পার্টিটা খুব ছোটোই ছিল। লেডি নরবোরো খুব তাড়াতাড়িই আয়োজনটি করেছিলেন। অত্যন্ত চতুর ছিলেন লেডি নুরবোরো। লর্ড হেনরির ভাষায় এই জাতীয় মহিলারা হচ্ছেন সত্যিকার কুৎসিত আদর্শের উচ্ছিষ্ট ছাড়া আর কিছু নয়। ব্যবহারিক জীবনে একটি অসামাজিক রাষ্ট্রদূতের তিনি ছিলেন সুযোগ্য পত্নী। স্বামীর কবরের ওপরে তিনি একটি মর্মর সৌধ নির্মাণ করিয়েছিলেন; এই সৌধের পরিকল্পনা তাঁর নিজেরই। তাঁর মেয়েদের বিয়ে দিয়েছিলেন বস্তু ভদ্রলোকদের সঙ্গে। এইভাবে আদর্শ পত্নী আজ জননীর কর্তব্য শেষ করে। বর্তমানে তিনি সময় কাটান ফরাসি উপন্যাস পড়ে, ফরাসি রান্নার সরঞ্জাম নিয়ে, আর সুযোগ পেলে ফরাসি মদ্যপান করে।
তাঁর বিশেষ প্রিয় পাত্রদের মধ্যে ডোরিয়েন ছিলেন বিশেষতম এবং ভদ্রমহিলা তাঁকে সব সময়েই বলতেন যে যৌবনে যে তাঁদের পরিচয় হয়নি এতে তিনি খুবই খুশি হয়েছেন। তিনি বলতেন: আমি জানি, তোমার সঙ্গে দেখা হলে উন্মাদের মতো তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলতাম; আর তোমার জন্যে সব কিছু ছাড়তাম আমি। খুবই সৌভাগ্যের বিষয় যে তখন। তোমরা কথা আমার মনে হয়নি। আসল কথা হচ্ছে আমাদের যুগটা এতই অখাদ্য আর শাসন এতই কড়া ছিল যে কারো সঙ্গে যে একটু প্রেম করব সে-সুযোগও আসেনি আমার। অবশ্য সবটাই রবোরোর দোষ। তার দৃষ্টির প্রসারতা ছিল না; আর যে স্বামী কিছুই দেখে না তাকে বিয়ে করার মধ্যে কোনো আনন্দ নেই।
সেদিন সন্ধ্যায় তাঁর বাড়িতে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের কেউ প্রায় প্রাণ খুলে আসর জমাতে পারেননি। এর কারণটা নোংরা ফ্যান-এর আড়ালে তিনি অবশ্য ডোরিয়েনকে বলেছিলেন। কারণটা হচ্ছে সেদিনই তাঁর একটি বিবাহিতা কন্যা হঠাৎ তাঁর বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে তার চেয়েও খারাপ ব্যাপারটা হচ্ছে সেই কন্যাটি তার স্বামীটিকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছে।
ঠিক এই সময় মেয়েটার এখানে আসাটা ঠিক হয়নি, বুঝতে পারছি; অবশ্য আমি হামবার্গ থেকে ফিরে প্রতিটি গ্রীষ্মে ওদের বাড়িতে গিয়ে ক’টা দিন কাটিযে আসি; কিন্তু আমার মতো বৃদ্ধা মহিলার মাঝে-মাঝে ফাঁকায় থাকাটা দরকার; আর তা ছাড়া, আমি তাদের কিছুটা চাঙ্গা করে তুলি। ওরা যে কী ভাবে দিন কাটায তা তুমি জান না। যাকে বলে একেবারে নির্ভেজাল গ্রাম্য জীবন। সংসারে অনেক কাডই ওদের করতে হয়; তাই ওরা খুব সকালে উঠে পড়ে; গভীর কিছু চিন্তা করার ক্ষমতা ওদের নেই। তাই ওরা সন্ধে-সন্ধে ঘুমিয়ে পড়ে। রানি। এলিজাবেথের সময় থেকে ও অঞ্চলে কারো কোনো কলঙ্ক রটনি; ফলে ডিনার খেয়েই সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। ওদের কারো পাশেই তোমার বসার দরকার নেই; তুমি বসবে আমার পাশে, আনন্দ দেবে আমাকে।
