এবং তা তুমি পেয়েছ?
হ্যাঁ; নিশ্চয়।
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল ডাচেস-এর বললেন, আমি শান্তি খুঁজেছি। আমি যদি এখনই গিয়ে পোশাক পরিবর্তন না করি তাহলে আজ সন্ধ্যায় আমাকে শান্তি পাওয়ার আশা ছেড়ে দিতে হবে।
দাঁড়িয়ে উঠে ডোরিয়েন বললেন, তোমাকে কয়েকটা অর্কিড এনে দিই, ডাচেস।
লর্ড হেনরি তাঁর আত্মীয়াকে বললেন, তোমার চালচলনটা বেশ জুৎসই হচ্ছে না। খুব সাবধান। ওকে দেখে মেয়েরা মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আকর্ষণ করার শক্তি ওর অসীম।
সে-ক্ষমতা ওর না থাকলে, কোনো লড়াই হত না।
তাহলে বলতে চাও সেয়ানে-সেখানে কোলাকুলি চলছে তোমাদের?
আমি ট্রোজানদের দলে। একটি মহিলার জন্যে তারা লড়াই করেছিল।
পরাজিত হয়েছিল তারা।
ডাচেস বলেলন, বন্দিনী হওয়ার চেয়ে খারাপ জিনিস রয়েছে।
তুমি বলগা ছেড়ে দিয়ে লাফাচ্ছে।
দ্রুতগতিই তো বেঁচে থাকারই অঙ্গ।
আমার ডায়েরিতে আজ রাত্রিতে কথাটা আমি লিখে রাখব।
কোন কথাটা?
যে আগুনে পোড়া শিশু আগুনকে ভালোবাসে।
পোড়া দূরের কথা, আমার গায়ে আঁচও লাগেনি। আমার পাখা পোড়েনি।
এক উড়ে যাওয়া ছাড়া, ওই পাখা দিয়ে তুমি সব কাজই কর।
সাহস আজকাল পুরুষদের কাছ থেকে মেয়েদের কাছে এসে পড়েছে। এটা আমাদের কাছে একটা নতুন অভিজ্ঞতা।
তোমার একটি প্রতিদ্বন্দিনী রয়েছেন।
কে?
তিনি হেসে বললেন, লেডি নরবোরো। ভদ্রমহিলা ওকে একেবারে পুজো করো।
তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিল। আমাদের মতো যারা রোমান্টিক তাদের কাছে প্রাচীনত্ব ভয়ানক রকমের বিপজ্জনক।
তুমি নিজেকে রোমান্টিক বলছ! তোমার সব কটি ছলাকলাই তো দেখছি বৈজ্ঞানিক।
পুরুষরাই আমাদের সব কিছু শিখিয়েছে।
কিন্তু তোমাদের আত্মাকে উদ্ঘাটিত করেনি।
জাতি হিসাবে আমাদের নারীদের ব্যাখ্যা কী?
তোমরা হচ্ছ স্ফিংকস-এর জাতি; তফাৎ এইটুকু যে গোপন রহস্য বলতে তোমাদের কিছু নেই।
তাঁর দিকে তাকিয়ে ডাচেস একটু হেসে বললেন, মিঃ গ্রের এত দেরি হচ্ছে কেন? চল, তাঁকে সাহায্য করিগে। আমার ফ্রকের রঙটা এখনো তাঁকে বলা হয়নি।
তার ফুলের রঙের সঙ্গে তোমার ফ্রকের রঙটা মিলাতেই হবে তোমাকে, গ্ল্যাডিস।এর অর্থই হচ্ছে বেশি তাড়াতাড়ি নিজেক সমর্পণ করা।
রোমান্টিক আর্টের শুরুই হচ্ছে শেষ থেকে।
কিন্তু বেরিয়ে আসার পথএকটা খোলা রাখতে হবে তো।
পার্থিয়ানদের মতো?
তারা তো মরুভূমির মধ্যে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিল। আমার পক্ষে তা সম্ভব হবে না।
লর্ড হেনরি কথা শেষ করার আগেই ফুলগাছগুলি যে ঘরে থাকে সেই দিক থেকে একটা চাপা আর্তনাদ শোনা গেল। একটা ভারী জিনিস মাটিতে পড়ে যাওয়ারও শব্দ এল কানে। সবাই চমকে ছুটে গেল সেইদিকে। ভয়ে চলচ্ছক্তিহীনা হয়ে গেলেন ডাচেস। ভয়ে বিহ্বল হয়ে উঠলেন লর্ড হেনরি। পাম গাছের পাতার ভেতর দিয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখলেন ডোরিয়েন গ্রে মেঝের ওপরে মুখ থুবড়ে পড়ে মূৰ্ছা গিয়েছেন।
তাঁকে তক্ষুনি বসার ঘরে তুলে নিয়ে আসা হল; শুইয়ে দেওয়া হল সোফার ওপরে। সামান্য কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর জ্ঞান ফিরে এল। বিভ্রান্তের মতো চারপাশে তাকাতে লাগলেন তিনি।
জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে বল তো? হ্যাঁ, হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। হ্যারি, এখানে কি আমি নিরাপদ?
এইটুকু বলেই তিনি কাঁপতে লাগলেন।
লর্ড হেনরি বললেন, প্রিয় ডোরিয়েন, তুমি মূৰ্ছা গিয়েছিলে মাত্র। এ ছাড়া আর কিছু তোমার হয়নি। নিশ্চয় তুমি খুব বেশি পরিশ্রম করছ। ডিনারের তোমার না যাওয়াই ভালো।
দাঁড়ানোর চেষ্টা করে ডোরিয়েন বললেন, না, না; আমি যাব। আমার নীচে যাওয়াই ভালো। আমি একলা থাকব না।
ঘরে গিয়ে তিনি পোশাক পরিবর্তন করলেন। খেতে বসে খুশির অকারণ উচ্ছ্বাসে মেতে উঠলেন। কিন্তু মাঝে-মাঝে ভয়ে তিনি শিউরে উঠতে লাগলেন। তাঁর মনে হল ফুল গাছ রাখার ঘরের দেওয়ালের গায়ে সাদা রুমালের মতো, জেমস ভেন-এর মুখ তিনি দেখেছেন। জেমস যেন তাঁর গতিবিধি লক্ষ করছে।
.
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
পরের দিন তিনি আর ঘর ছেড়ে বেরোলেন না। সত্যি কথা বলতে কি যদিও জীবনের বিষয়ে তিনি উদাসীন ছিলেন, তবু আসন্ন মৃত্যুর ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে বেশির ভাগ সময়টাই তিনি ঘরের মধ্যে কাটালেন। কেউ যে তাঁর পিছু নিয়েছে, তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে–এই রকম একটা ধারণা তাঁকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলল। বাতাসে কিছু নড়াচড়ার শব্দ হলেই তিনি কেঁপে উঠতেন। জানালার শার্সিত মরা পাতার ঝাপটা শুনে তাঁর মনে হত সেগুলি বুঝি বা তাঁরই ব্যর্থ প্রতিজ্ঞা আর অর্থহীন অনুশোচনা ছাড়া আর কিছু নয়। চোখ দুটো বুজলেই তিনি দেখতে পেতেন একটি নাবিকের তীক্ষ্ণ দুটো চোখ তাঁর সমস্ত গতিবিধি লক্ষ করছে। তখনই ভয়ে তাঁর অন্তরাত্মা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত।
কিন্তু সম্ভবত সত্যিই কেউ তাঁর পেছনে ঘোরেনি। সেদিন রাত্রিতে যে দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল, যে শান্তি তাঁকে নিতে হচ্ছিল এটা হয়তো তারই একটা প্রতিচ্ছবি। বাস্তব উদীবনটাই হচ্ছে কেমন যেন গণ্ডগোলে। কিন্তু আমাদের কল্পনার মধ্যে একটা সুশঙুল নীতি রয়েছে। এই কল্পনাই পাপের অনুশোচনায় আমাদের পরিচালিত করে এই কল্পনার ভেতরে প্রতিটি পাপ প্রতিফলিত করে নিজেকে। বাস্তব জগতে পাপীরা শাস্তি পায় না, পুরস্কৃত না সাধুরা। সবলরা সাফল্য অর্জন করে, অসাফল্যের সমস্ত কালিমা চাপানো হয় দুর্বলের মাথায়। এ ছাড়া আর কিছু নয়। তাছাড়া যদি কোনো অপরিচিত মানুষ তাঁর বাড়ির আশেপাশে ঘুরে বেড়াত তাহলে নিশ্চয় চাকর-বাকরদের কেউ তাকে দেখতে পেত। কারো পায়ের মাপ যদি বাগানে। পড়ত তাহলে মালিই ব্যাপারটা কালে তুলত তাঁর। হ্যাঁ; ওটা তাঁর কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। তাঁকে হত্যা করার জন্যে সাইবিল ভেন-এর তাঁর পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছে না। সে নিশ্চয় সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছে এতক্ষণে। যেমন করেই হোক, তার হাত থেকে তিনি রেহাই পেয়েছেন। তাছাড়া তিনি কে সেকথা জানতও না, জানার কোনো উপায়ও তার ছিল না। যৌবনের মুখোশ তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।