আপনি বোধ হয় লোহেন গ্রিন-এর কথা বলছেন, তাই না, লেডি হেনরি?
হ্যাঁ। আমার প্রিয় লহেন গ্রিন-এর কথাই বলছি। ওযাগনারের সঙ্গীত আমার খুব ভালো লাগে। সত্যি কথা বলতে কি অত ভালো আর কারো সুরই আমার লাগে না। এ গালের লয় এত চড়া যে নিবিবাদে কথা বলা যায়, পাশের লোক সেকথা শুনতে পায়না। চড়া গানের সুবিধে এইখানে, তাই না, মিঃ গ্রে?
সেই একই রকমের ভীরু হাসি তিনি হাসলেন, তাঁর পাতলা ঠোঁট দুটি ফাঁক হল। কচ্ছপের খোলা দিয়ে তৈরি লম্বা একটা কাগজকাটা ছুরি তিনি আঙুলের মধ্যে ধরে নাড়াতে লাগলেন।
ডোরিয়েন হেসে তাঁর মাথা নাড়লেন, লেডি হেনরি, আমার তা মনে হয় না। গানের সময় আমি কথা বলি না। বিশেষ করে গান যদি ভালো হ্য। গান খারাপ হলে শ্রোতাদের কর্তব্য হচ্ছে চেঁচিয়ে সেই গান মহৎ করে দেওয়া।
ওঃ, এটা হ্যারিরই একটি মত, তাই না মিঃ গ্রে? হ্যারির সমস্ত মত-ই আমি তার বন্ধুদের মুখ থেকে শুনতে পাই। তার মত ডানার এইটিই আমার একমাত্র উপায। কিন্তু আপনি নিশ্চয়। ভাববেন না। আমি ভালো গান পছন্দ করি না। ভালো গানকে আমি খুব প্রশংসা করি। কিন্তু ভয়-ও পাই যথেষ্ট। আমাকে এ অতিমাত্রায় কল্পনাবিলাসিনী করে তোলে। আমি। পিয়ানোবাদকদের পুডো করি বলতে পারেন, কখনো কখনো দুজনকে–হ্যারি সেই কথাই আমাকে বলে। তাঁদের মধ্যে কী রয়েছে তা আমি জানি না, হয়তো তাঁরা বিদেশি বলে। ভালো পিয়ানো বাজিয়েদের সবাই বিদেশি, তাই না? এমন কি যাঁরা ইংলন্ডে জন্মনি তাঁরাও একটা সময় পরে বিদেশি হয়ে যান। তাই না? তাঁরা অতি বুদ্ধিমান, এবং ললিতকলার পল্কে সেটা বেশ গৌরবের কথা। এই ধরনের রীতি বাজিয়েদের সর্বজনীন করে তোলে। আপনার তাই মনে হয় না? মিঃ গ্রে, এই ধরনের কোনো মজলিসে আপনি কখনো গিয়েছেন? আপনার যাওয়া উচিত। ওর্কিড কেনার সামর্থ্য নেই আমার, কিন্তু বিদেশিদের জন্য কিছু খরচ করতে কার্পণ্য করি না আমি। তাঁদের উপস্থিতি ঘরকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলে। কিন্তু হ্যারি এসে পড়েছে। হ্যারি, তোমার খোঁড়ে আমি এই ঘরে ঢুকেছিলাম, তোমার সঙ্গে কিছু দরকার ছিল আমার, কী দরকার ছিল তা আমি ভুলে গেছি তোমার পরিবর্তে মিঃ গ্রে-কে দেখলাম। সঙ্গীত সম্বন্ধে আমাদের বেশ চমৎকার আলোচনা হচ্ছিল এতক্ষণ আমাদের ধারণা প্রায় একই। না, না। আমার মনে হয়, এ বিষয়ে আমাদের মতবাদ পৃথক। কিন্তু আমার সঙ্গে আলোচনা করে উনি খুব খুশি হয়েছেন। ওঁকে দেখে আমি খুব আনন্দ পেয়েছি।
বাঁকানো অর্ধচন্দ্রাকৃতি ভুরু তুলে, এবং দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে লর্ড হেনরি বললেন, আমিও খুব খুশি হয়েছি, প্রিয়তমে। দেরি হল বলে আমি অত্যন্ত দুখিত, ডোরিসেনা ওয়ার্ডোর স্ট্রিটে একটা পুরনো ব্রকেডের তল্লাশে যেতে হয়েছিল আমাকে, এবং দর কষাকষি করতে। অনেকটা সময় নষ্ট হল আমার। আজকাল সবাই জিনিসের বাডার দরটাই ডালে, কোনো জিনিসের মূল্যবোধ বলতে তাদের কোনো জ্ঞান নেই।
