চিঠিটা ঠেলে দিয়ে উঠে পড়ে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি।
তাঁর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন ক্যাম্পবেল; তারপরে কাগজটা টেনে নিয়ে পড়লেন, পড়তে-পড়তে তাঁর মুখটা বিবর্ণ হয়ে উঠল; তিনি চেয়ারের ওপরে বসে পড়লেন। একটা ভয়াবহ অস্থিরতা গ্রাস করে ফেলল তাঁকে। মনে হল, একটা শূন্য গুহার দেওয়ালে তাঁর হৃৎপিণ্ডটা যেন অনবরত মাথা ঠুকে চলেছে।
দু’তিন মিনিটের মতো একটা ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা নেমে এল। তারপরে, ডোরিয়েন ঘুরে দাঁড়ালেন, ক্যাম্ববেলের পেছনে এসে তাঁর কাঁধে হাত রাখলেন।
আস্তে-আস্তে বললেন ডোরিয়েন তোমার জন্যে আমি দুঃখিত, অ্যালেন, কিন্তু এছাড়া অন্য কোনো পথআমার জন্যে তুমি খোলা রাখনি। আমি আগেই চিঠি লিখে রেখেছি। এই দেখ, কোথায় পাঠানোর কথা তাও তুমি দেখতে পাচ্ছ। যদি তুমি আমাকে সাহায্য না কর তাহলে এ চিঠি আমি যথাস্থানেই পাঠিয়ে দেব। এর ফল কী হবে তা তুমি জান। কিন্তু তুমি আমাকে সাহায্য করবে; বর্তমান পরিস্থিতিতে সাহায্য না করাটা তোমার পক্ষে একেবারে অসম্ভব। তুমি নিশ্চয় স্বীকার করবে যে তোমাকে আমি বাঁচতেই চেয়েছিলেম। কিন্তু আমার সঙ্গে ত্ব অত্যন্ত বুঢ় ব্যবহার করেছ। তুমি আমাকে যেভাবে অপমান করেছ ঠিক সেই ভাবে অপমান করার দুঃসাহস আজ পর্যন্ত কোনো জীবন্ত মানুষের হয়নি। আমি সব সহ্য করেছি। এখন বদলা নেওয়ার পালা আমার।
দু’হাতের মধ্যে মুখটাকে লুকিয়ে ফেললেন ক্যাম্পবেল; তাঁর শরীরটা কাঁপতে লাগল।
হ্যাঁ, অ্যালেন, এখন তুমি আমার হাতের মুঠোয়। তোমাকে কী করতে হবে তা তুমি জান। কাজটা খুব সহজ এস; অনর্থক উত্তেজিত হযো না. দুর্বল করে ফেল না। নিজেকে। কাজটা করতেই হবে। সুতরাং আর দেরি করো না।
ক্যাম্পবেলের ঠোঁটের ভেতর দিয়ে একটা মৃদু গোঙানি বেরিয়ে এল। সারা শরীরটা তাঁর কেঁপে কেঁপে উঠল। সেলফ-এর ওপরে ঘড়ির টিকটিক শব্দ মনে হল সময়টাকে যেন অসংখ্য টুকরো-টুকরো যন্ত্রণার অণুতে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলছে। সেই যন্ত্রণা সহ্য করা কষ্টকর। তাঁর মনে হল যেন একটা লোহার সাঁড়াশি ধীরে ধীরে তাঁর কপালের ওপরে চেপে বসছে। যে-কলঙ্কের ভয় তাঁকে দেখানো হয়েছে, তাঁর মনে হল সেই কলঙ্কের কালি ইতিমধ্যেই যেন তাঁর শরীরের ওপরে ছিটকে পড়েছে। তাঁর কাঁধের ওপরে যে হাতটি এসে পড়েছে সেটি সীসের মতো ভারী হয়ে উঠেছে। এ অসহ্য মনে হল, তিনি যেন গুঁড়িয়ে যাবেন।
অ্যালেন, কী করবে তাড়াতাড়ি ঠিক করে ফেল।
আমি করতে পারব না।
যান্ত্রিক পদ্ধতিতে কথাটা বলে গেলেন অ্যালেন; নিছক কথা যেন সব কিছু ওলট-পালট করে দিতে পারে!
