হাসলেন লর্ড হেনরি, জিজ্ঞাসা করলেন, সেটা কী?
আমি তোমাকে বলব, উত্তর দিলেন চিত্রকর। কিন্তু তাঁর মুখ দেখে মনে হল সব যেন তিনি গুলিয়ে ফেলছেন।
তাঁর দিকে তাকিয়ে লর্ড হেনরি বললেন, আমি শোনার জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে আছি, বেসিল।
চিত্রকর বললেন, বলার সত্যিই বেশি কিছু নেই। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে তুমি হয়তো আমার কথা বুঝতে পারবে না। হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করতেও পারবে না তুমি।
লর্ড হেনরি হাসলেন, ঝুঁকে ঘাসের বন থেকে এখটা লাল ডেইজি ফুল তুলে সেটাকে পরীক্ষা। করতে লাগলেন। সেই ফুলটার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থেকে তিনি বললেন, না, না, আমি নিশ্চয় বুঝতে পারব। আর বিশ্বাস করার কথা যদি বল আমি যে-কোনো জিনিসই বিশ্বাস করতে লাগল, এবং সেই ক্লান্ত বাতাসে লাইল্যাক ফুলের ভারী ভারী গুচ্ছগুলি এদিকে-ওদিকে দুলতে লাগল। দেওয়ালের পাশে একটা ঘাস ফড়িং ভনভন করতে শুরু করল, আর নীল,সুতোর মতো লম্বা রোগাটে একটা ফড়িং তার রঙিন ডানা মেলে ঘুরে ঘুরে উড়তে লাগল। লর্ড হেনরির মনে হল তাঁর বন্ধুর বুকটা ঘন ঘন ওঠানামা করছে। বন্ধুটি এর পরে কি বলবেন তাই তিনি ভাবতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ পরে চিত্রকর বললেন, ঘটনাটা হচ্ছে এই মাস দুই আগে আমি একদিন লেডি ব্র্যানডনের পার্টিতে গিয়েছিলাম। তুমি জান আমাদের মতো দরিদ্র আর্টিস্টের মাঝে মাঝে বাইরে লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা করতে হয় শুধু তাদের বোঝানোর জন্যে, যে আমরা। বন্যপ্রাণী নই। তোমার কথাই ঠিক।সান্ধ্য পোশাক আর সাদা গলাবন্ধনী চড়িযে যে-কোনো মানুষই এমনকি একঙন পাতি ব্যবসাদারও সভ্য আর সংস্কৃতিবান বলে পরিচিত হওয়ার সাহস রাখে। সেদিন মিনিট দশেক আমি সুবেশা বিধবা আর বিরক্তিকর পণ্ডিতদের বিরাট সমাবেশে মিনিট দশেক গল্পগুজব করেছি এমন সময় হঠাৎ আমার মনে হল এক৬ল আমার। দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আধখানা ঘুরে দাঁড়ালাম, সেই প্রথম ডোরিয়েন গ্রে-র সঙ্গে চোখাচোখি হল আমার চোখাচোখি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল আমি যেন বিবর্ণ হয়ে গিয়েছি। একটা অদ্ভুত ভীতি আমাকে গ্রাস করে বসল। বেশ বুঝতে পারলাম আমি এমন একজনের সংসপর্শে এসে পড়েছি যার ব্যক্তিত্বের মোহিনীশক্তি এত প্রবল যে তাকে যদি সময়ে আমি প্রতিরোধ করতে না পারি তাহলে সে আমার চরিত্র, আত্মা, আমার আর্ট সব গ্রাস করে ফেলবো বাইরে থেকে কেউ আমার ব্যক্তিগত জীবনের ওপরে প্রভাব বিস্তার করবে এ আমি চাইনে। তুমি নিজেই ডান হ্যারি, চরিত্রের দিক থেকে আমি কতখানি স্বাবলম্বী। চিরদিনই আমি সেই রকমই ছিলাম; অন্তত ডোরিয়েন গ্রে-র সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে পর্যন্ত। তারপর–কিন্তু কী করে যে ব্যাপারটা তোমাকে বোঝাব বুঝতে