কিন্তু তবু ব্যাপারটা যদি নিছক দৃষ্টিভ্রমই হত তাহলে তাঁর বিবেক কি অত ভয়ঙ্কর ছায়ামূর্তির কল্পনা করতে পারত! ভাবতেও গা কেমন ছমছম করে। এইভাবে দিনের পর দিন। যদি প্রতিটি অলিগলি থেকে, পথে-প্রান্তর থেকে তাঁর খাওয়ার টেবিলের পাশ থেকে আতঙ্ক স্থির চক্ষু দুটি মেলে তাঁর দিকে তাকিয়ে থআকে, তাঁর সাধারণ গতিকে বিভ্রান্ত করে তোলে তাহলে শেষ পর্যন্ত তাঁর জীবনের পরিণতি কী দাঁড়াবে? এই চিন্তাটা তাঁর মাথার মধ্যে ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গে তিনি ভয়ে হিম হয়ে যান; বাতাস হঠাৎ হিমেল হয়ে যায়। হায়রে, উত্তেজনার কী এক উন্মাদ মুহূর্তে তিনি তাঁর বন্ধুকে হত্যা করেছিলেন? সেই হত্যার দৃশ্যটা কী মর্মান্তিক! সবই যেন তিনি আবার দেখতে পেলেন। সে রাত্রির প্রতিটি ঘটনার ভয়ঙ্কর খুটিনাটিগুলি তাঁর। ভীতি আরো বাড়িয়ে দিল। কালের কালো গুহা থেকে তাঁর পাপ রূপায়িত হয়ে তাঁর চোখের সামনে দাঁড়াল। সন্ধে ছটার সময় লর্ড হেনরি যখন তাঁর বাসায় এসে পৌঁছলেন তখন তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।
পর-পর তিন দিন ঠিক এইভাবেই কাটালেন তিনি। তারপর ঘর থেকে বেরোলেন। সেই পরিচ্ছন্ন পাইন গাছের গন্ধে ভরা শীতের সকাল তাঁর মন আনন্দে ভরিয়ে তুলল, বাঁচার নতুন স্বাদ পেলেন তিনি। কিন্তু এই পরিবর্তনের কারণ নিছক প্রাকৃতিক পরিবেশই নয় যে দুঃখবোধ তাঁর বাঁচার পথে বাধার সৃষ্টি করেছিল, ভারাক্রান্ত করে তুলেছিল তাঁর মনকে, তারই বিরুদ্ধে তাঁর চরিত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। যাঁদের মন সুচারু শিল্পের রেশমে গড়া তাঁদের এই রকমই হয়। তাঁদের তীক্ষ্ণ উচ্ছ্বাস হয় আহত হয়, না হয় আত্মসমর্পণ করে। তারা হয় অপরকে হত্যা করে, না হয় তো হত্যা করে নিজেদের। মহৎ প্রেম অথবা মহৎ দুঃখ এইভাবে নিজেদের প্রাচুর্যের উচ্ছ্বাসেই বিনষ্ট হয়। ছোটো দুঃখ অথবা অগভীর প্রেমই বেঁচে থাকে। তাছাড়া, তিনি যে একটা অমূলক বিভ্রান্তির শিকার হয়ে পড়েছিলেন সে-বিষয়ে তাঁর কোনো সন্দেহ ছিল না। তাঁর ভীতিকে তাই তিনি কৃপার দৃষ্টিতে না দেখে পারলেন না; কেবল কৃপা নয়, ঘৃণার দৃষ্টিতেও।
প্রাতরাশ শেষ করে ঘন্টাখানেক তিনি ডাচেস-এর সঙ্গে বাগানে বেড়ালেন; তারপরে গাড়িতে চেপে পার্ক পেরিয়ে তিনি শিকার পার্টিতে যোগ দিলেন। পাইন বলের একধারে দেখা হল ডাচেস-এর ভাই স্যার জিয়োফ্রি ক্লাউসটন-এর সঙ্গে। ভদ্রলোক তখন বন্দুকের ভেতর থেকে দুটো টোটা বার করছিলেন। ডোরিয়েন গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে এলেন; তারপরে সহিসের হাতে ঘোড়াটাকে ছেড়ে দিয়ে তিনি শুকনো গাছের ডালের ভেতর দিয়ে সেই দিকে এগোতে লাগলেন।
জিজ্ঞাসা করলেন, জিয়োফ্রি, ভালো শিকার মিলেছে?
