হ্যাঁ হ্যাঁ; হার্ডেন। তুমি এখনই রিচমনড-এ যাও; হার্ডেন-এর সঙ্গে দেখা করো; তাকে বলবে আমি যে ক’টা অরকিড পাঠাতে বলেছি তার যেন দ্বিগুণ পাঠায়; সাদা অরকিড যত কম হয় ততই ভালো-অন্তত, যতগুলি সম্ভব। সত্যি কথা বলতে কি, সাদা অরকিড আমি চাই নে! দিনটা বড়ো সুন্দর ফ্রান্সিস; রিচমনড জায়গাটাও ভারী চমৎকার। তা না হলে আমি তোমাকে কষ্ট করে যেতে বলতাম না।
না, না। আমার কোনো কষ্ট হবে না স্যার। কখন আমি ফিরব?
ক্যাম্পবেল-এর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ডোরিয়েন: পরীষ্কাটা শেষ করতে তোমার কত সময় লাগবে ক্যাম্পবেল?
স্বর তাঁর শান্ত, উদাসীন। ঘরের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি তাঁকে অদ্ভুত রকমের সাহসী করে তুলেছিল।
ভ্রূ কোঁচকালেন ক্যাম্পবেল; একটা ঠোঁট কামড়ালেন, বললেন: ঘণ্টা পাঁচেক।
সাড়ে সাতটার কাছাকাছি তোমার ফিরে এলেই চলবে, ফ্রান্সিস। কিম্বা দাঁড়াও আমার । জিনিসপত্র তুমি টেবিলের ওপরেই সাজিয়ে রেখে দাও। আজ তোমার ছুটি। আজ রাত্রিতে আমি বাড়িতে খাচ্ছি নে। তোমাকে আজ আর কোনো দরকার হবে না।
ধন্যবাদ, স্যার-ঘর থেকে বেরিয়ে গেল লোকটি।
অ্যালেন, একটি মুহূর্তও নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই। বাক্সটা তো বেশ ভারী দেখছি। আমিই বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। অন্য জিনিসগুলি তুমি নিয়ে এস।
নির্দেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে তাড়াতাড়ি কথাগুলি বললেন তিনি। প্রতিবাদ করার মতো শক্তি ছিল না ক্যাম্পবেল-এর। তাঁরা দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ওপরের সিঁড়িতে এসে ডোরিয়েন চাবি বার করে তালা খুললেন; একটু থামলেন; একটা বিষণ্ণ দৃষ্টি তাঁর চোখের মধ্যে ফুটে বেরোল। কেঁপে উঠলেন তিনি; বিড়বিড় করে বললেন; অ্যালেন, ভেতরে ঢুকতে বড়ো অস্বস্তি লাগছে আমার।
ক্যাম্পবেল বেশ নীরস ভাবেই বললেন: আমার কাছে ব্যাপারটা কিছুই নয়। তোমাকে আমার কোনো প্রয়োজন নেই।
দরজা অর্ধেকটা ফাঁক করলেন ডোরিয়েন; খোলার সময় প্রতিকৃতিটা চোখে পড়ল তাঁর। সূর্যের আলোতে সেটা আড়চোখে তাকিয়ে ছিল তারই সামনে মেঝের ওপরে পড়ে ছিল। ডো পর্দাটা। তাঁর মনে পড়ল আগের রাত্রিতে তিনি সেই বিপজ্জনক ছবিটাকে ঢাকতে ভুলে গিয়েছিলেন; জীবনে সেই তাঁর প্রথম ভুল। দৌড়ে তিনি ভেতরে ঢুকতে গেলেন; কিন্তু তারপরেই ভয় পেয়ে তিনি থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন।
ছবিটার হাতের ওপরে নোংরা লাল ফোঁটার মতো কী ওটা রোদে চকচক করছে? মনে হচ্ছে। তার হাতের ঘাম যেন রক্ত হয়ে ঝরে পড়ছে। কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য! ওই যেন মূর্তিটি টেবিলের ওপর আড় হয়ে পড় রয়েছে এবং কার্পেটের ওপরে যার ছায়া দেখে মনে হচ্ছে সে একটুও নড়েনি, কিন্তু সেই একইভাবে পড়ে রয়েছে তার চেয়ে ভয়ানক।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি, দরজাটা একটু ফাঁক করলেন, তারপরে মৃতদেহটির দিকে আদৌ তাকাবেন না এই রকম একটা দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে তিনি দৌড়ে ভেতরে ঢুকে নীচু হয়ে পর্দাটা তুলে ছবিটাকে ঢেকে দিলেন।
তারপরেই তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়লেন, ঘুরে দাঁড়াতেই ভয় হল তাঁর। শব্দ শুনে তিনি বুঝতে পারলেন, ক্যাম্পবেল সেই ভয়ঙ্কর কাজটি শুরু করার জন্যে তাঁর জিনিসপত্রগুলি গোছাচ্ছেন। তিনি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন কোনোদিন কি সত্যি-সত্যিই তাঁর সঙ্গে বেসিল হলওয়ার্ড-এর দেখা হয়েছিল; হয়ে থাকলে, পরস্পরের সম্বন্ধে দুডনের কী ধারণা জন্মেছিল?
