হলদে মড়ার মাথার মতো নীচ-আকাশে ঝুলে পড়তে চাঁদকে দেখা যাচ্ছে। মাঝে-মাঝে বিরাট বিকলাঙ্গ মেঘের কোনো হাতকে দেখা যাচ্ছে সেই চাঁদকে ঢেকে দিতে আলোর সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে, রাস্তাগুলি সরু আর অন্ধকারাচ্ছন্ন। একবার পথের নিশানা ভুল করায় আধ মাইল পিছিয়ে আসতে হল গাড়োয়ানকে। পাশের জানালার শার্সিগুলি ধূসর রঙের কুশায ভরে উঠেছিল।
“প্রবৃত্তি দিয়ে আত্মার পরিশোধন, আর আত্মার সাহায্যে প্রবৃত্তির বিশুদ্ধিকরণ!” কথাগুলি তাঁর কানের ভেতরে গুনগুন করতে লাগল। নিঃসন্দেহে তাঁর আত্মা ক্লান্তিতে জর্জরিত। সত্যিই প্রবৃত্তি তাঁর আত্মাকে বাঁচাতে পারবে? নিরপরাধ মানুষকে তিনি হত্যা করেছেন। এরই বা প্রায়শ্চিত্ত কী? হায়রে, কোনো প্রায়শ্চিত্তই এই পাপ থেকে তাঁকে রেহাই দিতে পারবে না। কিন্তু মা পাওয়ার যোগ্যতা তাঁর নেই, তবু এখনো তিনি সব কিছু ভুলে থাকতে পারেন। এবং সব কিছু ভুলে যেতে তিনি বদ্ধপরিকর; যে সাপ তাঁকে ছোবল দিয়েছে সেই সাপকে একেবারে পিষে মেরে ফেলতে তিনি পণ করেছেন। আর ওভাবে কথা বলার কী অধিকার ছিল বেসিলের? অন্য লোকের বিচার করার অধিকার কে তাঁকে দিয়েছিল? তিনি যে সব কথা বলেছিলেন সেগুলি যে কেবল ভয়ানক আর বিপজ্জনক তাই নয়; অসহ্য।
গাড়িটি গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে লাগল। তিনি বেশ বুঝতে পারলেন গাড়ির গতি বেশ শ্লথ হয়ে আসছে লোকটিকে তিনি তাড়াতাড়ি গাড়ি চালাতে বললেন। আফিঙের নেশায় অস্থির হয়ে উঠছিলেন তিনি। তাঁর গলা জ্বলতে লাগল, কাঁপতে লাগল হাতগুলি। হাতের ছড়ি দিয়ে। ঘোড়াগুলিকে উন্মাদের মতো তিনি পিটতে লাগলেন। গাড়োয়ান হেসে চাবুক কোল তাদের পিঠে। প্রত্যুত্তরে তিনি হেসে উঠলেন; লোকটি চুপ করে গেল।
পথের যেন আর শেষ নেই। মাকড়শার জালের মতো পথটা কেবল জট পাকিয়ে চলেছে। একঘেয়ে চলা আর তাঁর সহ্য হচ্ছিল না। কুয়াশা ঘন হয়ে এল। ভয় পেয়ে গেলেন তিনি।
নির্জন ইট-পাঁজার পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল গাড়ি। এখানে কুয়াশা পাতলা। বোতলের মতো গনগনে আগুনে চুল্লিগুলি এবার তিনি দেখতে পেলেন। বেশির ভাগ ডানালাই অন্ধকার; মাঝে-মাঝে কোনো ডানালার ভেতর থেকে অদ্ভুত-অদ্ভুত ছায়া দেখা গেল। একটা কুকুর চেঁচিয়ে উঠল; আর অনেক দূরে অন্ধকারে কোনো ভ্রাম্যমান শৃগালের চিৎকার শোনা গেল। একটা কুঁড়ের সামনে ধাক্কা খেয়ে বেঁকে আবার ছুটতে লাগল গাড়িটা।
একটা উন্মত্ত ক্রোধ তাঁর মনের মধ্যে দাপাদাপি করতে লাগল। একটা কোণে গাড়িটা এসে পৌঁছতেই একটা মেয়ে চিৎকার করে উঠল, সঙ্গে-সঙ্গে দুটো লোক প্রায় একশ গজের মতো তাদের পেছনে ছুটে এল। গাড়োয়ান তাদের পিঠে তার চাবুক বসিয়ে দিল।
