লেডি নরবোরো বললেন, ‘মনে হয় ছেলেটা প্রেমে পড়েছেপাছে আমি হিংসে করি এই জন্যে ওর প্রেমিকার নামটা আমাকে বলতে ভয় পাচ্ছে না বলে ভালোই করেছে। আমি হিংসাই করতাম।
হাসতে-হাসতে ডোরিয়েন বললেন: প্রিয় লেডি, গোটা একটা সপ্তাহ আমি কারো প্রেমে পড়িনি, বিশেষ করে মাদাম দ্য ফেরোল শহর ছাড়ার পর থেকে।
বৃদ্ধা একটু চেঁচিয়ে মন্তব্য করলেন: বুঝতে পারিনে ওই মহিলাটির সঙ্গে প্রেমে পড় কী করে?
লর্ড হেনরি বললেন: তার একমাত্র কারণ, আপনি যখন শিশু ছিলেন তখনকার কথা তাঁর মনে রয়েছে। আপনার ছোটো ফ্রক আর আমাদের মধ্যে তিনিই একমাত্র যোগসূত্র।
আমার ছোটো ফ্রকের কথা মোটেই তাঁর মনে নেই, লর্ড হেনরি কিন্তু তিরিশ বছর আগে। তাঁকে যে অবস্থায় আমি ভিয়েনাতে দেখেছিলাম সে-কথা আমার এখনো মনে রয়েছে। সেই সময় তিনি কাঁধ আর গলা খোলা জামা আর অস্বাভাবিক রকমের ছোটো স্কার্ট পরে ঘুরে বেড়াতেন।
তাঁর লম্বা আঙুলের ভেতরে একটা অলিভ ফুল ধরে তিনি বললেন: এখনো তিনি সেইভাবেই ঘুরে বেড়ান; যখন তিনি চৌকস গাউন পরে স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করেন তখন তাঁকে দেখলে মনে হবে একটা অখাদ্য ফরাসি উপন্যাসকে যেন মরক্কো চামড়া দিয়ে বাঁধাই করে রাখা হয়েছে। সত্যিই তিনি বড়ো অদ্ভুত; কখন যে তিনি কী ভাবে মানুষকে চমকে দেবেন সে-কথা কেউ জানে না। আত্নীয়স্বজনদের ভালোবাসতে তাঁর জোড়া আর নেই। তৃতীয় স্বামী মারা। যাওয়ার পরে শোকে-দুঃখে তাঁর মাথার চুলগুলি একেবারে রক্তবর্ণ ধারণ করল।
ডোরিয়েন চেঁচিয়ে বললেন: এসব কথা কী বলছ, হ্যারি?
লেডি নরবোরো হেসে বললেন, নিঃসন্দেহে খুব রোমান্টিক ব্যাখ্যা। কিন্তু তৃতীয় স্বামীর কথাটা কী বললেন, লর্ড হেনরি? ফেরোল কি তাহলে তার চতুর্থ স্বামী?
হ্যাঁ, লেডি-চতুর্থা
আপনার একটি কথাও আমি বিশ্বাস করিনে।
ঠিক আছে; মিঃ গ্রেকে জিজ্ঞাসা করুন। ও তাঁর একটি অন্তরঙ্গ বন্ধু।
মিঃ গ্রে, কথাটা কি সত্যি?
