ছে তাই বলতে পার; আমি জানি, আমি যা করছি তা ঠিক। যাক ওসব কথা এখন থাকা আমাকে তুমি বোঝাতে চেয়ো না যে আমার জীবনের প্রথম ভালো কাজ, স্বার্থত্যাগ তা যত নগণ্যই হোক-পাপ ছাড়া আর কিছু নয়। আমি আরো ভালো হতে চাই এবং হবও। এখন তোমার কথা বলা শহরে কী ঘটছে? অনেকদিন আমি ক্লাবে যাইনি।
এখনো লোকে হতভাগ্য বেসিলের অন্তর্ধানের কথা আলোচনা করছে।
কিছুটা মদ গ্লাসে ঢালতে ঢালতে ডোরিয়েন বললেন, ভেবেছিলেম, ওই আলোচনা করতে-করতে এতহষ্কণ হয়তো তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
প্রিয় বন্ধু, মাত্র দুটি সপ্তাহ তারা এই আলোচনা করছে আর ব্রিটিশ ভাত তিন মাসের আগে কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে ক্লান্ত হয় না। সেদিক থেকে বর্তমানে তারা কিছুটা। ভাগ্যমান। তাদের আলোচনার বিষয় অনেক। আমার বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে তারা মশগুল, তারপর অ্যালেন ক্যাম্পবেলের আত্মহত্যা। সঙ্গে সঙ্গে আবার একটি আর্টিস্টের রহস্যময় অন্তর্ধান। ব্রিটিশ ভাত এখন উদ্ধ্যস্ত হয়ে উঠেছে। স্কটল্যান্ডে ইয়ার্ড নিশ্চিত যে ধূসর রঙের আলেস্টার চাপিয়ে নভেম্বর মাসের ন’তারিখে মধ্যরাত্রিতে যে লোকটি ট্রেনে চেপে প্যারিসের দিকে যাত্রা করেছিল সে লোকটি হতভাগ্য বেসিল ছাড়া আর কেউ নয়। ফরাসি পুলিশ ঘোষণা করেছে যে বেসিল কখনো প্যারিসে নামেননি। আমার ধারণা আর পনেরো দিনের মধ্যে আমরা শুনতে পাব যে বেসিলকে স্যান ফ্রান্সিসকোতে দেখা গিয়েছে। মজার কথাই বটে। যারাই অদৃশ্য হয়ে যায় তাদেরই নাকি স্যান ফ্রান্সিসকোতে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। শহরটা নিশ্চয় খুব সুন্দর। পরলোকের সমস্ত কিছু আকর্ষণ নিশ্চয় ওখানে রয়েছে।