তুমি কি ক্লাবে গিয়েছিলে?
হ্যাঁ।
তারপরেই তিনি ঠোঁট কামড়ালেন: না; তা নয়। ক্লাবে আমি যাইনি, ঘুরে বেড়িয়েছি। কী করেছি তা আমার মনে নেই। সব জিনিসে তোমার এত আগ্রহ কেন হ্যারি? অন্য লোকে কী করে সব সময়েই তুমি তা জানতে চাও। আমি কী করছি তা আমি সব সময়েই ভুলে যেতে চাই। ঠিক কখন কাল রাত্রিতে আমি বাড়িতে ফিরেছি তা যদি তুমি জানতে চাও তাহলে বলব রাত্রি আড়াইটা। ‘ল্যাচ কী’-টা আমি বাড়িতে ফেলে এসেছিলাম; চাকরটা আমাকে দরজা খুলে দিয়েছিল। যদি প্রমাণ চাও-তার সঙ্গে কথা বলতে পারা।
কাঁধটা কোঁচকালের লর্ড হেনরি: না, না বন্ধ; তমি কখন ফিরছ তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। চল আমরা ড্রয়িংরুমে যাই। মিঃ চ্যাপম্যান, ধন্যবাদ; আর শ্যেরি ন্য। ডোরিয়েন, নিশ্চয় কিছু একটা তোমার হয়েছে। কী হয়েছে বল। আজ তোমার চালচলনটা ঠিক আগেকার তোমার মতো নয়।
ওসব ছেড়ে দাও, হ্যারি। আমার মেজাজটা আজ ভালো নেই; কেমন যেন চটে উঠছি। আমি কাল বা পরশু তোমার সঙ্গে দেখা করবা লেডি নরবোরোর কাছে আমার হয়ে তুমি তুমা। চেয়ে নিযো; ওপরে আর আমি যাচ্ছিনে। আমি বাড়ি যাব-বাড়ি আমাকে যেতেই হবে।
ঠিক আছে ডোরিয়েন; কাল চা খাওয়ার সময় নিশ্চয় তোমার সঙ্গে দেখা হচ্ছে। ডাচেসও আসছেন।
আসতে চেষ্টা করব হ্যারি।
এই বলেই ডোরিয়েন ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বাড়িতে ফেরার পথে তাঁর মনে হল যে ভীতিটার গলা টিপে হত্যা করেছিলেন বলে এতক্ষণ তিনি ভেবেছিলেন সেই ভীতিটা আবার তাঁর ফিরে এসেছে। কথায়-কথায় লর্ড হেনরি তাঁকে যে প্রশ্ন করেছিলেন তাতেই তাঁর স্নায়ুগুলি সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সেই স্নায়ুগুলিকে তাঁর ঠিক করতে হবে। ধ্বংস করতে হবে তাঁর কাছে যেগুলি বিপজ্জনক হতে পারে সেই জিনিসগুলি, ভ্রূকুটি করলেন তিনি। জিনিসগুলি সপর্শ করতেও তাঁর ঘৃণা বোধ হল।
তবু সে-কাজগুলি তাঁকে করতেই হবে। করতে যে হবে সেদিক থেকে তাঁর মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। লাইব্রেরিতে ঢুকে তিনি ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন; তারপরে একটা। গোপন ড্রয়ার খুললেন; এরই ভেতরে বেসিল হলওয়ার্ড-এর কোট আর ব্যাগটা তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন। ঘরের ভেতরে বিরাট একটা চুল্লিতে আগুন জ্বলছিল; আরো কয়েকটা কাঠের গুঁড়ি তিনি তার মধ্যে ফেলে দিলেন। পোড়া কাপড় আর চামড়ার উগ্র গন্ধে ঘর ভরে উঠল, সব কিছু পুড়িয়ে ফেলতে তিনি কোয়ার্টারের মতো সময় লাগল তাঁর। কেমন যেন অবশ হয়ে উঠলেন তিনি। কপালটা ভিজিয়ে নিলেন ঠান্ডা সুগন্ধী ভিনিগারে।