ডোরিয়েন বললেন; সেই কথাই তিনি আমাকে বলেছেন। মারগিরাইট দ্য নাভারার মতো তিনি মৃত স্বামীদের হৃদযগুলি সুগন্ধী পুষ্পধারে রেখে দিয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বললেন: না। কারণ হৃদয় বলে কোনো পদার্থ তাদের কারুরই ছিল না।
চার-চারটে স্বামী! তবে যে কোনো কাজ করার মতো দুর্দান্ত মানসিক অবস্থা তার রয়েছে। কিন্তু ফেরোল কেমন দেখতে? তার সঙ্গে তো আমার কোনো আলাপ নেই।
মদের পাত্রে চুমুক দিতে দিতে লর্ড হেনরি হেসে বললেন: সুন্দরী মহিলাদের স্বামীদের জাত একটাই–তারা হচ্ছে ক্রিমিন্যাল।
লেডি নরবোরো হাত-পাখার খোঁচা দিলেন তাঁকে বললেন: লর্ড হেনরি, বিশ্বের লোক যে আপনাকে প্যলা নম্বরের দুষ্টু বলে অভিহিত করে তাতে আমি মোটেই অবাক হইনে।
চোখ দুটো ওপরে তুলে জিজ্ঞাসা করলেন লর্ড হেনরি: কিন্তু কোন বিশ্বের লোকেরা বলে? নিশ্চয় অন্য বিশ্ব; কারণ এই বিশ্বের সঙ্গে আমার যথেষ্ট সৌহার্দ্য রয়েছে।
লেডি নরবোরো ঘাড় নেড়ে বললেন: উ। আমার সঙ্গে যাদের পরিয় রয়েছে তারা সবাই ওই কথা বলে।
কয়েক মুহূর্ত গম্ভীরভাবে থেকে লর্ড হেনরি বললেন; এইভাবে মানুষে যে আজকাল অপরের সম্বন্ধে নির্ভেজাল সত্যিকথাটা তাদের পেছনে বলে চলেছে তা সত্যিই বড়ো ভয়ঙ্কর।
চেয়ারে হেলান দিয়ে ডোরিয়েন বললেন: ওর সঙ্গে কথায় আপনি পারবেন না।
লেডি নরবোরো হেসে বললেন:আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু আপনারা সবাই যদি মাদাম দ্য ফেরোলের এইভাবে স্মৃতি করেন তাহলে বাজারে বিকোবার জন্যে দেখছি আমাকেও আবার বিয়ে করতে হবে।
লর্ড হেনরি বললেন: বিয়ে আর আপনি করবেন না। আপনি অনেক সুখী। কোনো মহিলা যখন দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন তখন ধরে নিতে হবে যে প্রথম স্বামীকে তিনি ঘৃণা করতেন। পুরুষ যখন দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন তখন বুঝতে হবে তিনি তাঁর স্ত্রীকে ভালোবাসতেন। মহিলারা ভাগ্যকে যাচাই করেন; পুরুষরা নেন ঝুঁকি।
বৃদ্ধাটি বললেন: নরবোরো খাঁটি ছিল না।
তিনি খাঁটি হলে আপনি তাঁকে ভালোবাসতে পারতেন না। খুঁত থাকে বলেই মহিলারা আমাদের ভালোবাসে। আমাদের দোষ যত বেশি থাকবে ততই মহিলারা আমাদের ক্ষমা করবে, এমন কি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি পর্যন্ত। এই কথা শোনার পরে ভবিষ্যতে নিশ্চয় আর আপনি আমাকে ডিনারে আসতে নিমন্ত্রণ করবেন না; কিন্তু কথাটা সত্যি।
আপনাদের ভালো না বাসত তাহলে আপনাদের অবস্থা কী হত? আপনাদের একজনেরই বিয়ে হত না। ঝাঁকে-ঝাঁকে আপনারা অবিবাহিত থেকে যেতেন। তাতে অবশ্য আপনাদের অবস্থার কোনো হেরফের হত না। আজকাল সব বিবাহিত পুরুষরাই অবিবাহিত পুরুষদের মতো দিন কাটায়; আর সব অবিবাহিত পুরুষরাই দিন কাটায় বিবাহিতদের মতো।
লর্ড হেনরি বললেন: একেই বলে জীবনের উচ্ছ্বাস।
লেডি নরবোরো বললেন: একেই বলে জীবনের পরিহাস।
ডোরিয়েন বললেন: জীবন একটা বিরাট ধোঁকা।
দস্তানাগলি হাতে পরে লেডি নরবোরো বললেন জীবনটা যে তোমার শেষ হয়ে গিয়েছে একথা নিশ্চয় তুমি আমাকে বলতে চাই না। মানুষ যখন তোমার মতো কথা বলে তখন মনে হয় সে বুঝতে পেরেছে যে তার জীবন, শেষ হয়ে এসেছে। লর্ড হেনরি দুষ্ট প্রকৃতির; মাঝে-মাঝে মনে হয় আমিও যদি ওই রকম হতাম। কিন্তু ভগবান তোমাকে সুন্দর করে সৃষ্টি। করেছেন–এত সুন্দর তুমি দেখতে তোমার জন্যে একটি সুন্দর পাত্রী খুঁজে দেব আমি। লর্ড হেনরি, আপনার কী মনে হয় মিঃ গ্রের বিয়ে করা উচিত নয়?