পাগল কোথাকার!
তাই যেন হয়; কিন্তু দুশ্চিন্তা না করে আমি পারছিনে। ওই তো ডাচেস আসছে। দেখ, আমরা ফিরে এসেছি।
ডাচেস বললেন, মিঃ গ্রে, আমি সব শুনেছি। বেচারা জিয়োফ্রি খুব ঘাবড়ে গিয়েছে। শুনলাম খরগোশটাকে গুলি করতে তুমিই তাকে নিষেধ করছিলো কী কাণ্ড!
সেই রকমই বটে। কেন তাকে নিষেধ করতে গেলাম তা আমিই জানিনে। খরগোশ দেখতে বড়ো সুন্দর ছিল। কিন্তু লোকটার কথা তোমার কানে গিয়েছে শুনে আমি দুঃখিত। ঘটনাটা ভয়ালকা।
লর্ড হেনরি বললেন, বিরক্তিকর। এর মনস্তাত্ত্বিক কোনো মূল্য নেই। জিয়োফ্রি যদি ইচ্ছে করে এই কাজটা করত তা হলেও না হয় এর একটা সদর্থ খুঁজে পাওয়া যেত। কেউ সত্যি-সত্যি হত্যা করেছে এই রকম একটি লোকের সঙ্গে পরিচিত হলে খুশি হতাম।
ডাচেস চিৎকার করে উঠলেন, হ্যারি, কী ভয়ঙ্কর মানুষ তুমি! তাই না, মিঃ গ্রে? হ্যারি, মিঃ গ্রে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মূৰ্ছা যাবেন বলে মনে হচ্ছে।
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে ডোরিয়েন হেসে বললেন, ও কিছু নয়। আমার শরীরটা কেমন নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। এছাড়া আর কিছু নয়। ভয় হচ্ছে আজ সকালে অনেকটা হেঁটেছি। হ্যারি কী বলল তা শুনিনি। খুব বাজে কথা বুঝি? যাই হোক, অন্য সময় বলো। এখন আমি বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়ি। তোমরা কিছু মনে করো না, কেমন?
এই বলে ডোরিয়েন ভেতরে ঢুকে গেলেন।
হেনরি ঘুরে দাঁড়িয়ে তন্দ্রালু চোখে ডাচেসের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি ওকে খুব ভালোবাস?
কিছুক্ষণ কোনো উত্তর দিলেন না ডাচেস; সামনের দিকে তাকিয়ে রইলেন; তারপরে বললেন, তাই যদি জানতাম।
মাথা নাড়লেন হেনরি বললেন, জানাটা মারাত্মক। অনিশ্চয়তাই মানুষকে মুগ্ধ করে। কুয়াশার অস্পষ্টতাই চমৎকার।
তাতে পথ হারানোর সম্ভাবনা বেশি।
প্রিয় গ্ল্যাডিস, সব পথেরই লক্ষ্য এক জায়গায়।
সেটা কী?
ভ্রান্তির অবসান।
স্ট্রবেরির পারা ঘেঁটে আমি ক্লান্ত।
ওগুলিই তোমায় ভালো মানায়।
বাইরের জীবনে।
লর্ড হেনরি বললেন, ওগুলিকে তুমি শেষ পর্যন্ত হারিয়ে ফেলবে।
না, একটিও হারাব না।
মনমাউথের কান রেযেছে।
বৃদ্ধ বয়সে কানে কম শোনে মানুষ।
অপরের সঙ্গে তোমাকে মিশতে দেখলে ও রাগ করে না?
তাই যদি করত!
লর্ড হেনরি চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখলেন। মনে হল কী যেন খুঁজছেন তিনি।
ডাচেস জিজ্ঞাসা করলেন, কী খুঁজছ?