হঠাৎ তিনি চমকে উঠলেন; তাঁর চোখ দুটো অস্বাভাবিক ভাবে জ্বলজ্বল করতে লাগল; ভয়। পেযে নীচের ঠোঁটটা কামড়ালেন তিনি। দুটি দরজার মাঝখানে হাতির দাঁতের কাজ করা। আবলুস কাঠের তৈরি বিরাট একটা কেবিনেই ছিল। সেইটির দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে। রইলেন তিনি। জিনিসটা তাঁকে কেবল চমৎক্তই করেনি যথেষ্ট সন্ত্রস্তও করেছিল তাঁকে। আকর্ষণ আর ঘৃণা দুটিই তাঁকে অভিভূত করে ফেলেছিল। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের দ্রুততা বৃদ্ধি পেল তাঁরা একটা উন্মত্ত কামনা গ্রাস করে ফেলল তাঁকে। একটা সিগারেট ধরিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন তিনি। তাঁর চোখের পাতা এল নেমে। তবু তিনি কেবিনেটের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপরে সোফা থেকে উঠে তিনি সেটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। চাবিটি খুলে গোপন একটা বোতামে চাপ দিলেন। তিনকোনা একটা ড্রয়ার বেরিয়ে এল ধীরে-ধীরে, তাঁর আঙুলগুলি তার মধ্যে ঘুরে-ঘুরে একটা জিনিসের ওপরে গিয়ে পড়ল; কালো আর সোনালি গুঁড়ো মেশানো ল্যাকারের ছোটো একটা চিনে বাক্স। ডালাটা খুলতেই খানিকটা চটকটে সবুজ পদার্থ তাঁর নজরে পড়ল। গন্ধটাও তার বড়ো তীব্র।
মুখটা হাসিতে ভরে উঠল তাঁর। কয়েকটি মুহূর্ত দ্বিধা করলেন তিনি। ঘরের আবহাওয়া যথেষ্ট গরম হওয়া সত্ত্বেও তিনি কাঁপতে লাগলেন; তারপরে পিছিয়ে এসে ঘড়ির দিকে তাকালেন। বারোটা বাজতে কুড়ি মিনিট বাকি। বাক্সটা যথাস্থানে রেখে ড্রযারটি বন্ধ করে তিনি শোওয়ার ঘরে চলে এলেন।
ধোঁয়াটে আকাশে মধ্যরাত্রির সংকেত বেজে উঠতেই ডোরিয়েন গ্রে বেশ সাধারণ ভাবেই পোশাক পরলেন, গলায় জড়ালেন মাফলার; তারপরে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। বনড স্ট্রিটে গিয়ে একটা বেশ ভালো ঘোড়ার গাড়ি দেখতে পেলেন। তার ভেতরে উঠে নীচু গলায় বিশেষ একটা জাযগায় যাওয়ার জন্যে নির্দেশ দিলেন গাড়োয়ানকে।
গাড়োয়াল ঘাড় নেড়ে বলল: অনেক দূর স্যার।
ডোরিয়েন বললেন, একটা সোভারেন না। তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারলে আর একটা পাবে।
লোকটি বলল: আচ্ছা স্যার। একঘন্টার মধ্যে সেখানে পৌঁছে দেব আপনাকে।
.
ষোড়শ পরিচ্ছেদ
বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছিল; ঠান্ডা কনকনে বৃষ্টি। সেই ঝিরঝিরে ঝাপটায় রাস্তার আলোগুলি ভূতের মতো বিবর্ণ হয়ে উঠেছিল। বেশ্যাপাড়ায় লোকজন কমে এসেছিল; ভাঙা-ভাঙা দলে। তখনো কিছু বারবনিতাদের দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। কিছু কিছু সরাইখানা থেকে উঁচু হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। অন্য জায়গা থেকে ভেসে আসছিল মাতালদের ঝগড়া আর চিৎকার।
গাড়ির মধ্যে বসে মাথার টুপিটা কপালের ওপরে নামিয়ে ডোরিয়েন গ্রে উদাসীন দৃষ্টিতে সেই বিরাট শহরের নির্লজ্জ খেলা দেখছিলেন। প্রথম পরিচয়ের দিনে লর্ড হেনরি ‘প্রবৃত্তি দিয়ে আত্মার পরিশোধন, আর আত্মার সাহায্যে প্রবৃত্তির বিশুদ্ধিকরণের’ যে কথাটা তাঁকে বলেছিলেন সেই কথাগুলিই নিজের মনে-মনে বারবার তিনি উচ্চারণ করতে লাগলেন। হ্যাঁ, ওইটাই হল গোপন কথা; সেইভাবে চলতে এর আগেও তিনি অনেকবার চেষ্টা করেছেন। এখনো তাই করতে যাচ্ছেন। সেখানে আফিঙের আস্তানা রয়েছে, ওখালে মানুষে ভুলে থাকার ওষুধ কিনতে পায়। সেখানে পুরনো পাপের ভয়ঙ্কর স্মৃতির আস্তাবল রয়েছে, ওইখানে মানুষ। নতুন পাপের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে পুরনো পাপের কথা ভুলে যেতে পারে।