হলওয়ার্ড বললেন, তুমি আজ থিয়েটারে যোযো না ডোরিযেত। এখানে রয়ে যাও। রাত্রিতে আমরা একসঙ্গে ডিনার খাব।
না, বেসিল।
কেন?
কারণ লর্ড হেনরির কাছে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার জন্য ওর কাছে তোমার দাম বাড়বে না। নিজের প্রতিজ্ঞাই ও ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলে। আমি অনুরোধ করছি তুমি যেয়ো না।
হেসে মাথা নাড়লেন ডোরিয়েন।
আমি তোমাকে অনুরোধ করছি।
ডোরিয়েন ইতস্তত করতে লাগলেন। চায়ের টেবিলে বসে লর্ড হেনরি বেশ রসিকতার দৃষ্টি দিয়ে তাঁদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন।
ডোরিয়েন বললেন, আমাকে যেতেই হবে বেসিল।
হলওয়ার্ড বললেন, ঠিক আছে।
তিনি ফিরে গিয়ে চায়ের কাপটা টেবিলের ওপরে রেখে দিলেন, বললেন, এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। তোমাদের আবার পোশাক পালটাতে হবে। বিদায় হ্যারি। বিদায় ডোরিয়েন। তাড়াতাড়ি একদিন এস। কালকেই।
নিশ্চয়।
ভুলে যাবে না?
না, নিশ্চয় না।
আর…হ্যারি?
বলুন বেসিল।
আজকে সকালে তোমাকে কী বলেছিলাম মনে করে দেখা
আমার মনে নেই।
তোমার ওপরে আমার বিশ্বাস রয়েছে।
লর্ড হেনরি হেসে বললেন, আমি যদি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারতাম! আসুন, মিঃ গ্রে, বাইরে আমার গাড়ি দাঁড়িয়ে। আপনাকে আমি যথাস্থানে নামিয়ে দেব। বেসিল, চললাম, আজকের বিকালটা বেশ ভালোই কাটল।
তাঁদের পেছলে দরজাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেসিল সোফার ওপরে ঢলে পড়লেন। তাঁর চোখের ভেতর থেকে একটি ক্লিষ্ট বেদনার জ্যোতি বেরিয়ে এল।
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
পরের দিন বেলা সাড়ে বারোটার সময় লর্ড হেনরি ওটোন কার্ডন স্ট্রিট থেকে বেড়াতে বেড়াতে তাঁর কাকার সঙ্গে দেখা করার জন্যে অ্যালব্যানির দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর কাকা। হচ্ছেন লর্ড ফারমোর, বৃদ্ধ এবং অবিবাহিতা বাইরে থেকে কিছুটা রুক্ষ মনে হলেও, আসলে। তিনি ছিলেন মিষ্টি স্বভাবের। তাঁর সমাজের বাইরের লোকেরা তাঁকে স্বার্থপর বলে চিহ্নিত করত, কারণ তার কাছ তাঁরা কোনো উপকার পেত না। অথচ তাঁর নিজস্ব সমাড়ে দিলদরিযা বলে নামডাক ছিল তাঁর। কারণ যারা তাঁকে খুশি করতে পারত তাদের তিনি ভূরিভোজনে আপ্যায়িত করতেন। ইসাবেলা যখন যুবতী ছিলেন সেই সময় তাঁর বাবা মাদ্রিদে আমাদের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ব্যাপরটা অচিন্ত্যনীয়, কিন্তু সত্য যে প্যারিসের দূতাবাসে রাষ্ট্রদূতের পদ না। পাওয়ায় বিরক্ত হয়ে খামাখেয়ালি করে তিনি কূটনৈতিক চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বসেন। তিনি বিশ্বাস করতেন উচ্চ বংশ, আলস্য সরকারি চিঠিপত্র লেখার যোগ্যতা এবং আমোদ-প্রমোদের অযৌক্তিক সম্পৃহার দিক থেকে বিচার করলে ওই পদটির যোগ্যতম প্রার্থী ছিলেন একমাত্র তিনিই। পত্রটি ছিলেন তাঁর পিতার সেক্রেটারি। পিতার সঙ্গে সঙ্গে পুত্রও চাকরিতে ইস্তফা