লর্ড হেনরি বললেন: সেকথা আমি ওকে অনেকবার বলেছি, লেডি নরবোরো।
বিয়ের যোগ্য পাত্রীদের একটা তালিকা আভই আমি তৈরি করে ফেলব।
তাদের বয়সসুদ্ধুও তো?-জিজ্ঞাসা করলেন ডোরিয়েন।
নিশ্চয়, নিশ্চয়। একটু রদবদল করে আর কী! কিন্তু তাড়াতাড়ি কিছু করব না। আমি চাই তোমরা দুজনেই সুখী হও।
লর্ড হেনরি বললেন: বিয়ে করে সুখ! কী আলতু-ফালতু কথাই না মানুষ বলে! পুরুষ যে-কোনো নারীকে নিয়েই সুখী হতে পারে যদি না সে তাকে ভালোবেসে ফেলে।
চেয়ারটাকে সরিয়ে লেডি রাক্সটনের দিকে চেয়ে লেডি নরবোরো বললেন: দেখেছ–একেবারে পাকা সিলিকা তোমাকে তাড়াতাড়ি আমার এখানে একদিন আসতেই হবে; আর ডিনার-ও খেতে হবে। টনিক হিসাবে সত্যিই তোমার তুলনা নেই স্যার অ্যানড্র আমাকে যে টনিক দেন তার চেয়েও অনেক বেশি উপাদেয়। সেদিন এখানে কার কার সঙ্গে তুমি দেখা করতে চাও তাও তুমি আমাকে বলবে কিন্তু। মজলিসটা জমজমাট হোক আমিও তাই চাই।
তিনি বললেন, আমি সেই সব পুরুষদের সঙ্গে আলাপ করতে চাই যাদের ভবিষৎ রয়েছে; আর আলাপ করতে চাই সেই সব মহিলাদের সঙ্গে যাদের রয়েছে অতীত; আপনার কি মনে হয়। এরকম মজলিস বেশ জমাটি হবে না?
দাঁড়িয়ে হাসতে-হাসতে লেডি নরবোরো বললেন: আমার তাই মনে হয়। ক্ষমা করবেন লেডি রাক্সটোন, আপনার যে এখনো সিগারেট খাওয়া শেষ হয়নি তা আমি বুঝতে পারিনি।
কিছু না, কিছুনা; লেডি নরবোরো, সিগারেটটা আমি খুব বেশি খাই। ভবিষ্যতে সিগারেট আমি কম খেতে মনস্থ করেছি।
লর্ড হেনরি বললেন: আমার অনুরোধ, লেডি রাক্সটোন, ও-কাজটি আপনি করবেন না। পরিমিত ব্যবহারের মতো জঘন্য, মারাত্মক জিনিস আর নেই। মিতাচার জিনিসটা হচ্ছে দৈনন্দিন খাওয়ার মতো খারাপ; অমিতাচার ভোজন-উৎসবের মতো উপাদেয়।
তাঁর দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে লেডি রাক্সটোন বললেন, লর্ড হেনরি, একদিন বিকালে আমার বাড়িতে এসে ব্যাপারটা আমাকে ভালো করে বুঝিয়ে দেবেন তো! আপনার মতবাদ বড়োই চমৎকার।
এইটুকু বলেই তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে লেডি নরবোরো বেশ চেঁচিয়েই বললেন: মনে রেখ তোমরা রাজনীতি আর কুৎসা নিয়ে বেশিক্ষণ মেতে থেক না থাকলে তোমাদের ভেতরে একটা হট্টগোল বেঁধে যাবে।
পুরুষ অতিথিরা হাসলেন। মিঃ চ্যাপম্যান গম্ভীরভাবে টেবিলের ধার থেকে উঠে সামনের দিকে এগিয়ে এলেন। ডোরিয়েন গ্রে স্থান পরিবর্তন করে লর্ড হেনরির পাশে এসে বসলেন। হাউস অফ কমনস-এর ঘটনা নিয়ে মিঃ চ্যাপম্যান বেশ জোর গলায় আলোচনা শুরু করলেন। তাঁর চিন্তাধারার মানমন্দিরের ওপরে তিনি ইউনিয়ন জ্যাক পতাকা উড়িয়ে দিলেন। ব্রিটিশ জাতির বংশগত মূর্খতাকে তিনি খুশ মেজাজে অভিজ্ঞ “ইংলিশ কমনসেন্স” বলে চিহ্নিত করলেন। তাঁর মতে সেইটাই হচ্ছে সমাজের আসল কাঠামো।
লর্ড হেনরির দুটি ঠোঁট হাসিতে বেঁকে উঠল; তিনি ঘুরে ডোরিয়েন-এর দিকে তাকালেন; জিজ্ঞাসা করলেন: শরীর ভালো তো? ডিনারের সময় তোমাকে যেন কেমন-কেমন দেখাচ্ছিল।
হ্যারি, না, আমি ভালোই আছি। আমি একটু ক্লান্ত–এই যা।
গতরাত্রিতে তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। ডাচেস তো তোমার ভক্ত হয়ে উঠেছেন। তিনি বলছিলেন একদিন তিনি তোমার সেলবি-র বাড়িতে হাজির হবেন।
কুড়ি তারিখে যাবে বলে তিনি আমাকে কথা দিয়েছেন।
মনমাউথও কি যাবে?
