মিসেস ভ্যানডেলর ভয়ে ভয়ে বলেন, কিন্তু আমাদের দায়িত্বও বড়ো কমন নয়।
লেডি আগাথা সমর্থন করলেন তাঁর কথা: গুরু দায়িত্ব।
লর্ড হেনরি মিঃ আরস্কিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, মানুষ নিজের অত্যন্ত সিরিয়াস জীব বলে মনে মনে করে। এইটি হচ্ছে পৃথিবীর আদি পাপা গুহাবাসী মানুষ যদি হাসতে জানত তাহলে মানুষের ইতিহাস আজ অন্যভাবে লেখা হত।
ডাচেস মিষ্টি সুরে বললেন, তোমার কথায় সান্ত্বনা পেলাম। তোমর আট-এর সঙ্গে দেখা করতে আসার সময় আমি নিজেকে অপরাধিনী মনে করতাম, কারণ ইস্ট এন্ডের ওপরে আমার কোনো মোহ ছিল না। ভবিষ্যতে কোনো রকম লজ্জিত না হয়েই আমি তাঁর মুখের দিকে চাইতে পারব।
লর্ড হেনরি বললেন, একটুখানি লজ্জা ভালোই দেখাবে, ডাচেস।
তিনি উত্তর দিলেন, সে কথা ঠিক, তবে ও জিনিসটা যৌবনেই ভালো মানায। আমার মতো বৃদ্ধার গাল যখন লজ্জায় লাল হয়ে যায় তখন দেখবে কুৎসিতই লাগে। হায়, লর্ড হেনরি, কী করে আবার যৌবন ফিরিয়ে পাওয়া যায় তা যদি আপনি আমাকে বলতে পারতেন!
একটু চিন্তা করে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, আচ্ছা ডাচেস, পূর্ব জীবনে আপনি কোনো দিন খুব বড়ো ধরনের ভুল করেছিলেন?
ডাচেস বললেন, একটা নয়, অনেক।
লর্ড হেনরি বেশ গম্ভীরভাবেই বললেন, তাহলে সেই ভুলগুলি আবার করুন। যৌবন ফিরে পেতে প্রথম জীবনের সব ভুলগুলি আবার আবার আপনাকে করতে হবে।
চিৎকার করে উঠলেন ডাচেস, চমৎকার নীতি! ওই নীতিটাকে আবার আমাকে খাটাতে হবে।
স্যার টমাসের পাথর-চাপা ঠোঁটের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল কথাটা, অতি বিপজ্জনক নীতি!
লেডি আগাথা ঘাড় নাড়লেন, কিন্তু তিনিও খুশি না হয়ে পারলেন না। মিঃ আরস্কিন শুনলেন কথাগুলি।
লর্ড হেনরি তাঁর পূর্ব কথার ডেজর টানলেন, হ্যাঁ, জীবনের গোপন রহস্যগুলির মধ্যে এ হচ্ছে একটি। আজকাল একটি নিঃশব্দ সঞ্চারী সাধারণ জ্ঞানের কবলে পড়ে অধিকাংশ মানুষই মারা যায়, তারা অনেক দেরিতে আবিষ্কার করে যে মানুষ যেগুলির জন্যে অনুতাপ করে না। সেগুলি হচ্ছে তাদের ভুল।
সারা টেবিল জুড়ে হাসির বন্যা বয়ে গেল।
কথাটা নিয়ে খেলতে লাগলেন তিনি, ইচ্ছে করেই লোফালুফি করতে লাগলেন। একটি অর্থহীন চিন্তাকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে লাগলেন নানাভাবে-কল্পনার রঙে তুলতেন রাঙিয়ে, উড়িয়ে দিলেন আপাতবিরোধী সত্যের ডানায়। তাঁর আবেগের উচ্ছ্বাসে মূর্খতার স্তুতি দার্শনিক তত্ত্বে রুপান্তরিত হল। তারুণ্যের উন্মাদনায় সেই দর্শন জীবনের চড়াই-এর ওপরে মনের আনন্দে নৃত্য করতে লাগল। জীবনের বাস্তব ঘটনাগুলি তার সামনে থেকে অরণ্যের পশুর মতো ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে লাগল পালাতে মনে হল যেন একটা অদ্ভুত অপরিকল্পিত কবিতা স্বতঃ উৎসারিত হয়ে তার মুখের মধ্যে থেকে ঝরে পড়ছে। তাঁর মনে হল ডোরিয়েন গ্রে-র চোখ তাঁর দিকে নিবদ্ধ হয়ে রয়েছে। সমবেত শ্রোতৃবৃন্দের মধ্যে এমন একডনি রয়েছেন যাঁকে তিনি মুগ্ধ করতে চান, এই সজাগ অনুভূতির ফলে তাঁর