তোমার মনের চাবিকাঠিটা। তুমি সেটা ফেলে দিয়েছ।
ভয় নেই। এখনো মুখোশ রয়েছে আমার মুখে–হেসে বললেন ডাচেস। তোমার চোখগুলি বড়ো সুন্দর।
মুক্তার মতো দাঁতগুলি বের করে আবার হাসলেন ডাচেস।
ওপরে তাঁর নিজের ঘরে একটা সোফার ওপরে শুয়েছিলেন ডোরিয়েন। যন্ত্রণায় তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি কুঁকড়ে-কুঁকড়ে উঠেছিল। হঠাৎ মনে হল জীবনের এই ভয়াবহ বোঝা আর তিনি বইতে পারছে না। বনের ভিতর জন্তু-জানোয়ারের মতো সেই হতভাগ্য লোকটির মৃত্যু তাঁর মন অস্বস্তিতে ভরিয়ে দিয়েছিল।
বিকাল পাঁচটার সময় বেল বাজালেন তিনি। চাকর ঘরে এসে ঢুকতে সেই রাত্রির ট্রেনেই শহরে ফিরে যাওয়ার জন্যে চাকরকে নির্দেশ দিলেন তিনি। সব জিনিসপত্র গোছগাছ করে। নিতে বললেন, সেই সঙ্গে বলে দিলেন ঠিক সাড়ে আটটার সময় গাড়ি যেন তৈরি থাকে। আর একটি রাতও তিন এ বাড়িতে কাটাবেন না। বাডিটা অলক্ষণে এখানে দিনের বেলায় প্রকাশ্যে মৃত্যু হেঁটে বেড়াচ্ছে। এখানে অরণ্যের ঘাসগুলি রক্তে লাল হয়ে উঠেছে। তারপরে একটা চিঠি লিখলেন লর্ড হেনরিকে; জানালেন যে ডাক্তার দেখানোর জন্যে তিনি শহরে যাচ্ছেন; সেই সঙ্গে অনুরোধ করলেন তাঁর অনুপস্থিতিতে তিনি যেন তাঁর অতিথিদের দেখাশোনা করেন। চিঠিটা লিখে খামে মুড়তে যাবেন এমন সময় চাকর এসে জানাল যে। ‘হেড-কিপার’ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চায়। ধ্রুকুটি করলেন তিনি; ঠোঁটটাও একেবার কামড়ালেন, তারপরে একটু ভেবে বললেন, পাঠিয়ে দাও।
হেড-কিপার ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ড্রয়ারের ভেতর থেকে একটা চেকবই বার করলেন ডোরিয়েন; তারপরে বইটি তার সামনে খুলে বললেন, আজ সকালে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে তারই জন্যে তুমি এসেছ-তাই না থ্রনটন?-কমলটা তুলে নিলেন তিনি।
হ্যাঁ, স্যার।
লোকটা কি বিয়ে করেছে? ওর কোনো পোষ্য রয়েছে? থাকলে, তারা কেউ অভাবে পড়ুক তা আমি চাইনে। কত টাকা তাদের দিতে হবে বল। আমি তাদের পাঠিয়ে দেব।
লোকটা যে কে তা আমরা কেউ বুঝতে পারছিনে, স্যার। সেই জন্যেই আপনার কাছে এসেছিলাম।
তোমরা জান না? কী বলছ? ও কি তোমাদের লোক নয়?
না, স্যার। কোনোদিন ওকে আমরা দেখিনি। নাবিক বলে মনে হচ্ছে স্যার।
ডোরিয়েন গ্রে-র হাত থেকে কলমটা পড়ে গেল; মনে হল, হঠাৎ তাঁর রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তিনি চিৎকার করে উঠলেন, কী বললে? নাবিক?
হ্যাঁ, স্যার। চিহ্ন দেখে সেই রকমই মনে হয়েছে আমাদের।
বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ওর কাছ থেকে এমন কিছু পাওনি যা থেকে ওর নামটা কী জানা যায়?
সামান্য কিছু টাকা, আর ছ’নলা একটা পিস্তল। কোনো নাম নেই। চেহারাটা ভালোই, তবে একটু উগ্র। আমাদের ধারণা, নাবিক।
চমকে দাঁড়িয়ে উঠলেন ডোরিয়েন, দেহটা কোথায়? চল–এখনই; আমি দেখব।
মৃতদেহটা হোম ফার্মে রাখা হয়েছে স্যার।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই দেখা গেল ডোরিয়েন গ্রে ঘোড়ার পিঠে চডে লম্বা-চওড়া রাস্তা ধরে মুটে চলেছেন হোম ফার্মের দিকে। নির্ধারিত ভাযগায় পৌঁছেই তিনি দেখতে পেলেন দুটি লোক বাইরের উঠোনে পায়চারি করছে। ঘোড়া থেকে লাফিয়ে পড়লেন তিনি;তারপরে ওই দুটি লোকের হেপাজতে ঘোড়া আর চাবুকটা রেখে তিনি শেষ প্রান্তের একটা আস্তাবলের দিকে এগিয়ে গেলেন। ঘরের মধ্যে একটা আলো জ্বলছিল। সেই দেখেই তিনি বুঝতে পারলেন। ওখানে একটা মৃতদেহ রয়েছে। দরজার সামনে গিয়ে তিনি তালার ওপরে হাত রাখলেন, একটু থামলেন। মনে হল লোকটিকে যেন তিনি চিনতে পেরেছেন। মনে হল এই আবিষ্কার হয় তাঁর জীবনকে বাঁচাবে না হয় ধ্বংস করে ফেলবে। তারপরেই তিনি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলেন।