ডোরিয়েন স্খলিত স্বরে বললেন, থামুন, থামুন। আপনি আমাকে বিভ্রান্ত করে তুলেছেন। কী বলব আমি তা বুঝতে পারছি না, আপনার প্রশ্নের উত্তর একটা কিছু রয়েছে, কিন্তু সেটা কী তা আমি ঠিক পারছি না। আপনি আর কিছু বলবেন না। আমাকে একটু ভাবতে দিন। অথবা এ বিষয়ে কিছু চিন্তা না করাই ভালো।
ঠোঁট দুটি ফাঁক করে প্রায় দশটি মিনিট তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। চোখ দুটি তাঁর অস্বাভাবিক ভাবে জ্বল জ্বল করতে লাগল। তিনি যেন বুঝতে পারলে একেবারে নতুন ধরনের কিছু প্রভাব তাঁর মনের গভীরে অনুপ্রবেশ করেছে। তবু তাঁর মনে হল এগুলি তাঁর নিজেরই। যে কটি কথা বেসিলের বন্ধু তাঁকে বলেছেন, কথাগুলি নিঃসন্দেহ-হঠাৎ করেই বলা, উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়, সেগুলি তাঁর হৃদয়ের গোপন তারে গিয়ে আঘাত করেছে। এরকম। আঘাত আগে কেউ কখনো করেনি। কিন্তু এখন তার মনে হলো একটি নতুন মূদনায় সেই তন্ত্রীগুলি কেঁপে কেঁপে উঠছে।
সঙ্গীত তাঁকে এইভাবেই উদ্বেলিত করেছে। অনেকবার অঙ্গীত তাঁকে কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু সে সঙ্গীত মুখর ছিল না, এটা তাঁর কাছে নতুন কিছু ছিল না, এটি হচ্ছে আর একটি অনাবিষ্কৃত বিশৃঙ্খলা। আমাদের মনের মধ্যে ভগবান এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে রেখেছেন। কথা, কেবল কথা! কী নিতুর এরা! কত সপষ্ট, পরিচ্ছন্ন এবং নিষ্ঠুর। এদের হাত থেকে মুক্তি নেই কারো। অথচ তাদের মধ্যে কী তীক্ষ্ণ ব্যঞ্জনা রয়েছে। একদিন যা নিরাকার ছিল তাকেই সাকার করে তোলে এরা। বেহালা অথবা বাঁশির সুরের মতো মিষ্টি এর সুর। শুধু কথা! কথার মতো বাস্তব জিনিস আর কোথাও কিছু রয়েছে?
সত্যি কথা, তাঁর বাল্যে এমন সব জিনিস ছিল যার অর্থ তিনি তখন বুঝতে পারতেন না। সেগুলিকে এখন তিনি বুঝতে পারেন। জীবন হঠাৎ তাঁর কাছে অগ্নিবর্ণ ধারণ করেছে। মনে হচ্ছে তিনি যেন আগুনের ওপরে বিচরণ করছেন। একথা তিনি বুঝতে পারেননি কেন?
ইঙ্গিতমিয় হাসি হেসে লর্ড হেনরি তাঁকে লক্ষ করলেন। মনের অবস্থা ঠিক কী রকম থাকলে মানুষকে কিছু বলা উচিত নয় তা তিনি জানতেন। তাঁর কৌতহল বেশ বেড়ে উঠল। তাঁর কথাগুলি যে হঠাৎ এতটা অর্থবহ হয়ে দাঁড়াবে তা বুঝতে পেরে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। ষোল বছর বয়সে তিনি একটি বই পড়েছিলেন। সেই বইটি পড়ে তিনি এমন কতকগুলি। জিনিস জানতে পেরেছিলেন যেগুলি তিনি আগে জানতেন না। ডোরিয়েন গ্রে কি সেই ধরনেরই বিশেষ কোনো অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছেন? তিনি তো বাতাসে একটি তীর ছুঁড়েছেন মাত্র, সেই তীর কি কোনো লক্ষ্যবস্তু ভেদ করেছে? মানুষকে মুগ্ধ করার শক্তি ছেলেটির কী সত্যিই অপরিসীম?