তাঁর পেছন থেকে একটা কর্কশ স্বর শোনা গেল: তুমি এখানে থেকে চলে যাও।
ডোরিয়েন ঘুরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন। বেরিয়ে আসার সময় তিনি বুঝতে পারলেন ভেতর থেকে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
সাতটার অনেক পরে ক্যাম্পবেল লাইব্রেরিতে নেমে এলেন। তাঁর মুখ বিবর্ণ কিন্তু একেবারে শান্ত তিনি কোনোরকম উত্তেজনা দেখা গেল না তাঁর ভেতরে।
তিনি বিড়বিড় করে বললেন: আমাকে যা করতে বলেছিলে সে-কাজ আমি শেষ করছি। বিদায়। আর যেন কোনোদিন আমাদের দেখা না হয়।
ডোরিয়েন কেবল বললেন: ধ্বংসের হাত থেকে আমাকে তুমি বাঁচিযেছে, অ্যালেন। একথা আমি ভুলতে পারিনে।
ক্যাম্ববেল চলে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই তিনি ওপরে উঠে গেলেন। ঘরের মধ্যে নাইট্রিক অ্যাসিডের ভয়ানক রকমের একটা উগ্র গন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু যে জিনিসটা টেবিলের ধারে এতক্ষণ বসেছিল সেটি আর নেই।
৪. লেডি নরবোরোর বাড়িতে
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
সেই দিনই রাত্রি প্রায় সাড়ে আটটার সময় অপরূপ সুন্দর পোশাকে সেজে আর কয়েকটি “পারমা” ভায়লেট ফুল কোটের বুকে স্টুডে ডোরিয়েন গ্রে লেডি নরবোরোর বাড়িতে এসে হাজির হলেন; ভদ্রমহিলার চাকররা সসম্ভ্রমে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাঁকে তাঁর বসার ঘরে নিয়ে গেল। তাঁর কপালের শিরাগুলি তখন ধকধক করছে; একটা ভীষণ উত্তেজনা বুকের মধ্যে নাচানাচি করছে; কিন্তু তা সত্ত্বেও যখন তিনি গৃহস্বামিনীর হাতটি চুম্বন করার জন্য ঝুঁকে পড়লেন তখন মনে হল সেই চিরাচরিত, সুন্দর, নিষ্পাপ ডোরিয়েন গ্রে ছাড়া আর তিনি নন। সম্ভবত, কোনো অভিনেতাই অভিনয় করার সময় এতটা সাবলীল হতে পারেন না। সেদিন রাত্রিতে কেউ যদি ডোরিয়েন গ্রেকে ভালোভাবে লক্ষ করতে তাহলে সে কিছুতেই বুঝতে পারত না যে তাঁর জীবনে কিছুক্ষণ আগেই এমন একটি ভয়ঙ্কর ট্র্যাজিডি নেমে। এসেছে যাকে আমাদের আধুনিক যুগের যে কোনো ট্র্যাজিডির সঙ্গেই তুলনা করা যায়। ওই সুন্দর আঙুলগুলি পাপ কাজ করার জন্যে কখনো ছুরি ধরতে পারে, অথবা ওই সুস্মিত ঠোঁট দুটি কখনো ভগবানের বিরুদ্ধে, সত্যের বিরুদ্ধে ডেহাদ ঘোষণা করতে পারে একথা কেউ বিশ্বাস করতে চাইত না। নিজের শান্ত ভাব দেখে তিনি নিজেই কেমন যেন বিস্মিত হয়ে গেলে এবং এই দ্বৈত জীবনের জন্যে মুহূর্তের জন্যে তিনি যে একটা নির্মম আনন্দও পেলেন না সেকথাও সত্যি নয়।