পারছি না। কে যেন বলে দিল ভীবনে আমি একটি বিষম বিপদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। কী জানি কেন আমার মনে হয়েছিল সে ভাগ্য আমার জন্যে অনির্বচনীয় আনন্দ আর অবর্ণনীয় দুঃখ জমিয়ে রেখেছে। ভয় পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। বিবেক যে আমাকে এই কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল তা নয়, আমার সেই মানসিক অবস্থাকে তুমি বরং কাপুরুষতা। বলতে পার। সেদিন সেখান থেকে পালিয়ে আসার চেষ্টার মধ্যে কোনো রকম যুৎসই কারণ আমি খুঁজে পাইনি।
বিবেক এবং কাপুরুষতা, সত্যিকথা বলতে কি, একই বস্তু, বেসিলা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসাযিক নাম হচ্ছে বিবেক, এই যা।
হ্যারি, ওকথা আমি বিশ্বাস করি না। জানি, তুমিও তা কর না। আমার উদ্দেশ্য যাই হোক, হয়তো সেটা আমার গর্বই হবে, এবং চরিত্রের দিক থেকে গর্বিত কিছুটা আমি ছিলাম আমি। যে দরজার দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই লেডি ব্র্যানডন-এর সঙ্গে ধাক্কা খেলাম। তিনি চিৎকার করে উঠলেন, মিঃ ইলওযার্ড, এত তাড়াতাড়ি আপনি নিশ্চয় পালিয়ে যাচ্ছেন না? তাঁর গলার সেই অদ্ভুত স্বরটা নিশ্চয় তোমার মনে রয়েছে।
লর্ড হেনরি বললেন, রয়েছে। সৌন্দর্য বাদ দিয়ে ভদ্রমহিলা একেবারে ময়ূরকণ্ঠী।
এই বলে দুর্বল আঙুলগুলি দিয়ে তিনি একটি ডেইডি ফুল ছিঁড়তে লাগলেন।
বেসিল বলে গেলেন, আমি তাঁকে এড়াতে পারলাম না। তিনি অনেকের সঙ্গেই আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রাজবাডির অতিথি, খেতাবধারী পুরুষ, বড়ো বড়ো। টায়রা পরা সুঁচোল নাকধারিণী মহিলা। সকলের কাছেই তিনি আমার পরিচয় দিলেন তাঁর প্রিয় বন্ধু হিসাবে। এর আগে মাত্র একবার তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, কিন্তু আমি যে। একজন মহান ব্যক্তি এই রকম একটা ধারণা তাঁর মগডে ঢুকেছিল। আমার বিশ্বাস আমার কোনো একটা ছবি সেই সময় বেশ নাম করেছিল। অন্তত ঊনবিংশ শতাব্দীর নীতিহীন ধ্বজাবাহী সস্তা দামের কিছু সংবাদপত্র সেই ছবিটি নিয়ে বেশ হইচই করেছিল। যে যুবকটির ব্যক্তিত্ব আমাকে ওই রকম অদ্ভুতভাবে নাড়া দিয়েছিল হঠাৎ দেখলাম সেই যুবকটির সামনাসামনি এসে হাজির হয়েছিআমি খুব কাছাকাছি এসেছি আমরা, যাকে বলে স্পর্শ দূরত্বের মধ্যে। আবার আমাদের চোখাচোখি হল। হঠকারিতা সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যে আমি সেদিন লেডি ব্র্যানডনকে অনুরোধ করেছিলাম। হয়তো একেবারে হঠকারিতাও নয়। আলাপ হওয়াটা ছিল অবশ্যম্ভাবী। কোনোরকম পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মানুষ না থাকলেও, হয়তো আমরা নিজেরাই আলাপ করতাম। সেবিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। পরে, ডোরিয়েন-ও আমাকে সেই কথাই বলেছিলেন। তাঁর মলে। হয়েছিলে ভাগ্যই আমাদের পরস্পরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিত।