এই মানুষটির জন্যেই ডোরিয়েন গ্রে অপেক্ষা করে বসেছিলেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটি একটি মিনিট গুনে যাচ্ছিলেন তিনি। মিনিটের পর মিনিট কেটে যাওয়ার পরেই তিনি খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। খাঁচায় পোরা একটি রমণীয় বস্তুর মতো তিনি উঠে ঘরময় পায়চারি করতে লাগলেন। দুটি হাত অদ্ভুতভাবে মুষ্টিবদ্ধ করে তিনি লম্বা-লম্বা পা ফেলে ঘুরতে লাগলেন।
প্রতীক্ষা অসহ্য হয়ে উঠল তাঁরা মনে হল, সময় যেন আর কাটে না। প্রতিটি মুহূর্তে একটি কালো ঝড়ো হাওয়া যেন তাঁকে ঠেলে-ঠেলে চড়াই-এর একেবারে কিনারের দিকে নিয়ে। চলেছে। তারপরেই নীচে বিরাট অন্ধকার তলহীন গহ্বর। সেখানে তাঁর জন্যে কী অপেক্ষা করে বসে রয়েছে তা তিনি জানতেন। সেই ভয়ে দুটি হাত দিয়ে জোরে-ডোরে তিনি তাঁর চোখ দুটো ঘষতে লাগলেন মনে হল তিনি তাঁর নিজের মাথাটা ভেঙে ফেলবেন, দুটি চোখকে ঢুকিয়ে দেবেন কোটরের ভেতরে। কিন্তু সবই ব্যর্থ হয়ে গেল। দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পেলেন না তিনি। দুশ্চিন্তার পঙ্গপাল তাঁরই চোখের সামনে নেচে-নেচে বেড়াতে লাগল। তারপরে হঠাৎ স্থবির হয়ে গেল সময়। সেই মরা সময় কবরখানা থেকে লঘুগতিতে তাঁর চোখের ওপরে যে ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎটিকে টেনে নিয়ে এল তা দেখেই আঁৎকে উঠলেন তিনি। ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তিনি তাকিয়ে রইলেন। আতংকে পাথর হয়ে গেলেন তিনি।
অবশেষে দরজা খুলে গেল; ঘরে ঢুকল চাকর। তার দিকে চকচকে চোখে চেয়ে দেখলেন ডোরিযে।
লোকটি বলল: মিঃ ক্যাম্পবেল এসেছেন স্যার।
তাঁর সেই শুকনো ঠোঁট দুটির ভেতর থেকে একটা স্বস্তির স্বর ফুটে বেরল। বিবর্ণ গণ্ড দুটি ধীরে-ধীরে আবার তাদের পুরনো রঙ ফিরে পেল। কিছুটা সহজ হয়ে এলেন ডোরিয়েন।
তাঁকে এখনই পাঠিয়ে দাও ফ্রানসিস।
তাঁর মনে হল, আবার যেন স্বস্থানে ফিরে এসেছেন তিনি। তাঁর দেহ-মন থেকে ভীরুতা, দুর্বলতার সব চিহ্ন তখন অপহৃত হয়েছে।
মাথাটা নীচু করে লোকটি চলে গেল। কিছুক্ষণের ভেতরেই অ্যালেন ক্যাম্পবেল ভেতরে ঢুকে এলেন। আগন্তুকের মেজাজ বেশ রুক্ষ, কিন্তু মুখের রঙটি বিবর্ণ। ঘন কালো চুল আর ভুরু দুটির জন্যে তাঁর মুখের পাণ্ডুরতা আরো বেশি করে চোখে পড়ল।
অ্যালেন! তুমি যে দয়া করে এসেছ তার জন্যে ধন্যবাদ।
গ্রে, তোমার বাড়িতে আর কোনোদিন আসার ইচ্ছে আমার ছিল না। কিন্তু আমি চিঠিতে লিখেছিলে যে জীবন আর মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তুমি দাঁড়িয়ে রয়েছ।
