আর বেসিল! মনস্তত্ত্বের দিকে থেকে আর ক্রিয়াকলাপ লক্ষ করা কত কৌতুককর। আর্টের নতুন আঙ্গিকস, জীবনকে দেখার নতুন রীতি তিনি কী সুন্দরভাবেই না ফুটিয়ে তুলেছেন। অথচ যার প্রতিকৃতির মধ্যে দিয়ে তিনি এই পরীক্ষা করলেন সে তা জানতেও পারল না। যে নির্বাক আত্মা এতদিন কুয়াশাচ্ছন্ন বনপ্রদেশে ঘুমিয়েছিল এবং উন্মুক্ত প্রান্তরে অদৃশ্যভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সেই আত্মাটি যেন হঠাৎ বন্য-অন্সরীর মতো নিজেকে প্রকাশ করে দিল। এই আত্মাটিকে প্রকাশ করার জন্যে তিনি কিছুমাত্র সঙ্কোচ বোধ করেননি। কারণ তিনি জানতেন এরই মাধ্যমে অপরূপ সৃষ্টি সম্ভব, সেই আত্মার দ্যুতিতে পৃথিবীর যা কিছু সাধারণ তাই অসাধরণত্ব লাভ করে। অসাধারণত্ব লাভ করে সত্যিকার বাস্তবে রূপায়িত হয়। কী আশ্চর্য অনুভূতি-কী অপরূপ সৃজন দক্ষতা!
ইতিহাসে এরকম দৃষ্টান্তের কথা কোথায় যেন তিনি পড়েছিলেন। চিন্তাকুশলী প্লেটোই কি এই দহষ্কতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেননি? কিন্তু আমাদের দেশে এর নজির নেই। চিত্রকর বেসিল-এর কাছে নিজের অজ্ঞাতসারেই ডোরিয়েন গ্রে যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে ঠিক সেইভাবেই হেনরি তাকে প্রতিফলিত করবেন। তিনি তার ওপরে নিজের প্রভাব বিস্তার। করবেন, সম্পূর্ণভাবে অধিকার করবেন তার চিন্তার জগৎ। অর্ধেকটা তার প্রায় অধিকার করেই ফেলেছেন। সেই অনবদ্য আত্মাটিকে তিনি তাঁর নিজস্ব করে নেবেন। ভগবানের এই অদ্ভুত সন্তানটির মধ্যে রয়েছে একটি দুর্নিবার আকর্ষণ।
হঠাৎ তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন, চারপাশের বাড়িগুলির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তিনি তাঁর কাকিমার বাড়ি অনেকটা পেছনে ফেলে এসেছেন, একটু হেসে তিনি ফিরলেন। কাকিমার থমথমে বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই বাটলার তাঁকে জানালেন যে সবাই লাঞ্চের ঘরে রয়েছেন। একটি চারককে তাঁর টুপি আর ছডিটা দিয়ে তিনি ডাইনিং ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।
তাঁর দিকে মাথা নেড়ে আনট বললেন, হ্যারি, আজ-ও তোমার দেরি হয়েছে–স্বভাব যাবে কোথায়?