শোনা যায় কামনা নাকি বৃত্তাকারে মানুষের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। ডোরিয়েন গ্রে-ও তা থেকে। অব্যাহতি পেলেন না। তাঁর মাথার একটি রন্ধ্র থেকে আর একটি রন্ধ্রে কেবল একটি চিন্তাই ঘুরে বেড়াতে লাগল। মানুষের সমস্ত আকাঙ্ক্ষার মধ্যে সবচেয়ে উন্মাদ আর বিপজ্জনক হচ্ছে বেঁচে থাকা। আকাঙ্খাই তাঁর প্রতি স্নায়ু আর তন্ত্রীকে উগ্র উত্তেজনায় কাঁপিয়ে তুলল। বাস্তব সত্য বলে একদিন কুৎসিত জিনিসকে তিনি ঘৃণা করতেন; আর ঠিক সেই কারণেই আজ কুৎসিত তার প্রিয়। চারুকলা আর সঙ্গ তের চেয়ে অপরিচ্ছন্ন সরাইখানা, ঘৃণ্য বস্তী, বিশৃঙ্খল জীবনের নগ্ন হট্টগোল, এমন কি চোর আর অসামাজিক মানুষের নোংরামিও অনেক বেশি বাস্তব। আর তিনি দিনের মধ্যে মুক্তি পাবেন তিনি।
একটি অন্ধ গলির মোড়ে এসে লোকটি ধাক্কা দিয়ে হঠাৎ গাড়িটা থামিয়ে দিল। নীচু ছাদ আর ঘরের চিমনির স্কুপের ওপরে জাহাড়ের কালো-কালো মাস্তুলগুলি দেখা যাচ্ছিল। উঠোনে সাদা কুয়াশার মালা ভুতুড়ে পালগুলির ওপরে ছড়িয়ে পড়েছিল।
লোকটি বলল: এই জায়গাটাই নয় স্যার?
চমকে উঠলেন ডোরিয়েন, মুখ বার করে চারপাশে তাকালেন।
ঠিক আছে।
এই বলে তিনি তাড়াতাড়ি নেমে পড়লেন; গাড়োয়ানকে কথামতো বাড়তি ভাড়া দিলেন; তারপরে জাহাজঘাটার দিকে দ্রুত এগিয়ে চললেন। এখানে-ওখানে বিরাট সওদাগরী জাহাজের গায়ে লাল লণ্ঠন জ্বলছিল।
বাঁ দিক ধরে তিনি দ্রুত হাঁটতে লাগলেন। কেউ তাঁকে অনুসরণ করছে কি না জানার জন্যে মাঝে-মাঝে পেছন ফিরে তাকালেন। সাত থেকে আট মিনিটের মধ্যে তিনি একটা নোংরা বাড়ির সামনে এসে হাজির হলেন। বাড়িটা দুটো বিরাট ফ্যাকটরির মাঝখানে।ওপরের একটা জানালায় একটা লণ্ঠন বসানো ছিল। তিনি থামলেন সেইখানে এবং বিশেষ রকম ধাক্কা। দিলেন দরজায।
কিছুক্ষণ পরে ভেতরে একজনের পায়ের শব্দ তাঁর কানে এল; শব্দ হল শেকল খোলার। নিঃশব্দে খুলে গেল দরজা। কোনো কথা না বলে তিনি সোজা ভেতরে ঢুকে গেলেন। লম্বা হল-এর শেষ প্রান্তে সুবজ রঙের একটা ছেঁড়া পর্দা ঝুলছিল। তিনি ঘরে ঢোকার ফলে রাস্ত থেকে যে একটা দমকা বাতাস ঘরের মধ্যে ঢুকে এসেছিল তারই ধাক্কায় পর্দাটা উড়তে লাগল। পর্দাটাকে একপাশে সরিয়ে তিনি একটা লম্বা নীচু ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন দেখলে মনে হবে ঘরটি একসময় এই তৃতীয় শ্রেণির নাচঘর ছিল। দেওয়ালের চারপাশে ছিল গ্যাস-ডেট আর বিবর্ণ আরশি। মেঝের ওপরে ছড়ানো ছিল করাত গুঁড়ো; এখানে-ওখানে কিছু মাটি, আর মদ ছড়ানোর দাগ। ছোটো ক্যুলার স্টোভের ধারে বসে কয়েকটি মালয় দেশের লোক বাজনা বাজাচ্ছিল–আর ক’জন সাদা দাঁত বার করে দিচ্ছিল তালা হাতের মধ্যে লুকিয়ে একজন নাবিক টেবিলের ওপরে ঝুঁকে বসেছিল আর একপাশ দিয়ে টানা ছিল নোংরা ‘বার’; সেইখানে দুটি শীর্ণ চেহারার মেয়ে একটি বুড়ো মানুষকে দেখে ঠাট্টা করছিল। ডোরিয়েন তাকে পেরিয়ে যেতেই লোকটি তাঁকে উদ্দেশ্য করে গজগজ করতে লাগল।