একটু হেসে ডোরিয়েন তাঁর বদান্যতার স্বীকৃতি জানালেন, তারপরে, ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, ভদ্রমহিলা সত্যি কথাই বলেছেন। আসরটা মোটেই জমাট বাঁধেনি। আগন্তকদের মধ্যে দুজন তাঁর অপরিচিত, অন্যান্যদের মধ্যে রয়েছে আর্নেস্ট হ্যাঁরোডেন; মধ্যবয়সী অতি সাধারণ মানুষ; লন্ডনের ক্লাবগুলিতে এই জাতীয় নিরপরাধ শান্তশিষ্ট অনেক গোবেচারা দেখা যায়, এরা হল অজাতশত্রু; কিন্তু এদের বন্ধুরা মোটেই এদের পছন্দ করে না। আর। রয়েছেন অনাবশ্যক বেশভূষায শরীর-ঢাকা সাতচল্লিশ বছর বয়সের লেডি রাক্সটন, সুচোল। নাক; অন্য লোকে যা বলে সব সময়েই তিনি তা মেনে নেন; কোনো প্রতিবাদ করেন না। কিন্তু এত সাদাসিধে যে তাঁর বিরুদ্ধে কারও কোনো অভিযোগ নেই, থাকলে যেন তিনি একটু খুশিই হতেন। আর আছেন মিসেস আরলিন, মিষ্টি ঠোঁট আর ভেনিস দেশের মতো লাল তাঁর। চুলের গোছা। রয়েছেন লেডি অ্যালিস চ্যাপম্যান। ইনি হচ্ছেন লেডি নরবোরোর কন্যা। চেহারা কদাকার, বোকা-বোকা মুখের আদল; ব্রিটেনের জাতীয় বৈশিষ্ট্য তাঁর মুখ–এ মুখ একবার দেখার পরে আর কারও মনে থাকে না। রয়েছেন তাঁর স্বামী, গন দুটি লাল, সাদা। গোঁফ ডোড়া, আচারে-ব্যবহারে তাঁরই সমগোত্রীয়দের মতো। তাঁর ধারণা অনাবশ্যক উজ্জ্বলতা উঁচু আদর্শের পরিপন্থী।
এইরকম একটি ভোজে আসার জন্যে ডোরিয়েন-এর আপসোস হল। লেডি নরবোরো শেলফ-এর ওপরে ঝোলানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বেশ চেঁচিয়েই বললে: কী আশ্চর্য! হেনরির এত দেরি হচ্ছে কেন? আজ সকালে সে আসবেই।
সান্ত্বনার কথা এই যে হেনরির আসার কথা রয়েছে। তারপর দরজা খোলার সঙ্গে-সঙ্গে যখন মিথ্যা অড়হাতের সঙ্গে তাঁর মিষ্টি গলার স্বর শোনা গেল তখনই ডোরিয়েন-এর মন থেকে অবসাদ কেটে গেল; তিনি কিছুটা চাঙ্গা হয়ে উঠলেন।
কিন্তু ডিনারের সময় কিছুই খেতে পারলেন না তিনি। প্লেটের পর প্লেট নিয়ে ফিরে চলে গেল বেয়ারা। লেডি নরবোরো মৃদু ধমক দিলেন তাঁকে বললেন: বেচারা অ্যাডোলফকে তুমি অপমান করছ ডোরি মি যা ভালোবাস সেই খাবারই বেচ্ছেবেছে ও রান্না করেছে।
লর্ড হেনরিও মাঝে-মাঝে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ ভাব আর বিভ্রান্ত দৃষ্টি দেখে কেমন যেন অবাক হয়ে গেলেন। মাঝে-মাঝে বাটলার খালি গ্রাসে শ্যাম্পেন ঢেলে দিতে লাগল। সেইটাই তিনি আগ্রহের সঙ্গে খেতে লাগলেন; তৃষ্ণা যেন বাড়তে লাগল তাঁরা।
শেষ পর্যন্ত লর্ড হেনরি প্রশ্ন না করে পারলেন নাঃ কী ব্যাপার বল তো ডোরিয়েন; আজ যেন কেমন-কেমন দেখাচ্ছে তোমাকে।