আঙ্কল জর্জ, এখন আমেরিকান বিয়ে করাই তো ফ্যাশান।
টেবিলের ওপরে ঘুষি মেরে লর্ড ফারমোর বললেন, পৃথিবীর সমস্ত মেয়েদের মধ্যে ইংরেজ মেয়েরাই শ্রেষ্ঠ, হ্যারি। একথা আমি জোর করেই বলতে পারি।
সেদিক থেকে আমেরিকান মেয়েদেরই আমাদের দেশের ছেলেরা বেশি পছন্দ করে, একথা আমি বাজি রেখে বলতে পারি।
তাঁর কাকা বিড়বিড় করলেন, আমি শুনেছি, আমেরিকাল মেয়েরা বেশিদিন টেকে না।
দীর্ঘদিন ধরে প্রণয়লীলা তাদের ক্লান্ত করে তোলে, কিন্তু বেড়াবাজির দৌড়ে তারা অনবদ্য। ঘোড়ার মতো সব সময়েই তারা ছুটতে ভালোবাসে। ডার্টমুর-এর কোনো আশা রয়েছে বলে আমার মনে হয় না।
বৃদ্ধ ভদ্রলোক গজগজ করে জিজ্ঞাসা করলেন, মেয়েটির আত্মীয়স্বজন কেন জান? আছে কেউ?
লর্ড হেনরি মাথা নাড়লেন, আমেরিকান মহিলারা তাদের বাপ-মায়ের পরিচয় লুকিয়ে রাখে, ঠিক যেমন ইংরেজ মহিলার লুকিয়ে রাখে তাদের অতীত জীবনের কাহিনি।
তারা শুয়োর মাংসের ব্যবসা করে, তাই না?
ডার্টমুরের দিক থেকে ভাবলে ব্যাপারটা সেই রকমই দাঁড়ায় বটে, আঙ্কল জর্জ, শুনেছি, আমেরিকাতে রাজলীতির পরেই যে ব্যবসাটা জমজমাট হয়ে উঠেছে তা হচ্ছে ওই শুয়োর মাংসের ব্যবসা।
মেয়েটি কি দেখতে ভালো? তার ধারণা সে সুন্দরী। বেশির ভাগ আমেরিকান মহিলারা নিজেদের সুন্দরী বলে মনে করে। তাদের লাবণ্যের এইটাই হচ্ছে গোপন কথা।
এই সব আমেরিকান মহিলার নিজেদের দেশে কেন থাকতে পারে না বল তো? তারা তো সব সময়েই বলে বেড়াচ্ছে যে আমেরিকা হচ্ছে স্বর্গ।
তাই বটে। লর্ড হেনরি বললেন, বিশেষ করে সেই জন্যেই ইভ-এর মতো সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে তারা ব্যাকুল। এখন আমি চলি আঙ্কল ভর্ত। এখানে আর বেশিণ অপেক্ষা করলে লাঞ্চের দেরি হয়ে যাবে। আমি যে সংবাদ জানতে চাই সেইটুকু আমাকে দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ। নতুন বন্ধুদের সম্বন্ধে সব সময় আমি কিছু জানতে চাই। পুরনো বন্ধুদের সম্বন্ধে কোনো আগ্রহ নেই।
আজ কোথায় লাঞ্চ খাচ্ছ হ্যারি?
