সব কিছুর সম্বন্ধে উদাসীন হয়ে অন্যায় করার জন্যে সমস্ত শক্তি সংগত করে, কলঙ্কিত মন আর বিদ্রোহের অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ডোরিয়েন গ্রে তাঁর চলার গতি বাড়িয়ে দিলেন; পতিতালয়ে যাওয়ার পথটা ছোটো করার জন্যে তিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা সরু গলির মধ্যে ঢুকে গেলেন; কিন্তু এই সময়ে পেছন থেকে অতর্কিতে দুটো হাত ধাক্কা দিয়ে তাঁকে দেওয়ালের গায়ে ঠেলে দিল; তারপরে, একটা হাত প্রচণ্ড শক্তিতে তার টুঁটিটা চেপে ধরল। সতর্ক হওয়ার এতটুকু সময় তিনি পেলেন না।
বাঁচার জন্যে পাগলের মতো চেষ্টা করলেন তিনি এবং কোনোরকমে তাঁর গলা থেকে আক্রমণকারীর হাতটা সরিয়ে দিলেন। মুহূর্তের মধ্যে রিভলভার বার করার একটা শব্দ তাঁর কানে গেল, তিনি দেখতে পেলেন একটা রিভলভারের মুখ চকচক করছে আর দেখলেন সেই মুখ তাঁর মাথাটা লক্ষ্য করে উঁচিয়ে রয়েছে। আবছায়ার মধ্যে তাঁর নজরে পড়ল একটা স্বাস্থ্যবান বেঁটে লোক তাঁর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
হাঁপাতে-হাঁপাতে জিজ্ঞাসা করলেন তিনিঃ কী চাও?
লোকটি বলল: চোপ। একটু নড়লেই তোমাকে আমি গুলি করে মারব।
তুমি পাগল। আমি তোমার কী করেছি?
উত্তর এল: তুমি সাইবিল ভেন-এর জীবন ধ্বংস করেছ। সাইবিল আমার বোন ছিল। সে আহত্যা করেছে। আমি তা জানি তোমার জন্যেই সে আত্মহত্যা করেছে। প্রতিজ্ঞা। করেছিলাম তোমাকে হত্যা করে তার বদলা নেব আমি। বছরের পর বছর ধরে আমি তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। কোনো সন্ধান পাইনি তোমার। যে-দুজন তোমাকে চিনিয়ে দিতে পারত তারা আজ মৃত। যে প্রিয় নামে সে তোমাকে ডাকত সেইটুকু ছাড়া তোমার সম্বন্ধে আর কিছুই আমি জানতাম না। আজই হঠাৎ সেই নামটা আমার কানে এল। ভাবানের কাছে শেষবারের মতো প্রার্থনা করে নাও, কারণ, আজ তোমাকে মরতেই হবে।
ভয়ে কাঠ হয়ে গেলেন ডোরিয়েন গ্রে। তিনি তোতলাতে-তোতলাতে বললেন: আমি তাকে কোনোদিনই চিনতাম না। তার নাম কোনোদিনই আমি শুনিনি। তুমি একটি উন্মাদ।
তার চেয়ে বরং নিজের দোষ স্বীকার কর। কারণ আমি যেমন সত্যি-সত্যিই জেমস ভেন, তেমনি সত্যি-সত্যিই তোমাকে মরতে হবে।
কয়েকটি ভয়াবহ মুহূর্ত। কী করা উচিত বা কী বলা উচিত কিছুই ভেবে পেলেন না ডোরিয়েন।
গর্জন করে উঠল লোকটি। হাঁটু মুড়ে বসা প্রার্থনা করার জন্যে এক মিনিট সময় তোমাকে আমি দিচ্ছি। তার বেশি নয়।
ডোরিয়েনের হাত দুটি নেতিয়ে পড়ল। ভয়ে হিম হয়ে গেল তাঁর দেহ। কিকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন তিনি। হঠাৎ তাঁর মগজে একটা আশার বিজলি খেলে গেল।
তিনি চিৎকার করে বললেন: থাম। কত বছর আগে আমার বোন মারা গিয়েছে। তাড়াতাড়ি বল।
লোকটি বলল: আজ থেকে আঠারো বছর আগে। একথা জিজ্ঞাসা করছ কেন? বয়সে কী আসে যায়?
