এইটুকু বলার পরেই তিনি কিছু ক্লান্তিকর একঘেয়ে ঘটনার পরিবেশন করতে লাগলেন। এবং যে-সব কথকরা ঘটনার বিশদ বর্ণানায় ক্লান্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি করে তিনিও তাদের মতো তাঁর শ্রোতাদের ক্লান্ত করে তুললেন। ডাচেস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাধা দিয়ে বললেন, আমেরিকাকে যদি কেউ কোনো দিন আবিষ্কার না করত তাহলে কত ভালো হল। সত্যি বলছি, আমাদের মেয়েদের আর হিল্লে হবে না। এটা খুব অন্যায়।
মিঃ আরস্কিন বললেন, সম্ভবত আমেরিকা আদৌ আবিষ্কৃত হয়নি। আমার কথা যদি ধরেন তাহলে আমি বলতে পারি যে আমেরিকাকে আমরা সবেমাত্র দেখতে পেয়েছি।
ডাচেস সাধারণভাবে বললেন, তাই বুঝি? আমি কিন্তু আমেরিকার অধিবাসীদের কিছু কিছু দেখেছি। আমি স্বীকার করতে বাধ্য যে তারা সত্যিই খুব সুন্দর। তাদের পোশাক-পরিচ্ছেদও বেশ ভালো। প্যারিস থেকেই তারা তাদের পোশাক তৈরি করায়। আমি যদি তা পারতাম!
স্যারা টমাস রসিকতা করে বললেন, এবং পুরনো পরিত্যক্ত রসিকতার বাণীতে তাঁর বিরাট আলমারি একবাসে ঠাসা। লোকে বলে, সৎ আমেরিকানরা মরার পর প্যারিসে যায়।
ডাচেস প্রশ্ন করলেন, বলেন কী? তাহলে মরার সময় খারাপ আমেরিকানরা কোথায় যায়?
লর্ড হেনরি আস্তে আস্তে বললেন, আমেরিকায়।
স্যার টমাস ভ্রূকুটি করলেন, লেডি আগাথাকে বললেন, আমার সন্দেহ হচ্ছে, আমেরিকার বিরুদ্ধে আপনার ভাইপোর মনে কিছু ভ্রান্ত ধারণা বদ্ধমূল হয়ে রয়েছে। সমস্ত দেশটা আমি গাড়িতে করে ঘুরেছি। অবশ্য ডায়রেকটাররাই সেই গাড়ির বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। এসব বিষয়ে ওরা বেশ ভদ্র। আমি আপনাদের নির্ভয়ে বলতে পারি যে আমেরিকাতে শেখার জিনিস অনেক রয়েছে।
মিঃ আরস্কিন করুণাভাবে প্রশ্ন করলেন, কিন্তু কিছু শেখার জন্যে আমাদের শিকাগোতে কি যেতেই হবে? আমার তো মনে হয় তার জন্যে যাওয়ার ঝক্কি পোষাবে না।
স্যার টমাস হাত নেড়ে বললেন, ট্রেডলির মিঃ আরস্কিনের ঘরে সারা পৃথিবী ঢোকানো রয়েছে। বাস্তববাদী আমাদের মতো মানুষ নিজেদের চোখে সব কিছু দেখতে চায়, বই পড়ে তাদের আশা মেটে না। আমেরিকানরা সত্যিকারের হৃদয়গ্রাহী মানুষ। তাদের কাজ অথবা কথার মধ্যে যুক্তিহীনতার স্থান নেই। আমার মতে ওইটিই তাদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। হ্যাঁ, মিঃ আরস্কিন, সত্যিকারের যুক্তিবাদী ওরা। আমি আপনাদের নিশ্চিতভাবে বলতে পারি বাজে কথা অথবা বাজে কাজের ধার দিয়ে তারা হাঁটে না।
লর্ড হেনরি বললেন, কী বিপদ, কী বিপদ! পাশবিক শক্তি আমি সহ্য করতে পারি, কিন্তু কঠোর যুক্তিবাদ আমার অসহ্য। এই যুক্তি ব্যবহার করার বিপক্ষে কিছু বলার নেই। কিন্তু যুক্তির রাজত্বে ওইটাই হচ্ছে নাভির তলায় আঘাত করার মতো অযৌক্তিক।