দেন, সে সময়ে সকলেই ভেবেছিল কাজটা তাঁর নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। হয়েছিল; এবং কিছুদিন পরে পিতার খেতাবের অধিকারী হয়ে অভিজাত সম্প্রদায়ের যেটি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কলা–সেই কিছু-না-করার চর্চার তিনি মশগুল হয়ে রইলেন। শহরে তাঁর দুটি বড়ো বাড়ি ছিল, বেশি ঝামেলা এড়ানোর জন্য তিনি ছোটো বাড়িতে বাস করতে ভালোবাসতেন, খাওয়া-দাওয়া করতেন ক্লাবে। মিডল্যান্ড-এ তাঁর যে সব কয়লার খনি ছিল সেগুলি দেখাশোনা করতেন কিছুটা। পৃথিবীতে এত ডিজনিস থাকতে তিনি কলার ব্যবসাতে মেতেছেন কেন কেউ এই প্রশ্ন করলে তিনি প্রায়শই বলেন যে ওইটাই একমাত্র জিনিস যা ভদ্রলোকেরা নিজেদের বাড়িতে জ্বালানোর ভব্যতা অর্জন করেন। রাজনীতির দিক থেকে তিনি ছিলেন টোরি সম্প্রদায়ভুক্ত। যখন অবশ্য টোরিয়া সরকার গঠন করতে অসমর্থন হত, সেই সময় তিনি তাদের একদল ব্র্যাডিক্যাল বলে যথার্থই গালাগালি দিতেন। নিজের পরিচারকের কাছে তিনি ছিলেন বীরপুরুষ যদিও সেই পরিচারকটি সব সময় তাঁর কাছে তর্জন-গর্জন করত। বেশির ভাগ আত্মীয়-স্বজনরা তাঁকে রীতিমতো ভয় করত, কারণ তিনি প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাঁদের ধমক দিতেন। একমাত্র ইংলন্ডেই তাঁর মতো মানুষের জন্ম সম্ভব। এবং সব সময়েই তিনি অভিযোগ করতেন যে দেশটা একেবারে জাহান্নামে গিয়েছে। তাঁর সমস্ত নীতিগুলিই পুরনো যুগের, কিন্তু তাঁর যতগুলি খেয়াল অথবা বদখেয়াল রয়েছে তাদের সম্বন্ধে অনেক কিছুই বলা যায়।
লর্ড হেনরি ঘরে ঢুকে দেখলেন তাঁর কাকা লর্ড ফারমোর সাধারণ গোছের শিকারে-কোট গায়ে দিয়ে চুরুট খেতে খেতে টাইমস কাগজের ওপারে চোখ বুলোতে বুলোতে ঘোঁত-ঘোঁত করছেন।
বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি বললেন, আরে হ্যারি যে! এত সকালে? আমার ধারণা ছিল তোমাদের মতো সুখী ছোকরারা বেলা দুটোর আগে বিছানা থেকে ওঠে না। বিকাল পাঁচটার আগে টিকিট দেখা যায় না তাদের।
সত্যি বলছি কাকা, একেবারে ঘরোয়া ব্যাপার! কিছু পেতে এসেছি তোমার কাছ থেকে।
বিকৃত মুখে লর্ড ফারমোর বললেন, সম্ভবত টাকা চাই! ঠিক আছে, বসো। ব্যাপারটা কী খুলে বল আমাকে। আজকাল যুবকরা মনে করে টাকাটাই মানুষের সব।
কোটের বুকে বোতামটা লাগিয়ে লর্ড হেনরি ধীরে ধীরে বললেন, ঠিক বলেছ কাকা, এবং টাকার সত্যিকার দামটা যে কী তা তারা বড়ো হলেই বুঝতে পারে। আমি কিন্তু টাকা চাইতে আসিনি। আঙ্কল জর্জ, সত্যিকার টাকার দরকার তাদেরই যাদের জিনিসপত্রের দাম মেটাতে হয়। আমি কোনদিন ক্যাশ টাকা দিয়ে জিনিস কিনি না। ছোটো ছেলের ধারটাই হচ্ছে। একমাত্র মূলধন। ওর ওপরে বেশ আরাম করে বাঁচা যায়। তাছাড়া আমি সব সময় ডার্টমুরের ব্যবসাদারদের সঙ্গে কারবার করি। ফলে টাকা-পয়সা নিয়ে কোনোদিন তারা আমাকে বিরক্ত করে না। বর্তমানে আমি এখানে এসেছি কিছু সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য। অবশ্য এমন কিছু প্রয়োজনীয় সংবাদ নয়, একেবারে অপ্রয়োজনীয়।