মিঃ আরস্কিন বললেন, আমার মনে হয় আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। আমারও একসময় সাহিত্যিক হওয়ার বাসানা ছিল, কিন্তু সেই বাসনাকে অনেক দিন আগেই আমি পরিত্যাগ করেছি। কিন্তু প্রিয় বন্ধু, যদি অবশ্য বন্ধু বলে আপনাকে সম্বোধন করার অনুমতি দেন, একটা কথা আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা করি, আজকে লাঞ্চের সময় যেসব কথা আপনি বললেন, সেগুলি কি আপনি সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করেন?
লর্ড হেনরি হেসে বললেন, তখন কি বলেছিলাম তা আমার মনে নেই। সত্যিই কি আমার কথাগুলো খুব খারাপ লাগছিল আপনাদের?
সত্যিই খুব খারাপা আমার বিশ্বাস আপনার সঙ্গে কথা বলা অত্যন্ত বিপজ্জনক। আমাদের প্রিয় ডাচেসের শেষ পর্যন্ত কোনো ক্ষতি হয় তাহলে তার জন্যে আমরা আপনাকেই মূলত দায়ী করব। কিন্তু সে কথা থাকজীবন সম্বন্ধে আপনি কি বোঝেন সেই সম্বন্ধে কিছু আপনার মুখ থেকে আমি শুনতে চাই। যে-যুগে আমি ভন্তোছি সে যুগটা বড়ো বিরক্তিকর। কোনোদিন যদি লন্ডনের আবহাওয়ায় আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন তাহলে বিনা দ্বিধায় ট্রেডলেতে চলে আসবেন। আমার স্টকে কিছু প্রথম শ্রেণির বার্গেন্ডি সুরা রয়েছে। তারই গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে জীবনদর্শন বলতে আপনি কী বোঝেন তাই শোনা যাবে।
খুব খুশি হব আমি। সেদিনের আশায় দিন গুনবো আমি। ট্রেজলের আতিথ্যই কেবল প্রথম শ্রেণীর ন্য, আমি জানি আপনার লাইব্রেরিটিও উৎকৃষ্ট।
ভদ্রভাবে এবং ভদ্রসমাজের রীতি অনুযায়ী বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি তাঁর মাথা কিঞ্চিৎ অবনত করে বললেন, আবনি তাদের পূর্ণ করবেন। এখন আপনার ওই অতিথিবৎসলা আনটা-এর কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে। এখন আমার অ্যাথিনিযাম-এ যাওয়ার কথা। এইখানেই আমরা ঘণ্টাখানেক দিবানিদ্রা উপভোগ করি।
মিঃ আরস্কিন, আপনারা সবাই?
চল্লিশজন, চল্লিশটি আরাম কেদারায় চুপচাপ বসে থাকি আমরা। ‘ইংলিশ অ্যাকাডেমি অফ লেটারস’-এর সভ্য হওয়ার জন্য ওইখানেই আমাদের প্রস্তুতি চলে।
হাসলেন লর্ড হেনরি, তারপরে উঠে বললেন আমি পার্কে যাচ্ছি।
দরজার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ডোরিয়েন গ্রে তাঁকে আলতো ভাবে ধরে ফিসফিস করে বললেন, আমিও যাব।
কিন্তু আমি ভেবেছিলাম বেসিল হলওয়ার্ডের সঙ্গে দেখা করার কথা রয়েছে আপনার।
আপনার সঙ্গেই আমি যেতে চাই। হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়। আপনি অমত করবেন না। কথা দিন সব সময় আমার সঙ্গে আপনি কথা বলবেন? আপনার মতো অত সুন্দর কথা আর কেউ বলতে পারবে না।
লর্ড হেনরি হেসে বললেন, আজ আমি অনেক কথা বলেছি। এখন আমি আসল জীবনটা কী তাই দেখতে চাই। আপনি আমার সঙ্গে আসতে পারেন, এবং ইচ্ছে হলে আমার চোখ দিয়ে রক্তমাংসের মানুষ বলতে কী বোঝায় তা-ও পারেন দেখতে।
.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
