আর্টিস্ট বেসিল বললেন, তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ না, হ্যারি। অবশ্য ওর মতো আমি যে নই তা আমি ভালোভাবেই জানি। বাস্তবিক, ওর মতো আমাকে দেখাচ্ছে একথা কেউ বললে আমি দুঃখই পাব। বিশ্বাস হল না তোমার? আমি তোমাকে সত্যি কথাই বলছি। সমস্ত শারীরিক আর মানসিক উৎকর্ষ ধ্বংস হয়ে যায়। ঠিক এমনিভাবেই ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে এই মরণশীলতা রাজাদের স্খলিত পদক্ষেপের পিছু ধাওয়া করেছে। সহযাত্রীদের কাছ থেকে পৃথক হয়ে না থাকাটাই ভালো। যারা কুৎসিত এবং মুর্খ এ জগতে তারাই সবচেয়ে ভালো জিনিসটা ভোগ করে। তারা আরাম করে বসে খেলার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে। জয় সম্বন্ধে যদি তাদের কোনো জ্ঞান না-ও থাকে, পরাজয় সম্বন্ধে কোনো ধ্যান-ধারণাও তাদের নেই। কোনো ঝামেলা-ঝঞ্ঝাটই তাদের বিব্রত করে না, আর দশজনের মতো তারা শান্ত আর উদাসীনভাবেই জীবন কাটিয়ে দেয়। কোনোদিনই তারা অন্য লোকের জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে না। অন্য লোকের কাছ থেকেও তারা কোনোরকম গুরুতর আঘাত পায় না। হ্যারি, তোমার পদমর্যাদা এবং অর্থ আমার মস্তিষ্ক–দাম তার যাই হোক, আমার কলা–এদের দাম যাই হোক। ডোরিয়েন গ্রে-র মিষ্টি চাহনি, ভগবান আমাদের যা দিয়েছেন তার জন্যে আমরা সবাই দুঃখ পাব–বেশ ভালো রকম দুঃখই পাব আমরা।
বেসিল হলওয়ার্ডের দিকে কয়েকটি পা এগিয়ে যেতে যেতে লর্ড হেনরি জিজ্ঞাসা করলেন, ডোরিয়েন গ্রে? কী নাম বললে?
হ্যাঁ, ওইটাই তাঁর নাম। ইচ্ছে করেই আমি তোমাকে বলিনি।
কিন্তু কেন বলনি?
তা আমি বলতে পারব না। যাদের আমার খুব ভালো লাগে তাদের নাম আমি কাউকে বলি না। এই নাম বলার অর্থই হচ্ছে তাদের কিছুটা অংশ বলে দেওয়া। সব জিনিসই গোপন রাখতে আমি কেমন যেন ভালোবাসি। আমার ধারণা, যে সব জিনিস আধুনিক জীবনযাত্রাকে রহস্যময় আর অপরূপ করে তুলেছে এটি তার মধ্যে একটি। লুকিয়ে রাখতে পারলে অতি তুচ্ছ সাধারণ জিনিসও আমাদের আনন্দ দেয়। আজকাল শহর ছেড়ে বাইরে কোথাও গেলে ঠিক কোথায় আমি যাচ্ছি সে-কথা আমি কাউকেই বলি না। একথা বললে বেড়ানোর সমস্ত আনন্দ আমার নষ্ট হয়ে যেত। অভ্যাসটা প্রশংসা করার মতো নয়, তবু মনে হয় এই ধরনের গোপনপ্রিয়তা মানুষের জীবনে বেশ কিছু রোমান্সের আমদানি করে। মনে হচ্ছে এর জন্যে আমাকে বেশ বোকা-বোকা লাগছে তোমার?