আনট আগাথার বাড়িতে আমি আর মিঃ গ্রে দুজনেই যাচ্ছি। তিনিই হচ্ছেন তাঁর সর্বাধুনিক অনুগৃহীত।
হুম। হ্যারি, তোমার আট আগাথাকে ডঘনিয়ে দিয়ো তিনি আর যেন চাঁদা দেওয়ার জন্যে বিরক্ত না করেন। আমি তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছি। ভদ্রমহিলা মনে করেন তাঁর ওইসব বদ খেল চরিতার্থ করার জন্যে চেক কাটা ছাড়া আর কোনো কাজ আমার নেই।
ঠিক আছে আঙ্কল ভক্ত, তোমার কথা আমি তাঁকে জানিয়ে দেব, কিন্তু তাতে কোনো কাভ হবে না। পরোপকারী ব্যক্তিদের মনুষ্যত্ব বলে কোনো বোধশক্তি নেই। এইটাই হচ্ছে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে শব্দ করলেন, তারপরে চাকরকে ডাকার জন্যে বেল বাজালেন। নীচু খিলান পেরিযে লর্ড হেনানি বার্লিংটন স্ট্রিটে গিয়ে পড়লেন, তারপরে এগিয়ে চললেন বার্কলে স্কোয়ারের দিকে।
তাহলে ডোরিয়েন গ্রের বাবা আর মায়ের কাহিনীটা হল এই? কাহিনিটি যত অমার্জিত ভাবেই বলা হোক না কেন, একটা অদ্ভুত, যাকে বলে বলে আধুনিক রোমান্সের গন্ধে তাঁর মন ভরে উঠেছিল। উন্মাদ আবেগের জন্য একটি সুন্দরী যুবতী জীবনের সবকিছু ঝুঁকি নিয়েছিলেন। কয়েকটি সপ্তাহের উন্মাদ আনন্দ। তারপরেই একটি ভয়ঙ্কর বিশ্বাসঘাতক অপরাধ তাঁর সেই জীবনকে কেটে ছোটো করে দিল। কয়েকটি মাসের নির্বাক যন্ত্রণার পরে ৬ন্ম হল একটি ছেলের মৃত্যু ছিনিয়ে নিল মাকে, নিঃসঙ্গ শিশুটি পড়ে রইল এমন একটি মানুষের কাছে যার মনে স্নেহ ছিল না, ছিল না কোনো ভালোবাসা। হ্যাঁ, এইটিই হচ্ছে ছেলেটির জীবনের পটভূমি। এই পরিস্থিতিতেই সে মানুষ হয়েছে, সম্ভবত এইটাই যেন তাকে পূর্ণ করে তুলেছে। প্রতিটি অপরূপ সৃষ্টির পেছনে রয়েছে এই রকমের একটি যন্ত্রণা, একটি দাহাসামন্য একটি ফুল ফোঁটানোর জন্যেও পৃথিবীকে, প্রকৃতিকে কত কষ্টই না সহ্য করতে হয়। গত রাত্রিতে ডিনার-এর সময় কী সুন্দরই না দেখাচ্ছিল তাঁকে! সন্ত্রস্ত চোখে আর ঠোঁট দুটি ফাঁক করে একটি উদ্বিগ্ন আনন্দ নিয়ে ক্লাবে ঠিক তাঁর মুখোমুখি বসে ছিলেন তিনি। বাতির লাল রঙের ঢাকনি থেকে রঙিন আলোর দ্যুতি তাঁর মুখের ওপরে ছড়িয়ে পড়ে গণ্ড দুটিকে গোলাপ রঙে রাঙিয়ে দিয়েছিল। তাঁর সঙ্গে আলাপ করা আর একটি প্রথম শ্রেণির বেহালার ঝঙ্কার তোলার মধ্যে কোনো ফারাক নেই। প্রতিটি কথা আর ইঙ্গিতের উত্তর তিনি দিয়েছিলেন। প্রভাব বিস্তার করার মধ্যে একটি চরম দাসত্বের গন্ধ রয়েছে। আর কোনো কাজই বোধ হয় ঠিক এরকমাটি নয। এইভাবে নিজের আত্মাটিকে অপর একটি শরীরের মধ্যে অনুপ্রবেশ করিয়ে দাও। একটু অপেক্ষা কর, তারপরে কান পেতে শোন। যৌবনের আবেগে ঝক্ত হয়ে তোমারই চিন্তাধারা নতুনভাবে রূপায়িত হবে, নতুন তার ব্যঞ্জনা, দ্যোতনা নতুন। নিজের চিন্তাধারা আর একজনের ভাবরসে সিঞ্চিত হয়ে প্রকাশ পাওয়ার মধ্যে সুখকর বস্তু আর নেই। মনে হবে একটি অতীন্দ্রিয় সুবাসের জারক রসে সঙ্গীরিত হয়ে মধুর মোত তা একটু একটু করে ঝরে পড়ছে। আমাদের এই সীমিত, অশালীন যুগে, আত্মসর্বস্ব এবং দেহ আনন্দে যখন আমরা সবাই মতোয়ারা, সেই সময় এই রকম একটি অনুভূতি যে নিঃসন্দেহে চিত্তাকর্ষক সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সত্যিই বড়ো অদ্ভুত এই ছেলেটি। বেসিল-এর স্টুডিওতে তার সঙ্গে লর্ড হেনরির নেহাৎ আকস্মিকভাবেই আলাপ হয়েছিল। প্রাচীন গ্রিসের ভাস্কর্যের মতো তার গঠন, তার লালিত্যা বিশ্বে এমন কিছু নেই যা তাকে দিয়ে করানো যায় না। তাকে দিয়ে মহীরুহ সৃষ্টি করা যায় অথবা খেলার পুতুলের মতোও ব্যবহার করা যায় তাকে। এই সৌন্দর্য বিবর্ণ হয়ে যাবে–এটা কী দুঃখের কথা!