ইংলিশ ব্লু-বুক-এ যা রয়েছে তার সবটুকুই আমি তোমাকে বলতে পারি। অবশ্য আজকাল লোকগুলো যা-তা লিখে যাচ্ছে। আমি যখন ডিপ্লোম্যাটিক সার্ভিসে ছিলাম তখন এখানকার চেয়ে লোকে আরো অনেক ভালো লিখত। কিন্তু শুনছি ওরা আজকাল পরীক্ষা করে ওই সব চাকরিতে লোক নিচ্ছে। কী তুমি আশা কর? পরীহষ্কাটা নিছক প্রতারণা ছাড়া আর কী বল? মানুষ যদি ভদ্রলোক হয় তাহলে তার সব জিনিসই ডানা হয়ে যায়, আর যদি সে তা না হয়, তাহলে সে যতটুকু শেখে তার সবটুকুই তার ক্ষতি করে।
লর্ড হেনরি কিছুটা বিকৃত স্বরেই বললেন, তোমার ওই সব সরকারি কেতাবে মিঃ ডোরিয়েন গ্রে-র সম্বন্ধে কিছু লেখা নেই, আঙ্কল জর্জ।
সাদা চুলে ভরা ভুরু দুটি কুঁচকিয়ে লর্ড ফারমোর জিজ্ঞাস করলেন, মিঃ ডোরিয়েন গ্রে? কে বল তো?
সেইটাই তো আমি জানতে এসেছি, আঙ্কল জর্জ। অথবা বলতেও পার আমি তা জানি, তিনি হচ্ছেন শেষ লর্ড কেলসোর নাতি। তাঁর মা ছিলেন দেবেরু, লেডি মার্গারেট দেবেরু। তাঁর আমাকে কিছু বল। তিনি কেমন দেখতে ছিলেন? তিনি বিয়ে করেছিলেন কাকে? তোমার সময়কার প্রায় সকলকেই তুমি চিনতে, তাঁকেও হয়তো তুমি জানতে পার। বর্তমানে মিঃ গ্রে-র সম্বন্ধে কিছু জানার কৌতূহল আমার হয়েছে। তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে সবেমাত্র।
বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি লর্ড হেনরির স্বর অনুকরণ করে বললেন, কেলাসোর নাতি! কেলাসোর। নাতি! হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়। তার মা-কে আমি খুব ভালো করেই জানতাম। মনে হচ্ছে তার যখন খ্রিশ্চানিং হল সেই থেকেই তাকে আমি ডানি। অপরূপ সুন্দরী বলতে যা বোঝায় সে ছিল সেই রকম মেয়ে–এই মার্গারেট দেবেরু। একটা কপর্দশূন্য ছোকরার সঙ্গে পালিয়ে গেল মেয়েটা। এই দেখে সবাই তো খাপ্পা। ছোকরাটার কিছুই ছিল না, পদাতিক সেনাবাহিনীতে সামান্য বেয়ারা ছিল মাত্র, কিম্বা ওই জাতীয় সামান্য একটা চাকরি করত। নিশ্চয়। মনে হচ্ছে এই সেদিনের কথা। বিয়ের কয়েক মাস পরেই স্পা-তে একটা দ্বন্দ্বযুদ্ধে ছোকরাটা মারা যায়। এ-সম্বন্ধে একটা নোংরা কথাও অবশ্য শোনা যায়। লোকে বলে কেলসো নাকি একটা। বেলজিয়াম গুণ্ডাকে তার পেছনে লেলিয়ে দেয়। গুণ্ডাটা প্রকাশ্য রাস্তার ওপরে জামাইকে অপমান করে। এর জন্যে কিছু অর্থও ঢালতে হয়েছিল তাকে। তারপরেই যা ঘটার ঘটল। লোকে যেমন ভাবে পায়রা জবাই করে সেই গুণ্ডটাও ঠিক তেমনিভাবে একদিন সেই ছোকরাকে শেষ করে ফেলল। ব্যাপারটা চেপে দেওয়া হল বটে, কিন্তু সেই থেকে বেশ কিছুদিন কেলসোর সঙ্গে বিশেষ কেউ আর মেলামেশা করত না। বেচারাকে ক্লাবে বসে একাই খাওয়া শেষ করতে হত। শুনেছি সে তার