মেয়েটা চিবিয়ে চিবিয়ে হেসে উঠল, শিশুর চেয়ে কিছু বড়ো! তাই বটে! কী বলছ তুমি! আমার যে অবস্থা দেখছ তার জন্যে দায়ী ওই প্রিন্স চার্মিং! আঠারো বছর আগে ওই লোকটা আমাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
জেমস ভেন চিৎকার করে উঠল, মিথ্যে কথা বলছ তুমি।
আবেদন করার ভঙ্গিতে আকাশে হাত দুটি তুলে মেয়েটি বলল, ভগবানের দিব্যি, আমি সত্যি কথা বলছি।
ভগবানের দিব্যি!
আমার কথা যদি সত্যি না হয় তাহলে আমি যেন বোবা হয়ে যাই। এখানে যারা আসে ও হচ্ছে তাদের মধ্যে নিকৃষ্ট। লোকে বলে সুন্দর মুখের জন্যে মানুষটা শয়তানের কাছে নিজেকে। বিক্রি করে দিয়েছে। প্রায় আঠারো বছর আগে ওর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হ্য। সেই থেকে ওর চেহারার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। যদিও আমার হয়েছে অনেক।
তুমি দিব্যি করে বলছ?
তার সেই চওড়া থ্যাবড়ানো মুখের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা প্রতিধ্বনি; আমি দিব্যি করছি। আমি ওকে বড়ো ভয় করি। আজকের জন্যে আমাকে কিছু টাকা দাও।
একটা কুৎসিত কথা বলে সে ঘুরে দাঁড়াল, দৌড়ে বেরিয়ে গেল রাস্তায়। কিন্তু ততক্ষণে ডোরিয়েন গ্রে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছেন। পিছু ফিরে তাকাল জেমস। মেয়েটিও তখন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।
.
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
সপ্তাহখানেক পরের কথা। সেলবি রয়্যাল-এর বাড়িতে এসে ডোরিয়েন গ্রে মনমাউথ-এর সুন্দরী স্ত্রী ডাচেস-এর সঙ্গে গল্প করছিলাম। পাশে ছিলেন তাঁর স্বামী লর্ড মনমাউথ, বয়স ষাটের কাছাকাছি, মনে হচ্ছে পরিশ্রান্ত। সময়টা চা খাওয়ার টেবিলের ওপরে ঢাকনি দেওয়া বিরাট বাতিদান থেকে একটা মিষ্টি আলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সান্ধ্য মজলিসে সভানেত্রীর আসন গ্রহণ করেছিলেন ডাচেস স্বয়ং। তাঁর সাদা হাত দুটি লঘুভাবে কাপের। ওপরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ডোরিয়েন গ্রে ফিসফিস করে তাঁকে যা বলছিলেন তাই শুনে তাঁর ঠোঁট দুটি ভরে উঠেছিল হাসিতো তাঁদের দিকে তাকিয়ে লর্ড হেনরি একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। পিচ রঙের একটি সোফার ওপরে বসেছিলেন লেডি নরবোরো; ব্রেডিল থেকে যে শেষ পোকাটা ডিউক সংগ্রহ করে এনেছিলেন তাঁরই মুখ থেকে সেই কাহিনীটি শোনার ভান করছিলেন তিনি। তিনটি যুদক ধোপদুরস্থ পোশাক পরে মহিলাদের চা পরিবেশন করছিল। মজলিসে উপস্থিত ছিলেন বারোজন। পরের দিন আরো কিছু অতিথিদের আসার কথা। টেবিলের কাছে হেলতে-দুলতে এগিয়ে গিয়ে এবং কাপটি নামিয়ে রেখে লর্ড হেনরি জিজ্ঞাসা করলেন, কী গল্প হচ্ছে তোমাদের? আশা করি আমি যে সকলের নতুন করে নামকরণের পরিকল্পনা করেছি তা বোধ হয় তুমি শুনেছ, গ্ল্যাডিস? পরিকল্পনাটা বড়ো সুন্দর।