হেনরি একটা জুতসই কৈফিয়ৎ দিয়ে তাঁর পাশের ফাঁকা চেয়ারটায় বসলেন, চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন কে কে এসেছেন। টেবিলের একপ্রান্ত থেকে ডোরিয়েন তাঁর দিকে লজ্জিত ভাবে একবার তাকালেন। হ্যাঁ গালের ওপরে আনন্দের একটা মৃদু রেখা ফুটে উঠল। বিপরীত দিকে বসেছেন হার্লের ডাচেস পরিচিত মহলে ভদ্র বলে তাঁর পরিচিতি রয়েছে, এবং তাঁর শরীরের গঠন দেখে সমসাময়িক ইতিহাসকাররা ডাচেস নয় এই রকম সব মহিলাদের শক্ত-সমর্থ বলে রায় দেন। তাঁর পাশে, ডান দিকে বসেছেন স্যার টমাস বার্ডন। ইনি পার্লামন্টের ব্যাডিক্যাল সদস্য। বাইরের জগতে ইনি এঁর দলীয় নেতাকে অনুসরণ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে অনুসরণ করেন পাকা রাঁধুনিদের চরিত্রের দিক থেকে বিজ্ঞ মানুষ এবং বহুল প্রচারিত বিভ্র নীতির মতোই তিনি খানাপিনা করতেন টোরিদের সঙ্গে, চিন্তা করতেন। লিবারেলদের মতো। তাঁর বাঁদিকের চেযাটিতে বসেছেন ট্রেডলির মিঃ এর্কস্কিন, সুন্দর। চেহারার সংস্কৃতিবান একটি বৃদ্ধ। চুপচাপ বসে আছেন তিনি, চুপচাপ থাকার কারণটা লেডি আগাথাকে তিনি একবার বলেছিলেন। কারণটি হচ্ছে তাঁর বলার আর কিছু নেই, যা বলার ছিল তা তিরিশ বছরের মধ্যেই তিনি বলে শেষ করে ফেলেছেন। হেনরির নিজের পাশে। বসেছিলেন মিসেলস ভ্যানডেলার, ভদ্রমহিলা তাঁর আনট-এর একজন পুরনো বন্ধু, মানুষ হিসাবে একেবারে খাঁটি সোনা। কিন্তু পোশাক-আশাকে এবং চেহারায় একেবারে নিকৃষ্ট। তাঁকে দেখে রদ্দি বাঁধাই একটি প্রার্থনার বইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। তার কপাল ভালো যে সেই সময় লেডি আগাথা লর্ড ফডেল-এর সঙ্গে তখন তন্ময় হয়ে কথা বলেছিলেন। ভদ্রলোক মধ্যবয়শী, বুদ্ধির দিক থেকে মাঝামাঝি হাউস-অফ-কমনস-এ মন্ত্রীর ঘোষণার মতো যাঁর মাথাটা ছিল টোটো। একটা তন্ময় হয়ে দুজনে কথা বলছিলেন যেটা তাঁর মতে একটি বিশেষ ত্রুটি। প্রতিটি সৎ মানুষটা এই ত্রুটির শিকার এবং এর হাত থেকে মুখ কম মানুষই নিস্তার পেয়েছে।
টেবিলের পাশ থেকে তেরচাভাবে তাকিয়ে মিষ্টি সুরে ডাচেস তাঁকে সম্বোধন করে বললেন, আমরা বেচারা ডার্টমুরের সম্বন্ধে আলোচনা করছিলাম, হেনরি। তোমার কি মনে হয় ডার্টমুরর এই কুহকিনী যুবতীটিকে সত্যিই বিয়ে করবে?
আমার বিশ্বাস, মেয়েটি ডার্টমুরকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে মনস্থির করে ফেলেছে, ডাচেস।
চিৎকার করে উঠলেন লেডি অগাথা, কী ভয়ঙ্কর! সত্যি বলছি, এ ব্যাপারে কারো না কারো প্রতিবাদ করা উচিত।
স্যার টমাস বার্ডান উদ্ধতভাবে বললেন, আমি খুব ভালো জায়গা থেকে শুনেছি, মেয়েটির বারার শুকনো খাবারের দোকান রয়েছে।
স্যার টমাস, আমার কাকা বলেছেন দোকানটা শুয়োরের মাংস প্যাক করার।
শুকনো খাবার! আমেরিকান শুকনো জিনিস বলতে কী বোঝাতে চাও তোমারা! বেশ উত্তেজিত ভাবে অবাক হয়েই ডাচেস তাঁর বড়ো বড়ো হাত দুটি তুলে প্রশ্ন করলেন।
কিঞ্চিৎ সঙ্কুচিত হয়ে লর্ড হেনরি বললেন, আমেরিকান নভেল।
হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন ডাচেস।
লেডি আঘাথা ফিস ফিস করে বললেন, ওর কথা তোমরা কেউ বিশ্বাস করো না। ও একবিন্দু সত্যি কথা বলে না।
র্যাডাক্যাল সদস্যটি বললেন, যখন আমেরিকান আবিষ্কার করা হল….।