মাসখানেক পরের কথা। সময় অপরাহ্ন। মে ফেয়ারে লর্ড হেনরির যে বাড়ি ছিল তারই ছোটো লাইব্রেরিতে একটি মোটা গদি-আঁটা ইজিচেয়ারের গায়ে হেলান দিয়ে আরাম করে বসেছিলেন ডোরিয়েন গ্রে। বলতে গেলে ঘরটি বড়ো চমৎকার। ভেতরের খিলানগুলি ওক কাঠের তক্তা দিয়ে আঁটা, এর পীত রঙের কারুকার্য করা কার্নিশ, পলেস্তারা করা উঁচু ছাদ আর মেঝে পার্শিয়ান কার্পেটি দিয়ে মোড়া। ছোটো মাটিন কাঠের টেবিলের ওপরে ক্লডিনের তৈরি একটি মূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার পাশে পড়ে রয়েছে লা সাঁৎ নোভেলার একটি কপি, ক্রোভিস ইভ ভ্যালয়-এর মার্গারেটর এটি বেঁধেছেন চারপাশে ডেইডি ফুলের রঙ দিয়ে ছোপানো, রানি এই রঙটিই বড়ো পছন্দ করতেন।
কতকগুলি বড়ো বড়ো নীল রঙের চিনা জার আর প্যারটফুলের গুচ্ছ সাজানো রয়েছে অগ্নিকুণ্ডের ওপরে কারুকাজ করা তাকে। গ্রীষ্মকালে লন্ডনে কমলালেবু রঙের আলো জানালার ভেতর দিয়ে ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
লর্ড হেনরি তখনো ফেরেননি। সব সময়েই তিনি দেরি করে ফিরতেন। তাঁর মতে সমযানুবর্তিত হচ্ছে সময়-অপহারক। সেই জন্য ডোরিয়েন গ্রে উদাস দৃষ্টিতে বসেছিলেন মাঝে মাঝে চিত্রবহুল ম্যানন লেকট-এর একখানি বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিলেন। ঘড়ির অবিরাম টিক টিক শব্দ একঘেয়ে সুরে একটি বিরক্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। ঘর থেকে চলে যাওয়ার জন্যে দু-একবার চেষ্টাও তিনি করেছিলেন।
অবশেষে দরজার বাইরে কার যেন পায়ের শব্দ হল, দরজা খুলে গেল। তিনি একটু বিরক্তির সুরে বললেন, হ্যারি, কত দেরি করলে বল তো!
তারপরেই তিনি চকিতে একবার আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, আমাকে ক্ষমা করুন, আমি ভাবছিলাম…
আপনি আমাকে আমার স্বামী বলে ভুল করেছিলেন। আমি তাঁর স্ত্রী মাত্র। আমি নিজেই আমার পরিচয় দিচ্ছি। আপনার ছবি দেখেছি, সেই থেকেই আমি আপনাকে চিনি। আমার স্বামীর কাছে আপনার সতেরখানা ফটো রয়েছে।
লেডি হেনরি, সতেরখানা নয়।
তাহলে, আঠারখানা। সেদিন অপেরাতে তাঁর সঙ্গে আপনাকে আমি দেখেছি।
কথা বলতে বলতে তিনি একটু হাসলেন, সেই হাসিতে একটু ভডত ছিল, হাসতে হাসতে তাঁর সেই ভুলো-না-আমায় চোখ দুটি দিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। অদ্ভুত মহিলা এই লেডি হেনরি। তাঁর পোশাক দেখলে মনে হবে সেগুলি তাঁর মানসিক অব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্যে তৈরি হয়েছে পরিধানের মধ্যেও বেশ হঠকারিতার লক্ষণ বিদ্যমান। সাধারণত সব সময়েই কারো না কারো সঙ্গে তিনি প্রেমে পড়েন এবং প্রতিদিন না পাওয়ার ফলে তিনি সব সময়েই ভ্রান্তির স্বপ্নে মশগুল হয়ে থাকেন। নিজেকে অপরুপা করে সাজানোর জন্যে চেষ্টার অন্ত ছিল না তাঁর, কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি। তাঁর নাম ভিকটোরিয়া, গির্জায় যাওয়াটা তাঁর একটা ঝোঁকে পরিণত হয়েছিল।