দুজনেই যে নির্বাক হয়ে রয়েছেন সে দিকে কোনো খেয়াল ছিল না বেসিলের। তিনি আপন মনে অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে ছবি এঁকে চলেছেন। সত্যিকারের নিপুণ চিত্রকর ছাড়া এ ধরনের ছবি আঁকা সত্যিই কল্পনার অতীত।
ডোরিয়েন গ্রে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, বেসিল, আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমি একটু বাগানে গিয়ে বসি, আমর দম বন্ধ হয়ে আসছে এখানে।
বন্ধু, আমি খুব দুঃখিত। ছবি আঁকার সময় আমি অন্য কিছু ভাবতে পারি না। কিন্তু আজকের মতো ভালোভাবে আর কোনোদিনই তুমি মডেলের কাজ করতে পারনি। একেবারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলে তুমি আর আমি তোমর কাছ থেকে যা পেতে চেয়েছিলাম তার সবটুকুই পেযেছি–অর্ধউন্মোচিত দুটি ঠোঁট এবং চোখের ওই উজ্জ্বল আভা। হ্যারি তোমাকে এতক্ষণ কী বলছিল তা আমি জানি না, কিন্তু সে নিশ্চয় এমন কিছু বলেছিল যার প্রভাবে পড়ে তোমার মুখের ওপরে এই রকম অপরূপ একটি ব্যঞ্জনা ফুটে বেরিয়েছে। মনে হচ্ছে, তোমাকে সে প্রশংসা করছিল। ও যা বলে তার একটি বর্ণও তুমি বিশ্বাস করো না।
উনি মোটেই আমাকে প্রশংসা করেননি। সম্ভবত সেই জন্যই উনি আমাকে যা বলেছেন তার একটুও আমি বিশ্বাস করতে পারিনি।
ক্লান্ত আর স্বপ্নিল চোখে তাকিয়ে লর্ড হেনরি বললেন, আপনি জানেন আমি যা বলেছি তার সমস্তটাই আপনি বিশ্বাস করেন। আপনার সঙ্গে বাগানে আমিও যাব চলুন। এই স্টুডিওর ঘরটিতে ভীষণ গরম লাগছে। বেসিল আমাদের ঠান্ডা কিছু খেতে দাও, স্ট্রবেরি মেশানো কিছু।
নিশ্চয়, নিশ্চয় হ্যারি। বেলটা বাজাও। পার্কার এলে তোমাদের যা যা দরকার সব এনে দিতে বলছি। আমার কিছু কাজ বাকি রয়েছে। সেটুকু করতে আমি যাচ্ছি ডোরিয়েনকে বেশিক্ষণ আটকে রেখ না। আজকে আমরা যে মুড এসেছে, এরকম মুড অনেকদিন আসেনি। এটা আমার সর্বোত্তম সৃষ্টি হবে, এমনিতেই এটা একটা মাস্টারপিস।
লর্ড হেনরী বাগানে বেরিয়ে গিয়ে দেখলেন লাইল্যাক ফুলের ঝাডের ঠান্ডা ছায়ার ডোরিয়েন গ্রে দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে রয়েছেন। যেমন করে মানুষ মদ্যপান করে, মনে হল ঠিক সেই রকম ভাবে ফুলের সুগন্ধ তিনি পান করছেন। তিনি তাঁর কাছে এগিয়ে এলেন, একটা হাত তাঁর কাঁধের উপরে রাখলেন, এবং মৃদুস্বরে বললেন, আপনি ঠিকই করছেন। অনুভূতি ছাড়া আম্মাকে সুস্থ করা যায় না, যেমন আত্মাকে বাদ দিয়ে অনুভূতি পঙ্গু হয়ে যায়।
যুবকটি চমকে উঠে পিছিয়ে বসেন। তাঁর মাথা খোলা এবং গাছের পাতাগুলি তাঁর সেই উদ্দাম বিদ্রোহী চুলগুলির ওপরে পড়ে রঙিন জালের সৃষ্টি করেছিল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরে মানুষের চোখের মধ্যে যেমন একটা ভীতিজনক বিহ্বলতা ডেংগে ওঠে, তাঁর চোখের ভেতর থেকে সেই রকম একটা ভয়ের আমেজ ফুটে বেরোল। তাঁর খোদাই করা সুন্দর নাকটি কাঁপতে লাগল, কোনো একটি গোপন দুর্বল স্নায়ুর কাঁপুনি জেগে উঠল তাঁর রঙিন ঠোঁটের ওপরে। ঠোঁট দুটি সেই আবেগে কাঁপতে লাগল।