তাঁর বন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন, এবং লেডি ব্র্যানডন তাঁর সেই অদ্ভুত বন্ধুটির কী পরিচয় দিলেন? আমি জানি অতিথিদের বর্ণনা করার সময় তিনি বেশ দ্রুত এবং সংক্ষিপ্তভাবে তাঁদের গুণের বর্ণনা দেন। বেশ মনে পড়ে ভদ্রমহিলা একবার একটি বর্বর, সমস্ত শরীরে সরকার-দেওয়া খেতাব-আঁটা এক বৃদ্ধের কাছে আমাকে নিয়ে গিয়ে আমার কানে ফিসফিস করে তাঁর অজস্র গুণের বর্ণনা দিয়ে গেলন। তাঁর সেই ফিসফিসানি কেবল যে ঘরের প্রতিটি লোকের কানে। গিয়ে পোঁচেছিল তা-ই নয়, ভদ্রলোকের গুণাবলীর বর্ণনা তাঁর মুখ থেকে শুনে আমিও কেমন যেন হতচকিত হয়ে পড়েছিলাম। এর পরেই আমি স্রেফ কেটে পড়লাম। আমার সমগোত্র, অথবা আমার পছন্দমতো মানুষ খুঁজে বার করতেই আমি চাই, কিন্তু ভদ্রমহিলার ব্যাপার স্বতন্ত্র। নিলামকারীরা যেভাবে তাদের জিনিসপত্রের দাম ধার্য করে, আমাদের ওই ভদ্রমহিলাটির কাছেও তাঁর অতিথিদের মূল্য নির্ধারণের প্রণালীটি ঠিক সেই অতীয়া হয় তিনি তাঁদের সরিয়ে রাখেন, অথবা তাঁদের সম্বন্ধে এমন কিছু নেই যা তিনি অপরকে বলেন না-বাদ দেন কেবল সেইটুকু যেটুকু আর সবাই ভয়ানতে চায়।
হলওয়ার্ড একটু অন্যমনস্ক ভাবেই বললেন, ভদ্রমহিলার ওপরে অতটা কটোর হয়ো না হারি। হায়, হতভাগ্য নারী লেডি ব্র্যানডন!
অতিথিদের জন্যে তিনি একটি আপ্যায়ন ক তৈরি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু যা করতে পেরেছিলেন তা হচ্ছে একটি রেস্তোরাঁ। তাঁকে আমি প্রশংসা করব কেমন করে? কিন্তু সেসব কথা থাক, ডোরিয়েন গ্রে-র সম্বন্ধে তিনি তোমাকে কী বললেন সেইটাই আমাকে বলা
তেমন কিছু নয়। ‘চমৎকার ছেলে, ওর মা আর আমি-যাকে বলে একেবারে হরিহর আত্মা। ও যে ঠিক কী করে তা আমার স্মরণ হচ্ছে না; সম্ভবত কিছুই করে না। হ্যাঁ, হ্যাঁ, করে বটে, পিয়ানো বাজায! প্যিানো, না, বেহালা মিগ্রে?’এই কথা শুনে আমরা দুজনেই হেসে। ফেললাম, কিন্তু আমাদের মধ্যে সঙ্কোচ কেটে গেল, আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম।
আর একটি ডেইজি ফুল তুলে নিয়ে লর্ড হেলরি বললেন, বন্ধুত্বের শুরুতে হাসি-ঠাট্টা সূচনা হিসাবে খারাপ নয় আর বন্ধুত্বের সমাপ্তিতেও ওর চেয়ে ভালো জিনিস আর বোধ হয় নেই।
হলওয়ার্ড মাথা নেড়ে বললেন, বন্ধুত্ব আসলে জিনিসটা কী তা তুমি বোঝ না, হ্যারি, অথবা শত্রুতা বলতে ঠিক কী বোঝায় তা-ও হয়তো তোমার অজানা। সবাইকেই তুমি পছন্দ কর, অর্থাৎ সকলের ওপরেই তুমি সমান ভাবে উদাসীন।
টুপিটা মাথার পেছনে একটু ঠেলে দিয়ে, নীলকান্তমণি খচিত শূন্য গ্রীষ্মকাশের বুকে সাদা দুধের ফেলার মতো যে ছোটো ছোটো মেঘের টুকরো ভেসে বেড়াচ্ছিল সেই দিকে তাকিয়ে। লর্ড হেনরি বললেন, কী অন্যায় তোমার! নিশ্চয়, একশোবার অন্যায়। মানুষ আর মানুষের মধ্যে তফাৎ রয়েছে আমার কাছে। আমি সেই সব মানুষকে পছন্দ করি যারা দেখতে ভালো, যারা সৎ তাদের সঙ্গেই পরিচয় জমাই, আর যাদের ধীশক্তি তীক্ষ্ণ তাদেরই আমি শত্রু বলে গণ্য করি। শত্রু নির্বাচনে মানুষ খুব বেশি সতর্ক হতে পারে না। আমার বন্ধুদের মধ্যে কেউ মূর্খ নেই। সকলেরই কিছু না কিছু বুদ্ধি রয়েছে, ফলে, সকলেই প্রায় আমাকে পছন্দ করে। এ থেকে কি আমার কোনো দম্ভ প্রকাশ পায়, মনে হয় আমি এদিক থেকে কিছুটা দাম্ভিক।
আমারও তাই মনে হত, কিন্তু তোমার তালিকা অনুযায়ী, আমি তোমার নিছক পরিচিত ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রিয় বেসিল, তুমি তার চেয়ে অনেক বড়ো।
আর বন্ধুর নীচে, মনে হয় ভায়ের মতো, তাই না?