চটে লাল হয়ে স্যার টমাস বললেন, আপনার বক্তব্যটা আমার মাথায় ঢুকছে না।
মিঃ আরস্কিন হেসে বললেন, আমার মাথায় ঢুকছে, লর্ড হেনরি। ব্যারনেট যোগ দিলেন, প্যারাজকস্ অর্থাৎ কূটাভাস হিসাবে কথাটা একরকম সত্যি…
মিঃ আরস্কিন বললেন, কূটাভাস! ওঁর কথার মধ্যে কূটের আভাসটা কোথায় দেখলেন? আমার তা মনে হয়নি। হয়তো আপনার কথাই সত্যি। সত্যের রীতিটাই হচ্ছে কুটা সত্যকে যাচাই করতে গেলে আমাদের সরু শক্ত দডির ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। সেই দডির ওপর দিয়ে নিশ্চিন্ত হেঁটে চলার নির্ভরতা অর্জন করতে পারলেই তবে আমরা সত্য উপলব্ধি করতে পারব।
লেডি আগাথা বললেন, হায় ভগবান, পুরুষরা কীরকম তর্ক করে দেখ! সত্যি বলছি, তোমরা কী সব তর্ক করছ তার কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না। আর হ্যারি, তোমার ওপরে আমি খুব বিরক্ত হয়েছি। আমাদের প্রিয় ডোরিয়েন গ্রেকে ইস্ট এন্ড ছেড়ে যাওয়ার জন্যে তুমি তাঁকে তাতাচ্ছে কেন? আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি এখানে তাঁর উপস্থিতি নিঃসন্দেহে মূল্যবান। এখানের সবাই তাঁর পিয়ানো বাজানো শুনেতে ভালোবাসে।
লর্ড হেনরি হেসে বললেন, আমি চাই তাঁর বাজনা আমি শুনবো।
এই বলেই তিনি টেবিলের দিকে তাকালেন, ডোরিয়েন গ্রে-র সম্মতিনেক দৃষ্টির সঙ্গে চোখাচোখি হল তাঁর।
লেডি আগাথা বললেন, কিন্তু হোয়াইট চ্যাপেলের সবাই বড়ো কষ্ট পাচ্ছে।
লর্ড হেনরি কাঁধে ত্যাগ করে বললেন, দুঃখ ছাড়া সব জিনিসের ওপরেই আমার সহানুভূতি রয়েছে। ওই দুঃখবোধের ওপরে আমার কোনো সহানুভূতি নেই। কেউ যন্ত্রণা পেলে আভকাল মানুষরা তাকে সহানুভূতি জানায়। এটাই হচ্ছে একটা ভয়ঙ্কর রকমের মানসিক ব্যাধি। মানুষের উচিত রঙ, সৌন্দর্য আর আনন্দের সঙ্গে সহানুভূতি জানানো। জীবনের দুঃখ সম্বন্ধে যত কম বলা যায় ততই ভালো।
স্যার টমাস গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বললেন, তবু জরুরি সমস্যাটা হচ্ছে ইস্ট এন্ড।
লর্ড হেনরি বললেন, ঠিক কথা। এ সমস্যা হচ্ছে দাসত্বের। ক্রীতদাসদের মনে ফুর্তি জাগিয়ে আমরা সেই সমস্যার সমাধান করতে চাই।
রাজনীতিবিদটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে আপনি কী করতে চান?
লর্ড হেনরি হাসলেন, এক আবহাওয়া ছাড়া ইংলন্ডে আর কিছুই আমি পরিবর্তন করতে চাই না। দার্শনিক চিন্তা করেই আমি খুশি। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীতে মানুষ সহানুভূতি খরচ করে করে একেবারে দেউলে হয়ে গিয়েছে, আমি তাই বিজ্ঞানের কাছে আবেদন রাখছি সে যেন মানুষকে ঠিক পথে চালিত করে। উচ্ছ্বাস-আবেগের সুবিধে হচ্ছে এ মানুষকে বিপদে পরলিচালিত করে, আর বিজ্ঞানের সুবিধে হচ্ছে তার কাছে উচ্ছ্বাসের কোনো দাম নেই।