করতে তোমাকে-হবেই। অন্য কোনো পথ খোলা নেই তোমার দেরি করো না। এক মুহূর্ত ইতস্তত করলেন অ্যালেন; জিজ্ঞাসা করলেন: ওপরে আগুন রয়েছে? রয়েছে। গ্যাসের আগুন।
আমাকে বাড়ি যেতে হবে ল্যাবরেটরি থেকে কয়েকটা জিনিস আনতে হবে।
না অ্যালেন। এ ঘর ছেড়ে যাওয়া তোমার চলবে না। তোমার কী দরকার একটা কাগজে লিখে দাও। আমার চাকর গাড়িতে করে এখনই সে সব জিনিস নিয়ে আসবে।
কয়েকটা লাইন লিখলেন ক্যাম্বুবেল; তারপর ব্লটিং পেপার চিপে একটা খামের ভেতরে পুরলেন; খামের ওপরে নাম লিখলেন তাঁর সহকারী। ডোরিয়েন চিঠিটি ভালো করে পড়ে বেল বাজালেন। চাকর ঢুকতে তাকে নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন।
দরজাটা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ক্যাম্পবেল থর-থর করে কাঁপতে শুরু করলেন। তারপরে চেয়ার ছেড়ে উঠে চিমনি রাখার জায়গার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। মনে হল তাঁর জ্বর এসেছে। প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে কেউ কারোর সঙ্গে কথা কইলেন না। একটা মাছি ভনভন করে ঘুরতে লাগল; ঘড়ির টিকটিক শব্দ হাতুড়ির ঘা বলে মনে হল।
একটা বাজল। ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্যাম্পবেল ডোরিয়েন-এর দিকে তাকালেন, দেখলেন তাঁর চোখ দুটি জলে ভরে উঠেছে। সেই মুখের ওপরে এমন একটা পবিত্র বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়েছিল। যে অ্যালেন না রেগে পারেননি। তিনি ফিসফিস করে বললেন: জঘন্য, নক্কারজনক তোমার জীবন।
চুপ অ্যালেন। তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ।
তোমাকে! হায় ভগবান! কী জঘন্য জীবন তোমার! একটা পাপ আর একটা পাপের মধ্যে তুমি ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার শেষ পরিণতি হল নরহত্যায়। যা আমি করতে যাচ্ছি অথবা যা করতে। তুমি আমাকে বাধ্য করছ–সেটি কিন্তু তোমার জীবন বাঁচানোর জন্যে নয়। সে কথা আমি। চিন্তাও করছিনে।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ডোরিয়েন বললেন: তোমার ওপরে আমার যে করুণা রয়েছে তার একশ ভাগের এক ভাগও আমার ওপরে করুণা যদি তোমার থাকত!
এই বলেই ডোরিয়েন ঘুরে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কোনো উত্তর দিলেন না ক্যাম্পবেল।
আরো মিনিট দশেক পরে দরজায় একটা টোকা পড়ল বিরাট একটা মেহগনি কাঠের বাক্স নিয়ে চাকর ঘরে ঢুকল; সেই বাক্সের মধ্যে ছিল কেমিকেল, লম্বা ইসপাত আ প্ল্যাটিনাম তার; আর সেই সঙ্গে অদ্ভুত দেখতে দুটি লোহার আঁকশি।
ঘরে ঢুকেই সে ক্যাম্পবেলকে জিজ্ঞাসা করল:এগুলি কি স্যার এইখানেই রেখে যাব?
ডোরিয়েন বললেন, হ্যাঁ। তোমাকে আর একটা কাজ করতে হবে ফ্রান্সিস। রিচমনড-এর সেই লোকটির নাম কী বল তো–ওই যে, যে লোকটি সেলবিতে অরকিড দেয় হে।
তার নাম হার্ডেন, স্যার।