ওঃ, ভাই, ভাই! ভাইদের নিয়ে দুর্ভাবনা করার মতো কিছু নেই। আমার দাদা মারা যাবেন না, আর আমার ছোটো ভাইদেরও সেরকম কিছু করার সম্ভাবনা নেই।
হলওয়ার্ড বিরক্ত হয়ে বললেন, হ্যারি!
বন্ধু, আমি মোটেই সিরিয়াস হয়ে ওকথা বলিনি। কিন্তু আত্মীয়-স্বজনদের আমি ঘৃণা না করে পারি না। মনে হয় আমাদের এই মানসিক অবস্থার জন্যে দায়ী একটা;সেটা হচ্ছে, আমাদের মতো যাদের দোষ রয়েছে তাদের আমরা সহ্য করতে পারি না। ইংলিশ গণতন্ত্র উচ্চ শ্রেণির মানুষের বিকৃত রুচি বলতে যা বোঝাতে চায় তার সঙ্গে আমার পূর্ণ সহানুভূতি রয়েছে। জনসাধারণ মনে করে মদ্যপাযিতা, মুখতা আর চরিত্রহীনতা তাদের বিশেষ সম্পদ, এবং আমাদের মধ্যে কেউ যদি তাদের সেই ব্যক্তিগত সম্পত্তির মধ্যে নাক গলাতে যায় তাহলে সে একটি গর্দভ বলে বিবেচিত হবে। যখন হতভাগ্য সাউথওযার্ক বিবাহিবিচ্ছেদ মামলায় জড়িয়ে পড়ল তখন তাদের ঘৃণা সত্যিই দেখার মতো হয়েছিল। তবু আমার মনে হয়। শতকরা দশজন সাধারণ মানুষও নির্ভুল ভাবে জীবন কাটায় না।
তুমি যা বললে তার একটি কথাও আমি বিশ্বাস করি না, তার চেয়েও বড়ো কথা হ্যারি, আমার বিশ্বাস, তুমি নিজেও তা কর না।
লর্ড হেনরি তাঁর সূঁচলো কটা দাড়ির ওপরে হাত বুলোতে বুলোতে পেটেন্ট চামড়ার তৈরি বুট জুতোর ওপরে তাঁর আবলুস কাঠের লাঠিটা ঠুকতে লাগলেন। তারপরে বললেন, বেসিস, তুমি একটি পাকা ইংরেজ। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার তুমি ওই উক্তিটি করলো যদি কেউ কোনো। ইংরেজের কাছে নতুন কিছু বলে–যা বলাটা নিঃসন্দেহে হঠকারিতা, তাহলে সেটা ঠিক কি বেঠিক সে-সম্বন্ধে চিন্তা করার কথা সে স্বপ্নেও ভাবে না। একটি মাত্র জিনিস যা সে সত্যিই বিবেচনার যোগ্য বলে মনে করে তা হচ্ছে এই যে বক্তা নিজেই সেকথা বিশ্বাস করে কিনা। এখন কথাটা হচ্ছে নতুন কথা বলার দাম এই নয় যে বক্তা নিজে সে কথা বিশ্বাস করেন। বরং একথা বললে ঐযৌক্তিক হবে না যে যার মুখের আর মনের কথার মধ্যে ফারাক যত বেশি তার মতবাদ তত উচ্চমানের। কারণ সেই মতবাদের সঙ্গে কোনো দিক দিয়েই তারা। প্রত্যঙ্ক্ষভাবে জড়িত নয়। যাই হোক, আমি তোমার সঙ্গে রাজনীতি, সমাজনীতি অথবা আধ্যাত্মিক তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। নীতির চেয়ে মানুষকে বেশি পছন্দ করি আমি, এবং এ জগতে নীতিহীন মানুষকে আমি যত পছন্দ করি, এত পছন্দ আর কিছুই আমি করি না। মিঃ ডোরিয়েন গ্রে-র সম্বন্ধে আরো কিছু তুমি আমাকে বল তোমার সঙ্গে তার কেমন দেখাসাক্ষাৎ হয়?