অপরূপ সুন্দর দুটি চোখ তাঁর দিকে তুলে ডাচেস বললেন, আবার আমার নতুন নামকরণ করতে আমি রাভিদ লুই, হেনরি, আমার নিজের যা নাম তাতেই আমি খুশি] এবং মিঃ গ্রে-ও যে তাঁর নামে খুশি সে-বিষয়েও আমি নিশ্চিত।
ডোরিয়েন গ্রে বললেন, প্রিয় গ্ল্যাডিস, পৃথিবীতে এমন কিছু জিনিস নেই যার লোভে আমি দুটি নামের একটিও পরিবর্তন করতে রাজি হব। দুটিই নিখুঁত। বিশেষ করে আমি ফুলের কথা চিন্তা করছিলাম। গতকাল বাটনহোল-এ গোঁজার জন্যে আমি একটা অর্কিড ফুল কেটেছিলাম। ফুলটা কী সুন্দর; সাতটা ভয়ঙ্কর সাপের মতো গোটা গায়ে তার সুন্দর-সুন্দর ফুটকি কোনো কিছু না ভেবেই মালিকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ফুলের নামটা কী। সে। আমাকে বলল রবিন সোনিয়ানা বা ওই জাতীয় কোনো ভয়ঙ্কর জিনিস সেটি। কথাটা সত্যি; কিন্তু নামটা শুনে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু সুন্দর জিনিসের সুন্দর নাম দেওয়ার শক্তি আমরা হারিয়ে ফেলেছি। নামই তো সব, কাজ নিয়ে আমি কোনোদিন কলহ করি না। আমার একমাত্র বিবাদ শব্দের সঙ্গে। সেই জন্যে সাহিত্যে অশ্লীল নগ্নতাকে আমি ঘৃণা করি। যে লোক কোনো জিনিসকে তার আসল নামে চিহ্নিত করে সে কোদালকে কোদাল বলেই ডাকে। এ ছাড়া অন্য কোনো গুণ তার নেই।
ডাচেস জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে, তোমাকে কী নামে ডাকব, হ্যারি?
ডোরিয়েন বললেন, ওর নাম প্রিন্স প্যারাজক্স।
ডাচেস বললেন, আমি তো ওকে এক নজরে চিনে ফেলতে পারি।
একটা চেয়ারে ওপরে গাটা এলিয়ে দিয়ে লর্ড হেনরি বললেন, থাক, থাক, আর আমি শুনতে চাই না। দুর্নাম থেকে মুক্তি নেই মানুষের। আমি এ উচ্ছ্বাস পছন্দ করি না।
সুন্দরী ঠোঁট থেকে সাবধান বাণী একটা উচ্চারিত হল: রাজতন্ত্র সিংহাসনচ্যুত না হতে পারে,…
তুমি চাও আমি আমার সিংহাসন রক্ষা করি?
হ্যাঁ।
আগামীকাল যেটা সত্য হয়ে দাঁড়াবে আজকে আমি সেই কথাই বলি।
ডাচেস বললেন, আজকের ভুলগুলিকেই আমি পছন্দ করি বেশি।
তুমি আমাকে অস্ত্রহীন করে ফেলছ গ্ল্যাডিস।
তোমার বর্মটা সরিয়ে দিচ্ছি, বর্শটা নয়।
হাতটা আমনের দিকে ঘুরিয়ে তিনি বলবেন, সৌন্দর্যের ধাক্কায় মুখ থুবড়ে পড়ি না আমি।
বিশ্বাস কর হেনরি, ওটাই তোমার ভুল। সৌন্দর্যের দাম তোমার কাছে খুব বেশি।
একথা তুমি বলছ কী করে? স্বীকার করছি আমার কাছে ভালো হওয়ার চেয়ে সুন্দর হওয়া অনেক বালো। কিন্তু তবু সবার আগে এটাও আমি স্বীকার করি যে কুৎসিত হওয়ার চেয়ে ভালো হওয়া অনেক ভালো।
ডাচেস বললেন, তাহলে কি তুমি বলতে চাও যে সাতটি ভয়ঙ্কর পাপের মধ্যে কুৎসিত জিনিস একটি মারাত্নক পাপ? অর্কিডের সম্বন্ধে তোমার উপমাটা কী?