না; তেমন আর মিলল কোথায়, ডোরিয়েন? আমার ধারণা বেশির ভাগ পাখিই বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে। আশা করি লাঞ্চের পরে আমরা যেখানে যাব সেখানে নিশ্চয় অনেক ভালো। শিকার পাব।
হঠাৎ তাঁর কাছ থেকে কুড়ি গজের মতো দূরে একটা পুরনো ঘাসের ঝোপ থেকে কালো ডোরা কাটা একটা খরগোশ কান উঁচু করে সামনে বেরিয়ে এল। সে পাশের একটা ঝোপের দিকে দৌড়ে যেতেই স্যার জিয়োফ্রি কাঁধের ওপরে বন্দুকটা বাগিয়ে ধরলেন কিন্তু খরগোশটার চেহারার মধ্যে এমন একটি সৌন্দর্য দেখা গেল যে ডোরিয়েন মুগ্ধ না হয়ে পারলেন না; তিনি চেঁচিয়ে বললেন, ওকে মেরো না, জিয়োফ্রি। ওটা বাঁচুক।
তাঁর সঙ্গীটি হেসে বললেন, দুত্তোর! কী আজেবাজে বকছ?
খরগোশটা পাশের ঝোপের মধ্যে লাফিয়ে পড়ার আগেই স্যার জিয়োফ্রি ঘোড়াটা টিপে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে দুটো আর্তনাদ শোনা গেল;খরগোশের মৃত্যুযন্ত্রণার কাতরানি, আর তার চেয়েও ভয়াবহ একটি মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের আর্তনাদ।
স্যার জিয়োফ্রি চিৎকার করে উঠলেন, হায় ভগবান, যারা ভালোযার তাড়াচ্ছিল তাদেরই। একজনের গায়ে গুলি লেগেছে। লোকটা কী গাধা বল তো! বন্দুকের নলের মুখোমুখি কখনো কেউ দাঁড়ায়?
তারপরে তিনি চেঁচিয়ে সাবধান করে দিলেন, এই গুলি ছোঁড়া বন্ধ কর সব। একটা লোক আহত হয়েছে।
হাতে করে একটা ছড়ি নিয়ে প্রধান দারোয়ান ছুটে এল।
কোথায় স্যার? লোকটা কোথায়?
ঠিক সেই সময় চারপাশে বন্দুক ছোঁড়া বন্ধ হয়ে গেল।
ঝোপের দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে-যেতে স্যার জিয়োফ্রি রেগে বললেন, এদিকে।
লোকগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখ না কেন বলত? সারাটা দিন আমার নষ্ট করে দিলো
তারা দুজনে ডালপালা সরিয়ে ঝোপের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ডোরিয়েন তা দেখলেন। একটু পরে একটা লোককে তারা বাইরে টেনে আনল। ভয়ে তিনি মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। তাঁর মনে হল দুর্ভাগ্য তাঁর পিছু নিয়েছে। জিয়োফ্রি জিজ্ঞাসা করলেন লোকটা সত্যি সত্যিই মারা গিয়েছে কিনা দারোযাল বলল–হ্যাঁ। দুজনের কথাই কানে এল তাঁর মনে হল অরণ্য হঠাৎ জনাকীর্ণ হয়ে উঠেছে। চারপাশ থেকে লোক ছুটে আসছে। তাদের গলার অস্পষ্ট স্বর শোনা গেল।
কয়েকটি মুহ্নত একটা অনির্বচনীয় যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে কেটে গেল তাঁরা মনে হল সময় যেন আর কাটে না। তারপরেই কে যেন তাঁকে কাঁধের ওপরে হাত রাখল। চমকে উঠে ফিরে দাঁড়ালেন তিনি।
লর্ড হেনরি বললেন, ডোরিয়েন, আজকের মতো শিকার বন্ধ করতে আমি বরং ওদের বলে দিই। শিকার চালিয়ে যাওয়াটা ভালো দেখাবে না।