তাঁর স্বরটি যে কেবল কঠোর তাই নয়; রীতিমতো নিরুত্তাপ। ধীরে-ধীরে চিবিয়ে-চিবিয়ে কথাগুলি বললেন তিনি। ডোরিয়েন গ্রের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন; সেই দৃষ্টি ঘৃণার, অবহেলারা হাত দুটি কোটের পকেটে ঢুকিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন; ডোরিয়েন গ্রের সাগ্রহ অভ্যর্থনাকে কোনোরকম আমল দিলেন না।
হ্যাঁ, সত্যিই তাই-জীবন-মৃত্যুই বটে, আর আমার একারই নয়, আরো অনেকের। বস।
টেবিলের পাশে একটা চেয়ারে গিয়ে বসলেন ক্যাম্পবেল: তাঁর মখোমখি বসলেন ডোরিয়েন। চোখাচোখি হল দুজনের। একটু করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ডোরিয়েন। তিনি জানতে যা। তিনি বলতে যাচ্ছেন তা সত্যিই ভয়ঙ্কর।
কয়েক মুহূর্ত বিক্ষুব্ধ নিস্তব্ধতার পরে তিনি অ্যালেনের দিকে একটু ঝুঁকে শান্তভাবে বললেন, প্রতিটি কথা কী ভাবে তাঁর ওপর প্রভাব বিস্তার করছে তাও লক্ করলেন তিনি; অ্যালেন, এই বাড়ির ছাদে একটা বন্ধ ঘর রয়েছে। সেই ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ ঢোকে না। সেইখালে টেবিলের ধারে একটা চেয়ারের ওপরে একটি মৃত মানুষ বসে রয়েছে। এখন থেকে ঘন্টা দশেক আগে তার মৃত্যু হয়েছে। উঠো না; আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে থেকো না। লোকটি কে, কেন সে মারা গেল, কী ভাবে মারা গেল–সে-সব বিষয়ে জানার কোনো প্রয়োজন তোমার নেই। তোমাকে যা করতে হবে তা হচ্ছে এই যে…
গ্রে, তুমি চুপ কর। আর কিছু আমি জানতে চাইনে। তুমি যা বললে তা সত্যি কি না তা ডানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই। আসল কথা, তোমার জীবনের কোনো ঘটনার সঙ্গে নিজেকে আর জড়িয়ে রাখতে আমি নারাজ। যদি কোনো ভয়ঙ্কর গোপন কাহিনি তোমার থাকে তা তুমি নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রাখা সেটা জানার কোনো কৌতূহল আমার নেই।
অ্যালেন, তোমাকে তা জানতেই হবে; বিশেষ করে এই গোপন কথাটা তোমার জানা চাই। তোমার জন্যে সত্যিই আমার বড়ো দুঃখ হয়, অ্যালেন। কিন্তু আমার কোনো উপায় নেই। একমাত্র তুমিই আমাকে এই বিপদ থেকে বাঁচাতে পার। সেই জন্যে বাধ্য হয়েই তোমাকে আমি ডেকে পাঠিয়েছি। তাছাড়া অন্য কোনো পথ আমার ছিল না। অ্যালেন তুমি বৈজ্ঞানিক। রসায়ন আর ওই জাতীয় কিছু বিষয়ে তোমার জ্ঞান রয়েছে। এই সব বিষয়ে অনেক পরীক্ষা তুমি করেছ। ওপরে যে জিনিসটি পড়ে রয়েছে সেটিকে একেবারে লোপাট করে। দিতে হবে; এমনভাবে পুড়িয়ে ফেলতে হবে যেন তার কোনো চিহ্নটুকু পর্যন্ত আর না থাকে। এ বাড়িতে ঢুকতে লোকটিকে কেউ এখানে দেখেনি। সত্যি কথা বলতে কি, ঠিক এই সময় তার প্যারিসে থাকার কথা। বেশ ক’টা মাস তার প্যারিসে থাকার কথা। বেশ ক’টা মাস তার কেউ খোঁজখবর নেবে না। যখন লোকে তাকে খুঁজবে তখন তার কোনো চিহ্ন যেন এখালে না। থাকে। অ্যালেন, তুমি তাকে আর তার সমস্ত চিহ্নগুলিকে পুড়িয়ে ছাই করে দাও; সেই ছাই আমি বাতাসে ছড়িয়ে দেব।