বুদ্ধি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল, কল্পনা হয়ে উঠল রঙিন। অপরিসীম চাতুরির মায়াজাল বিস্তার করে তিনি সবাইকে আপহষ্ক সমর্থনে বিভ্রান্ত করে দিলেন। এবং তাঁরাও সকলে হাসতে হাসতে তাঁকে সমর্থন জানালেন। ডোরিয়েন গ্রে একদৃষ্টি দিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন, যতক্ষণ লর্ড হেনরি কথা বলছিলেন ততক্ষণ তিনি চোখ দুটি অন্য পাশে সরাতে পারেননি। মনে হল একটি সম্মোহন মন্ত্র এসে তাঁকে একবারে গ্রাস করে ফেলেছে, অভিভুত করেছে তাঁকে। মাঝে মাঝে দুজনের স্মিত হাসি দুজনকেই অভিবাদন জানাতে লাগল। এবং ডোরিয়েনের কালো চোখের তারা দুটি একটি গভীর আবেদনা মুহ্যমান হয়ে পড়ল।
অবশেষে বাস্তব জগতে ফিরে এল সবাই। যুগের উপযোগী পোশাক পরে একটি চাকর ঘরে ঢুকে ডাচেসকে সবিনয়ে জানাল যে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তাঁর গাড়িটি দরজার সামলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভদ্রমহিলা অত্যন্ত সুব্ধ হয়েছেন এই রকম ভান করে নিজের হাত দুটো। মুচড়ে বললেন, কী জ্বালা! আমাকে এবার যেতেই হবে। ক্লাব থেকে আমার স্বামীকে তুলে নিতে হবে। উইলিস রুমস-এর ‘কাজ নেই তো খই ভাজ’ মিটিং-এ যোগ দিতে যাবেন তিনি। একটু দেরি হলেই তিনি রেগে বোম হয়ে যাবেন। আমি তাঁর সঙ্গে রাগারাগি বা হইচই করতে চাইনি। শক্ত কথা বললে তাঁর মাথাটা বিগড়ে যাবো না, না, আর আমি অপেক্ষা করতে পারব না। আমাকে যেতেই হবে। ডিযার আগাথা বিদায়, লর্ড হেনরি, তোমার কথা শুনে খুব আনন্দ হল আমারা ভয়ঙ্কর রকমের দুর্নীতির একটি ডিপো তুমি তোমার মতবাদের বিরুদ্ধে যে কী বলব তা আমিই জানি না। একদিন রাত্রিতে আমাদের সঙ্গে ডিনার খেতে এস, আগামী মঙ্গলবার, ওই দিন কি ডিনার খাওয়ার জন্যে কাউকে কথা দিয়েছে?
ঘাড়টা কিঞ্চিৎ নত করে লর্ড হেনরি বললেন, আপনার জন্যে ডাচেস সকলকে আমি সাময়িকভাবে পরিত্যাগ করব।
ডাচেস বললেন, সুন্দর কথা, সেই সঙ্গে অন্যায়ও। যাই হোক, আমি ধরে নিলাম তুমি আসছ, আগামী মঙ্গলবার।
এই বলেই তিনি ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন, লেডি আগাথা এবং অন্যন্য মহিলারা তাঁকে এগিয়ে দিতে পিছু পিছু গেলেন।
লর্ড হেনরি আবার বসে পড়লেন। মিঃ আরস্কিল নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন, লর্ড হেনরির কাছে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। একটা হাত তাঁর হাতের ওপরে রেখে বলেলন, আপনার কথা শুনলে আর বই পড়তে ইচ্ছে করে না। আপনি বই লেখেন না কেন? আমি বই পড়তে এত ভালোবাসি যে বই লেখার কথা ভাবার সময় পাইনে, মিঃ আরস্কিন। আমার একখানা উপন্যাস লেখার নিশ্চয় বাসানা রয়েছে। উপন্যাসটি হবে পার্শিয়ান। কার্পেটের মতো ঝলমলে, কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে তার এতটুকু সম্পর্ক থাকবে না। কিন্তু পড়বে কে? আজকাল ইংলন্ডের পাঠক-পাঠিকারা পড়েন কেবল খবরের কাগছে, আর এনসাইক্লোপিডিয়া। পৃথিবীর মধ্যে ইংরেজরাই বোধ হয় একমাত্র জাত সাহিত্যের সৌন্দর্য বলতে ঠিক কি বোঝায় সে-সম্বন্ধে যাদের ধারণা নেই বললেই হয়।