ঘরের শেষে একটা ছোটো সিড়িঁ। সেই সিড়িঁ পেরিয়ে একটা অন্ধকার ঘর। সর-মর তিনটে সিঁড়ি ওঠার পরেই ডোরিয়েনের নাকে আফিঙের গন্ধ এসে লাগল। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন তিনি; আরামে তাঁর চোখ দুটি ফুলে উঠল। তিনি ঘরে ঢুকতেই একটি যুবক দ্বিধা-জড়িত কণ্ঠে তাঁর দিকে তাকাল।
ডোরিয়েন ফিল-ফিস করে বললেন: আদ্রিয়েন, তুমি এখানে?
উদাসীনভাবে উত্তর দিল আদ্রিয়েন: আর কোথায় যাব? কোনো লোকই আজ আর আমার সঙ্গে কথা বলবে না।
আমি ভেবেছিলেম ইংলন্ড ছেড়ে তুমি চলে গিয়ে।
ডারলিংটন কিছু করতে রাজি নয়। শেষকালে আমার ভাই টাকাটা মিটিয়ে দিয়েছে। জর্ড আমার সঙ্গে কথা বলে না; আমি গ্রাহ্য করিনে কিছু।
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার; বলল: যতক্ষণ মানুষের কাছে এই জিনিসটা থাকবে ততক্ষণ কোনো বন্ধুর দরকার তার নেই। আমার ধারণা, আমার বন্ধুর সংখ্যা অনেক।
ভ্রুকুটি করলেন ডোরিয়েন; ছেঁড়া মাদুরের ওপর অদ্ভুতভাবে যে সব কিম্ভুতকিমাকার বস্তুগুলি পড়ে রয়েছে সেগুলির দিকে তাকিয়ে দেখলেন। সেই বাঁকানো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, মুখব্যাদন, আর বিবর্ণ দৃষ্টিগুলি তাঁকে অভিভূত করে ফেলল। কী অদ্ভুত স্বর্গে তারা যন্ত্রণা ভোগ করছে তিনি তা জানতেন। কোন নরক যন্ত্রণা তাদের কাছে নতুন আনন্দের গোপন রহস্যের দ্বার খুলে দিয়েছে তা জানতে তাঁর অসুবিধে হয়নি। তাদের অবস্থা তাঁর চেয়ে অনেক ভালো। তিনি দুশ্চিন্তার কারাগারে বন্দি; ভয়ঙ্কর কোনো ব্যাধির মতো স্মৃতি তাঁর আত্মাকে কুরে কুরে খেয়ে শেষ করে ফেলছে। মাঝে-মাঝে তাঁর মনে হল বেসিল হলওয়ার্ডের চোখ দুটি যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তিনি স্পষ্টভাবে দেখতে পেলেন। তবু তাঁর মনে হল তিনি আর অপেক্ষা করতে পারেন না। আদ্রিয়েন সিঙ্গলটনের উপস্থিতি তাঁকে অস্থির করে তুলল। তিনি এমন একটা জায়গায় যেতে চান যেখানে কেউ তাঁকে চিনতে পারবে না। নিজের কাছ থেকেই তিনি পালিয়ে যেতে চান।
একটু থেমে তিনি বললেন: আমি অন্য ঘরে যাচ্ছি।
জেটির দিকে?
হ্যাঁ।
সেই পাগল বেড়ালটা নিশ্চয় ওখানে রয়েছে। এখন এখানে তারা আর তাকে রাখে না।
ডোরিয়েন অগ্রাহ্যভরে স্রাগ করলেন; বললেন; প্রেমিকাদের নিয়ে আমি অস্থির হয়ে উঠেছি। যে সব মেয়েরা অপরকে ঘৃণা করে তারাই সবচেয়ে উপাদেয়। তা ছাড়া, জিনিস হিসাবেও তারা উৎকৃষ্ট।
একই রকম।
ওদেরই আমি বেশি পছন্দ করি। এস; একটু ড্রিঙ্ক করে যাবে। আমারও কিছু চাই। যুবকটি বিড়বিড় করে বলল: না; আমার কিছু দরকার নেই।
ঠিক আছে। এস।
ক্লান্তভাবে আদ্রিয়েন সিঙ্গলটন উঠে দাঁড়াল; ‘বার’ পর্যন্ত ডোরিয়েন-এর পিছু পিছু গেল। ডো পাগড়ি আর ময়লা কোট পরে একজন বেয়ারা বিকৃত মুখে অভিনন্দন জানিয়ে এক বোতল ব্র্যান্ডি আর দুটো মগ তাদের সামনে রেখে দিল। মেয়েরা ভয়ে টলতে-টলতে সরে গিয়ে কিচির-মিচির করতে লাগল। ডোরিয়েন তাদের দিকে পেছন করে দাঁড়ালেন, আদ্রিয়েন সিঙ্গলটনকে ফিসফিস করে কী যেন বললেন।
মেয়েদের একটি মুখের ওপরে বাঁকা হাসি খেলে গেল। সে নাক বাঁকিয়ে ব্যঙ্গের ছলে বলল আজ আমাদের সৌভাগ্যের দিন।
মেঝের ওপরে পা ঠুকে চিৎকার করে উঠলেন ডোরিয়েন: ভগবানের দোহাই, আমাদের সঙ্গে কথা বলো না। কী চাই তোমাদের? টাকা? এই নাও। ভবিষ্যতে আর কখনো আমার সঙ্গে কথা বলো না।
মেয়েটির ভিজে চুপসানো চোখ দুটির ভেতর থেকে দুটো লাল ফুলকি চকচক করে উঠল। তারপরে যথারীতি সেগুলি মিলিয়ে গেল। মাথা ঝাঁকানি দিয়ে কাউন্টার থেকে সে লোলুপ ভাবে মুদ্রা দুটি প্রায় ছোঁ দিয়ে তুলে নিল। হিংসার চোখে তার বন্ধুরা ব্যাপারটা লক্ষ করল।
আদ্রিয়েন সিঙ্গলটন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল: কোনো লাভ নেই। আর আমি ফিরে যেতে চাইনে। আর ফিরে গিয়েই বা লাভ কী? আমি এখানে সুখেই রয়েছি।
একটু চুপ করে থেকে ডোরিয়েন বললেন, তোমার যদি কখনো কিছু দরকার হয় আমাকে তা ডানাবে তো? না কি?
