আপনাকে বলব কি না সে কথা জানি না, মিঃ গ্রে। জিনিসটা এতই বিরক্তিকর যে ব্যাপারটা নিয়ে মনোযাগ দিয়ে আলোচনা করা উচিত। কিন্তু বর্তমানে আমি পালিয়ে যাচ্ছি না, বিশেষ করে আপনি যখন থাকতে বললেন। বেসিল, আমি থাকলে নিশ্চয় তোমার কোনো অসুবিধা হবে না। হবে কি? তুমি আমাকে প্রায়ই বল যে ছবি আঁকার সময় তৃতীয় কেউ তোমার মডেলের সঙ্গে বসে গল্প করলে তোমার কাজের সুবিধা হয়।
হলওয়ার্ড ঠোঁট কামড়ালেন, বললেন, অবশ্য ডোরিয়েনের ইচ্ছে নিশ্চয় তুমি থাকবে। ডোরিয়েনের খেয়াল তার নিজের কাছে ছাড়া অন্য সকলের কাছেই আইন।
লর্ড হেনরি তাঁর টুপি আর দস্তানা তুলে নিয়ে বললেন, তোমার অনুরোধ অগ্রাহ্য করা কষ্টকর, বেসিল, কিন্তু আমাকে যেতেই হবে। অরলিনস-এ একজনের সঙ্গে দেখা করার কথা দিয়েছি আমি। মিঃ গ্রে, বিদায়। একদিন বিকেলে কাউন স্ট্রিটে আমার কাছে আসুন। পাঁচটার কাছাকাছি প্রতিদিনই আমি প্রায় বাড়িতে থাকি। কবে আসছেন আমাকে লিখে জানাবেন। আপনার সঙ্গে দেখা না হলে দুঃখ পাব।
ডোরিয়েন গ্রে বেশ জোর গলাতেই বললেন, বেসিল, লর্ড হেনরি যদি চলে যান আমিও তাহলে চলে যাব। ছবি আঁকার সময় একবারও তুমি মুখ খোল না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে খুশি হওয়ার ভান করাটা আমার পক্ষে সত্যিই বড়ো কষ্টকর। ওঁকে থাকতে বল। আমি চাই উনি থাকুন।
ছবির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে হলওয়ার্ড বললেন, ডোরিয়েন আর সেই সঙ্গে আমাকে খুশি করার জন্য তুমি থেকে যাও হেনরি। কথাটা সত্যি যে কাজ করার সময় আমি কারো সঙ্গে কথাও বলি না, কারো কথা কানেও তুলি না। আমার মডেলদের কাছে সেটা সত্যিকারের কষ্টকরই হয়ে দাঁড়ায়। আমি অনুরোধ করছি-তুমি থেকে যাও।
কিন্তু অরলিনস-এ যাঁর সঙ্গে আমার দেখা করার কথা আছে তাঁর কী হবে?
চিত্রকর হাসলেন, বললেন আমি মনে করি না তার জন্যে তোমার কোনো অসুবিধা হবে। হেনরি, তুমি আবার বসে পড। ডোরিয়েন, এখন তুমি প্ল্যাটফর্মের ওপরে ওঠো, বেশি নড়াচড়া করো না, অথবা লর্ড হেনরির কথাতেও কান দিও না বিশেষ। একমাত্র আমি ছাড়া, সমস্ত বন্ধুবান্ধবদের ওপরেই ওর প্রভাবটা বড়ো খারাপ।
ডোরিয়েন গ্রে প্ল্যাটফর্মের ওপরে উঠে এলেন, দেখে মনে হল তিনি একজন গ্রিক যুবক, আদর্শের জন্যে জীবন উৎসর্গ করেছেন। লর্ড হেনরিকে তাঁর কেমন যেন ভালো লেগেছিল, তিনি মোটেই বেসিলের মতো নন। দুজনের মধ্যে পার্থক্যটা বড়ো মধুর। তাছাড়া, হেনরির স্বরটি কী মধুর! কিছুক্ষণ পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, লর্ড হেনরি, সত্যিই কি আপনার প্রভাব খারাপ?
সৎ প্রভাব বলে কিছু নেই, মিঃ গ্রে। সব প্রভাবই দুনীর্তির বাহক, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে দুর্নীতিমূলক।
কেন?