বিজয়ীর মতো ডোরিয়েন হেসে বললেন: আঠারো বছর! আঠারো বছর! আলোর নীচে চল; আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখা।
কথাটা বুঝতে না পেরে জেমস ভেন একটু ইতস্তত করল। তারপরে তাঁকে টানতে-টানতে সেই গলির বাইরে নিয়ে এল।
বাতাসে আলোর শিখাগুলি কাঁপছিল সত্যি কথা, তবু সেই আলোতেই নিজের বিষম ভুলটা সে বুঝতে পারল। কারণ যে লোকটিকে সে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল সে যুবক, তার মুখের ওপরে নিষ্পাপ শিশুর অকলঙ্কিত পবিত্রতা। দেখলে মনে হবে তার বয়স বছর কুড়ির বেশি। নয়; যদি একটু বেশিই হয় তাহলে, অতগুলি বছর আগে ছাড়াছাড়ি হওয়ার সময় তার দিদির বয়স যা ছিল তার চেয়ে হয়তো সামান্য একটু বেশি। এটা স্পষ্ট বোঝা যায়, যে মানুষটি তার দিদির মৃত্যুর জন্যে দায়ী এ সে-মানুষ নয়।
হাত ছেড়ে দিয়ে সে পিছু হটে বলল, হায় ভগবান, হায় ভগবান; আর একটু হলে আমি তোমাকে খুন করে ফেলতাম।
দীর্ঘ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন ডোরিয়েন। তার দিকে তাকিয়ে বেশ রূঢ়ভাবেই তিনি। বললেন, আর একটু হলে তুমি প্রায় নরহত্যা করে ফেলতে হে! এ থেকে একটা শিক্ষা তোমার হোক। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার ইচ্ছেটা কখনো নিজের হাতে রেখ না।
জেমস ভেন বিড়বিড় করে বলল, আমাকে ক্ষমা করুন স্যার। আমি প্রতারিত হয়েছি। ওই নোংরা বস্তিতে হঠাৎ একটা নাম শুনে আমি ভুল করে ফেলেছি।
পেছন ফিরে এগোতে এগোতে ডোরিয়েন বললেন, বরং বাড়ি যাও। পিস্তুলটাকে সরিয়ে রাখা না হলে, বিপদে পড়তে পার।
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জেমস ভেন রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে রইল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঠকঠক করতে লাগল তারা একটা কালো ছায়া ভিজে দেওয়ালের পাশ দিয়ে খুঁড়ি দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে আসছিল এতক্ষণ। একটু পরেই সেই ছায়া আলোর সামনে বেরিয়ে এল তারপরে নিঃশব্দে সেটি কাছে এসে দাঁড়াল তার। একটি হাত তার হাতের ওপরে এসে পড়তেই চমকে উঠে সে পিছনে ফিরে তাকালা বার-এ যে সব মেয়েরা মদ খালি এটি সেই দলেরই।
তার সেই কদাকার মুখটা তার মুখের কাছে ধরে মেয়েটা ফিসফিস করে বলল, শয়তানটাকে তুমি খুন করলে না কেন? ড্যানির কাছে থেকে তুমি যখন ছুটে বেরিয়ে এলে তখনই আমি। জানতাম তুমি ওর পেছনে ছুটেছো। ওকে তোমার খুন করা উচিত ছিল। লোকটার অনেক টাকা রয়েছে, ব্যাটা একেবারে শয়তানের শিরোমণি।
জেমস বলল, আমি যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি এ সে-লোক নয়। আমি কারো টাকা চাই না। আমি একটি মানুষের জীবন চাই। যে-লোকটিকে আমি খুন করতে চাই তার বয়স এখন চল্লিশের কাছাকাছি হবে। এই লোকটির শিশুর চেয়ে বড়ো। ওর রক্ত যে আমার হাতে লাগেনি তার উল্যে ভগবানকে ধন্যবাদ।