সম্ভবত
তাহলে, এখন চলি।
শুকনো মুখ রুমাল দিয়ে মুছে চলে যেতে-যেতে সে বলল: শুভরাত্রি।
ডোরিয়েন দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর দৃষ্টির মধ্যে একটা যন্ত্রণার চিহ্ন ফুটে উঠেছে। পর্দাটা সরিয়ে দিতেই একটা মেয়ে বীভৎস গলায় হেসে উঠল। এটি সেই মেয়ে যে কাউন্টারের উপর থেকে টাকা নিয়ে গিয়েছিল।
মোটা গলায় সে চেঁচিয়ে বলল: শয়তানটা যাচ্ছে।
তিনি বললেন: তুমি গোল্লায় যাও। আমাকে ও নামে ডেকো না। মেয়েটা বাতাসে হাতের ঝাপটা দিয়ে বলল: তোমাকে প্রিন্স চার্মিং বলে ডাকতে হবে, তাই না?
একটা নাবিক ঝিমোচ্ছিল। এই কথা শুনে সে লাফিয়ে উঠে উত্তেজিতভাবে চারপাশে তাকাতে লাগল। দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার শব্দ তার কানে এল। সে দৌড়ে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে মনে হল, ডোরিয়েন-এর পিছু নিয়েছে সে।
পিটপিটে বৃষ্টির ভেতর দিয়ে ডোরিয়েন দ্রুত জাহাজঘাটার দিকে এগিয়ে গেলেন। আদ্রিয়েন-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ তাঁকে অদ্ভুতভাবে নাড়া দিয়েছে। তিনি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন বেসিল হলওয়ার্ড যে জন্যে তাঁকে অপমান করেছিলেন তা কি সত্যি? অর্থাৎ, আদ্রিয়েন-এর অধঃপতলের জন্যে কি তিনিই দায়ী? নিজের ঠোঁটটা কামড়ালেন তিনি; কয়েক মুহূর্তের জল্যে চোখ দুটো বুড়িয়ে দিলেন। কেমন যেন বিষণ বোধ করলেন তিনি। তবু, তাঁরই বা কি যায় আসে? অন্য লোকের ভ্রান্তির বোঝা নিজের ঘাড়ে নিয়ে বয়ে বেড়ানোর মতো সময় মানুষের কোথায়? প্রতিটি মানুষ নিজের জীবন নিয়েই বেঁচে থাকে, আর তার জন্যে তাকে যথেষ্ট খেসারৎ দিতে হয়। সবচেয়ে দুঃখের কথা হচ্ছে একই ভুলের জন্যে অনেকবার প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় মানুষকে অনেকবার নয; বার বার। মানুষের সঙ্গে হিসাব-নিকাশের খতিযান কোনোদিনই ভাগ্য শেষ করে দেয় না। মনস্তত্ত্ববিদদের মতে, জীবনে এমন সময়। আসে যখন পাপ, অথবা মানুষ যাকে পাপ বলে, করার প্রবৃত্তি মানুষকে এমনভাবে গ্রাস করে বসে, যে তার দেহের প্রতিটি স্নায়ু বা মাথার প্রতিটি কোষ একটা ভয়ঙ্কর উন্মাদনায় থরথর করে কাঁপে। সে-সময় মানুষ তার ইচ্ছার স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে। স্রোতের টানে অসহাযের মতো এগিয়ে যায় ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে। বিবেচনা করার শক্তি তখন তার থাকে না; নষ্ট হয়ে যায় বিবেক। অথবা, নষ্ট যদি নাই হয়ে থাকে তো বিদ্রোহ করাই তার আসল সৌন্দর্য। হয়ে দাঁড়ায় এবং অবাধ্যতাই হয়ে দাঁড়ায় তার আসল হাতিয়ার। সমস্ত ধর্মযাজকরা বারবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে আবাধ্যতাই হচ্ছে চরম পাপ। বিশ্বের প্রথম অমঙ্গলের প্রতীক শয়তানের যখন স্বর্গচ্যুতি ঘটেছিল তখন সে বিদ্রোহী হয়েই নেমে এসেছিল।