লর্ড হেনরি বললেন, মোটেই তা নয়। তুমি ভুলে যাচ্ছ যে আমি বিবাহিত। বিবাহের আকর্ষণ হচ্ছে প্রবঞ্চনা, বিবাহিত জীবনকে আকর্ষণীয় করতে হলে স্বামী আর স্ত্রী দুজনকেই প্রবঞ্চনার আশ্রয় অবশ্যই নিতে হবে। আমার স্ত্রী কোথায় যান তা আমি কোনো দিনই জানি না। আমি কোথায় ঘুরে বেড়াই সে বিষয়েও আমার স্ত্রী সমানভাবে অজ্ঞ। মাঝে মাঝে আমাদের দেখা হয়, আমরা দুজনে বাইরে খেতে যাই, তখন বেশ গম্ভীর ভাবেই পরস্পরের কাছে আমরা। নির্ভেজাল মিথ্যে কথা বলে যাই। মিথ্যে ভাষণে আমার স্ত্রী অত্যন্ত পটিয়সী, সত্যি কথা বলতে কি আমার চেয়ে অনেক বেশি। কবে কার সঙ্গে দেখা করার তাঁর কথা রয়েছে সে কথা। তিনি একবারও ভুলে যান না, কিন্তু আমি ভুলে যাই। ফলে, আমি যখন ধরা পড়ে যাই তখন। তা নিয়ে তিনি এতটুকু হইচই করেন না। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, একটু-আধটু হইচই। করলেই হয়তো ভালো হত, কিন্তু তিনি আমার দিকে তাকিয়ে একটু উপহাসের হাসি হাসেন মাত্র।
স্টুডিওর একটা দরজা বাগানের দিকে খোলা ছিল, সেই দিকে পায়চারি করতে করতে বেন্সিল বললেন, হ্যারি, তোমার বিবাহিত জীবন সম্বন্ধে যেসব কথা তুমি বললে তা শুনতে মোটেই ভালো লাগল না আমার। তুমি যে সত্যিকারের একজন ভালো দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন স্বামী সেদিক থেকে আমার কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু সেকথা বলতে তোমার লজ্জা হয়। তুমি একটি চমৎকার মানুষ কোনোদিনই তোমার মুখ থেকে নীতিকথা বেরোয়নি, কিন্তু কোনোদিনই তুমি অন্যায় কাজ করনি। মানুষের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বৈরাগ্যটা তোমার একটা ভান মাত্র।
লর্ড হেনরি হেসে বললেন, আসল কথা হচ্ছে স্বাভাবিক হওয়াটাই একটা চাল, আর আমার মতে খুব একটা বিরক্তিকর চাল।
এই কথা বলে লর্ড হেনরি তাঁর বন্ধুর সঙ্গে বাগানের মধ্যে বেরিয়ে এলেন। একটি দীর্ঘ লরেল গাছের ঝোপের ছায়ায় বাঁশের একটা মাচা বাঁধা ছিল। দুজনে সেই মাচায় বসলেন। মসৃণ। পাতার ওপর দিয়ে রোদ গড়িয়ে পড়ছিল। ঘাসের বলে প্রচুর পরিমাণে ফুটে ছিল ডেইজি ফুল।
একটু চুপ করে লর্ড হেনরি তাঁর পকেট-ঘড়িটা টেনে নিলেন পকেট থেকে, বললেন, আমাকে এবার যেতে হবে, বেসিল। কিন্তু যাওয়ার আগে একটা প্রশ্নের উত্তর আমি জানতে চাই। প্রশ্নটা একটু আগেই আমি তোমাকে করেছি।
মাটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে চিত্রকর জিজ্ঞাসা করলেন, প্রশ্নটা কী বল তো?
তুমি নিজেই তা ভালো জানো।
আমি জানি না, হ্যারি।
বেশ, আমি তোমাকে তা বলছি। আমি জানতে চাই ডোরিয়েন গ্রে-র প্রতিকৃতি প্রদর্শনীতে পাঠাবে না কেন? আসল কারণটা আমি জানতে চাই।
আমি তোমাকে আসল কারণটাই বলেছি।
না, তুমি তা বলনি। তুমি কেবল বলেছিলে। ওই ছবির ভেতরে তোমার নিজস্ব সত্তার অনেকটা প্রতিবিম্বিত হয়েছে। কিন্তু এটা তোমার ছেলেমানুষের কথা।
বন্ধুর মুখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বেসিল হলওয়ার্ড বললেন, হ্যারি, গভীর দরদ আর আর অনুপ্রেরণার সঙ্গে যে ছবি আঁকা হয় সেটা হচ্ছে চিত্রকরের নিজস্ব প্রতিকৃতি, মডেলের নয়। সেই বিশেষ হেষ্কত্রে মডেলটা হচ্ছে আকস্মিক, চিত্রাঙ্কনের প্রযোডনে গৌণ। চিত্রকর কোনোদিনই মডেলের সত্তাকে প্রতিফলিত করেন না, সেই রঙিন চিত্রপটের ওপরে তিনি প্রতিবিম্বিত করে নিজেকেই। এই ছবিটিকে প্রদর্শনীতে না পাঠানোর কারণটা হল আমার আশঙ্কা। ভয় হচ্ছে এই ছবির সঙ্গে আমার আত্মার অনেক গোপন বেদনা আর আনন্দ মিশে গিয়েছে।