মেয়েকে আর নিজের বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছিল। সেই মেয়ে কিন্তু তার বাবার সঙ্গে জীবনে আর কোনদিন কথা বলেনি। না, না, কাজটা কেলসো ভালো করেনি। মেয়েটাও মারা গেল–এক বছরের মধ্যেই। তার একটা ছেলে ছিল। তাই কি? আমার মনে নেই। কেমন দেখতে বল তো? যদি তার মায়ের মতো হয় তাহলে ছোকরাটাকে নিশ্চয় সুন্দর-ই বলতে হবে।
সায় দিলেন লর্ড হেনরি, দেখতে ছেলেটি বেশ সুন্দরই বটে।
বৃদ্ধ লোকটি বলে চললেন, আশা করি উপযুক্ত মানুষের হাতেই সে পড়বে। কেলসো যদি তার জন্যে যতটুকু করা উচিত তাই করে যায় তাহলে অনেক টাকার মালিক সে হবে। তার মায়ের ঠাকুরদার মারফৎ সেলবি-র সমস্ত সম্পত্তি তার মা পেয়েছিল। তার ঠাকুরদা। কেলসোকে ঘৃণা করতেন, তাঁর মতে কেলসো ছিল একটা ঘৃণ্য কুকুর। কথাটা মিথ্যে নয। আমি যখন মাদ্রিদে ছিলাম সেই সময় একবার তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, সত্যি বুলছি, তাকে দেখে আমি তখন লজ্জিত হয়েছিলাম। রানি একবার আমাকে জিজ্ঞাসা। করেছিলেন, আচ্ছা, ভাড়া নিয়ে কোচোযানের সঙ্গে সব সময়ে ঝগড়া করেন ওই ইংরেজ ভদ্রলোকটি কে বলুন তো? এই নিয়ে স্থানীয় লোকেরা বেশ একটা মুখরোচক গল্পই রচনা করে বসল। তোমাকে কী বলব, মাসখানেক আমি কোর্টে মুখ দেখাতে পারিনি। আমার ধারণা নাতির সঙ্গে সে খুব একটা ভালো ব্যবহার করত না।
লর্ড হেনরি বললেন, তা আমি জানি না। আমার ধারণা, ছেলেটির যথেষ্ট অর্থ রয়েছে। তবে সে এখনো সাবালক হয়নি। সেলবি যে তাঁর আত্মীয় সেকথা আমি জানি, তিনিই আমাকে তা বলেছেন। আর…তাঁর মা খুব সুন্দরী ছিলেন, তাই না?
আমার মতে মার্গারেট দেবেরু সবচেয়ে সুন্দরী রমণী, যাকে বলে পরমা সুন্দরী। সে যে কেন। অমন কাজ করল তা আমি জানি না। কত ভালো পাত্র ছিল। তাদের যাকে খুশি তাকেই সে। বিয়ে করতে পারত। কার্লিংটন তো তাকে বিয়ে করার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছিল। রোমান্টিক বলতে তোমরা যা বোঝা মার্গারেট ছিল তা-ই। আর শুধু তার কথাই বা বলি কেন, ওই বংশের সব মহিলারাই ওই রকম। পুরুষ মানুষরা অতি সাধারণ, কিন্তু মেয়েরা অসাধারণ। কার্লিংটন তার কাছে নতজানু হয়ে প্রেম ভিক্ষা করেছিল, সেকথা সে আমাকে নিজেই বলেছিল। মার্গারেট তাকে বিদ্রূপ করে হাসতা বিবেচনা কর, লন্ডনে এমন কোনো যুবতী ছিল না যে কার্লিংটনকে বিয়ে করার জন্যে পাগল হয়ে ছোটাছুটি না করত। আচ্ছা হ্যারি বিয়ের কথা যখন উঠলই তখন একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। ডার্টমুর নাকি একটি আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে করতে চায়? কোনো ইংরেজ যুবতীই কি তার যোগ্য নয়?