হঠাৎ একটু বোকার মতো হেসে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা ভেঙে দিলেন লেডি হেনরি, বললেন, আমাকে এখনি বাইরে যেতে হব। ডাচেসকে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার কথা দিয়েছি আমি। মিঃ গ্রে, হ্যারি, আমি চললাম। সম্ভবত তুমিও বাইরেই ঘাচ্ছ? আমিও। সম্ভবত লেডি থ্রেবেরির বাড়িতে আমাদের দেখা হবে।
দরজাটা বন্ধ করতে করতে লর্ড হেনরি বললেন, আমারও তাই মনে হচ্ছে।
ঘরের মধ্যে মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে লেডি হেনরি লঘু পদক্ষেপে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন, মনে হল, সারা রাত্রি ধরে বৃষ্টিতে ভিজে স্বর্গের একটা পাখি আটকে পড়েছিল, হঠাৎ দূরজা খোলা সেযে সে তীব্র বেগে উড়ে গেল। দরজা বন্ধ করে একটা সিগারেট ধরালেন লর্ড হেনরি। তারপরে সোফার ওপরে বসে পড়লেন।
সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়ে লর্ড হেনরি বললেন, কটা চুল রয়েছে এরকম কোনো মহিলাকে তুমি বিয়ে করো না, ডোরিয়েন।
কেন বল তো?
তারা বড়ো ভাবপ্রবণ হয়।
কিন্তু ওই জাতীয় মানুষকেই যে আমার ভালো লাগে, হ্যারি।
কক্ষনো বিয়ে করো না। মানুষ বিয়ে করে কেন? কারণ তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে, কারণ তাদের কৌতূহল থাকে যথেষ্ট। এই জাতীয় মহিলাদের বিয়ে করলে দু’দিক থেকেই তাদের নিরাশ হতে হয়।
হেনরি আমার বিয়ে করার সম্ভাবনা বড়ো কম। আমি একজনকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি। এই অদ্ভুত যুক্তি অবশ্য তোমারই সেইটাই আমি বাস্তব ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে যাচ্ছি, ঠিক অন্যান্য বিষয়েও আমি যেমন তোমার উপদেশ মতো চলার বা করার চেষ্টা করি।
একটু থেকে হেনরি জিজ্ঞাসা করলেন, কাকে তুমি ভালোবেসেছ?
লজ্জা পেয়ে ডোরিয়েন বললেন, একজন অভিনেত্রীকে।
লর্ড হেনরি কথাটাকে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে কাঁধে একটা শ্রাগ করে বললেন, এটা একটা সাধারণ রোমান্স ছাড়া আর কিছু নয়।
তাকে দেখলে তুমি একথা বলতে না, হ্যারি।
তার পরিচয়?
তার নাম সাইভিল ভেন।
ওরকম নাম তো কখনো শুনিনি।
কেউ শোনেনি, তবে একদিন সবাই শুনবে। মেয়েটি অভিনয় জগতে একটি জিনিস।
শোন বালক, শোল। কোনো নারীই কোনোদিন ডিসি–এর পর্যায়ে পড়তে পারে না। নরলোকে ওরা অলঙ্করণের পূজারিণী। কোনোদিনই ওদের বলার কিছু থাকে না, কিন্তু সেই কথাটাই ওরা বেশ মিষ্টি করে ললিতকলার ছন্দে বলে যায়। পুরুষরা যেমন নীতির ওপরে মননকে প্রাধান্য দেয়, নারীরা তেমনি প্রাধান্য দেয় মনের ওপরে নিছক বস্তুকে।