হ্যাঁ, নিশ্চয়-হ্যারি।
ওই মানুষটাকে আমার মোটেই ভালো লাগে না; যেমন ভালো লাগে না ডাচেসেরা মহিলা হিসাবে তিনি চতুর, অত্যন্ত চতুর। দুর্বলতার যে অদ্ভুত একটা সৌন্দর্য রয়েছে সেই দুর্বলতা তাঁর নেই। কাদার পা থাকার জন্যেই সোনার মূর্তির কদর। তাঁর পা দুটি সুন্দর; কিন্তু সেগুলি কাদার নয়। বরং সাদা পোরসিলিন-এর বলতে পার। অনেক আগুনের ওপর দিয়ে তাদের। হাঁটতে হয়েছে এবং আগুন যাকে পোড়াতে পারে না তাকে শক্ত করে দেয়। অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর।
ডোরিয়েন জিজ্ঞাসা করলেন: কতদিন তাঁর বিয়ে হয়েছে?
তাঁর মতে অনন্তকাল। আমার বিশ্বাস, তাঁর পিয়ারেজ পাওয়ার সময় থেকে যদি ধর তাহলে, বিয়ে হয়েছে তাঁদের বছর দশেক কিন্তু মনমাউথের সঙ্গে দশ বছর ঘর করা অনন্ত সময়েই সামিল। আর কারা আসছেন?
উইলোবায় দম্পতি, লর্ড রাগবি এবং তাঁর স্ত্রী, আমাদের লেডি নরবোরো, জিয়োফ্রি ক্লোসিটন, আর ওই জাতীয় মানুষ যাঁরা সাধারণত আমাদের পার্টিতে এসে থাকেন। লর্ড গ্রোসিযেনকে আমি আসতে বলেছি।
লর্ড হেনরি বললেন: ভদ্রলোকটিকে আমি পছন্দ করি। অনেকের তাঁকে ভালো লাগে না বটে; কিন্তু আমার তো মনে হয় ভদ্রলোক বেশ চমৎকার মানুষ। মাঝে-মাঝে তিনি পোশাকে নিজেকে ভারাক্রান্ত করে তোলেন; সেই পাপের সব সময় প্রায়শ্চিত্ত করেন বিদ্যার প্রাচুর্যে। আধুনিক বলতে যা বোঝা যায় তিনি তাই। তিনি আসতে পারবেন কিনা জানি নে, হ্যারি; তাঁর বাবার সঙ্গে হয়তো তাঁকে মন্টি কার্লোতে যেতে হবে।
হায়রে, মানুষের আত্মীয়স্বজনরা কী জঘন্য, ডোরিয়েন! তিনি যাতে সেদিন আসেন তার উল্যে চেষ্টা কর। আচ্ছা ডোরিয়েন, গতকাল রাত্রিতে তুমি তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিল, রাত্রি এগারোটা বাড়ার আগেই। তারপর কী করলে তুমি? সোডা বাড়ি গিয়েছিলে?
ডোরিয়েন তাঁর দিকে চকিতে একবার তাকিয়ে ভ্রু কুঞ্চিত করলেন; শেষকালে বললেন: না হ্যারি; রাত্রি প্রায় তিনটের আগে আমি বাড়িতে ঢুকিনি।