কারণ, কারো ওপরে প্রভাব বিস্তার করতে গেলে নিজের আত্মাকে বিসর্জন দিতে হয়। তার। স্বাভাবিক চিন্তা আর অনুভূতিকে বর্জন করতে হবে। তার নিজের গুণগুলি তার কাছে। বাস্তব নয়। তার পাপ, যদি পাপ বলে কোনো বস্তু থেকে থাকে, অপরের কাছ থেকে ধার করা। সে অন্য লোকের সঙ্গীতের প্রতিধ্বনি; যে-নাটক তার জন্যে লেখা হয়নি সেই নাটকেরই অভিনয়। করার জন্যে তার ডাক পড়ে। জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে নিজেকে বিকাশ করা। নিজের স্বভাবটিকে সম্পূর্ণরূপে বোঝা, অর্থাৎ কেন আমরা পৃথিবীতে এসেছি সেটা বুঝতে পারা। আজকাল মানুষ নিজেদেরই বড়ো ভয় করে। মানুষ ভুলে যায় নিজের ওপরে তার একটা কর্তব্য রয়েছে, আর সেইটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড়ো কর্তব্য। অবশ্য তারা উদার প্রকৃতির। ক্ষুধার্তকে তারা অন্ন দেয়, দরিদ্রকে দেয় বস্ত্র। কিন্তু তাদের নিজেদের আত্মা থাকে অভুক্ত, উলঙ্গ। মনুষ্যডাতির কথা যদি। ধরেন, তাহলে বলতে হবে আমাদের মধ্যে শৌর্য বলে কোনো পদার্থ লেই। সম্ভবত, কোনোদিনই আমাদের ও-জিনিসটা ছিল না। আমাদের শাসন করছে দুটি জিনিস, একটি হল সামাজিক ভীতি–ওটি হল নীতির গোড়ার কথা, আর একটি হল ভগবানের ভ্য, এইটি হল ধর্মের মূল কথা। এবং তবু–
গভীর ভাবে কাজের মধ্যে ডুবে ছিলেন চিত্রকর। তাঁর মনে হল গ্রে-র মুখের ওপরে এমন একটি ভাব প্রতিফলিত হয়েছে যা তিনি আগে কখনো দেখেননি, তিনি বললেন, ডোরিয়েন, লহী ছেলের মতো ডান দিকে ঘাড়টা একটু বাঁকাও।
আস্তে আস্তে মিষ্টি গলায় এবং হাতটিকে অর্ধবৃত্তাকারে সুন্দরভাবে ঘুরিয়ে (ইটনে পড়ার সময় এইভাবে তিনি কথা বলতেন) লর্ড হেনরি তাঁর কথার সূত্র ধরে বললেন, কিন্তু তবু আমি বিশ্বাস করি যদি মানুষকে পরিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকতে হয়, যদি তাকে প্রতিটি অনুভূতি ভালোভাবে প্রকাশ করতে হয়, যদি তার প্রতিটি চিন্তা আর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করতে হয় তাহলে দুনিয়াটা আনন্দের এমন একটা সজীব উচ্ছ্বাসে ভেসে যাবে যে আমরা মধ্যযুগের সমস্ত রোগ থেকে মুক্তি পাব, ফিরে আসব ‘হেলেনিক’ আদর্শেতার চেয়েও সুন্দর, পবিত্র একটি আবহাওয়ায় প্রাণ ভরে বিশ্বাস নিতে পারব আমরা। কিন্তু আমাদের ভেতরে সে। সবচেয়ে বেশি সাহসী সে-ও তার নিজেকে বুড়ো ভয় করে।বর্বরতার অত্যাচার মানুষের আত্মত্যাগের মূর্তিতে তার বিষণ্ণ স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই অকারণ আত্মত্যাগই আমাদের জীবনের সুখ-সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয়। ত্যাগের জন্যই আমরা শাস্তি পাই। যে সব প্রবৃত্তিকে আমরা গলা টিপে হত্যা করি, সেই সব রুদ্ধ প্রবৃত্তিই আমাদের মনের মধ্যে বংশ বৃদ্ধি করে, বিষাক্ত করে আমাদের দেহ পাপ করে একবারই, দু’বার নয়, আর আমাদের কর্ম পবিত্র করে তাকে। তারপরে একমাত্র আনন্দের কিছু স্মৃতি, অথবা অনুতাপের বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। প্রলোভন এড়ানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে প্রলোভনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা। বাধা পাও, না পাওয়ার আকঙহষ্কায় তোমার আত্মা রুগ্ন হয়ে যাবে, যে বাসনাকে ভয়কর নীতিগুলো ভয়ঙ্কর বলে চিহ্নিত করেছে, প্রচার করেছে দুর্নীতি বলে, সেই বাসনার উন্মাদনায় তুমি জ্বলে পুড়ে মরবে। মানুষের বলে বিশ্বের বিরাট বিরাট ঘটনার জন্ম মানুষের মস্তিষ্কে। এই মস্তিষ্কের ভেতরই পৃথিবীর সবচেয়ে বিরাট পাপ অঙ্কুরিত হয়। আপনি, মিঃ গ্রে, নিজের কথাই ধরুন, আপনার এই গোলাপি যৌবন আর গোলাপ-সাদা। তারুণ্যের ভেতরে এমন সব আকাঙ্খা অঙ্কুরিত রয়েছে যাদের কথা ভাবতেই আপনার ভয় লাগে, জেগে জেগে অথবা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এমন সব স্বপ্ন আপনি দেখেন যাদের স্মৃতিগুলি আপনার মুখে লজ্জার আভা ছড়িয়ে দেয়।