একটা চাপা আর্তনাদ করে ছেলেটি সোফা থেকে লাফিয়ে উঠলেন, এবং দৌড়ে গিয়ে। হলওয়ার্ড-এর হাত থেকে ছুরিটা ছিনিয়ে নিলেন। ছুরিটাকে স্টুডিওর একধারে ছুঁড়ে ফেলে তিনি বললেন, বেসিল, ও কারো না, কো না। ওটা হত্যা ছাড়া আর কিছু নয়।
ডোরিয়েনের ক্রিয়াকলাপে চিত্রকর কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলেন। সেই বিস্ময় কাটার পরে তিনি একটু উদাসীনভাবেই বললেন, ডোরিয়েন তুমি যে শেষ পর্যন্ত আমার তৈরি প্রতিকৃতির মূল্য বুঝতে পেরেছে তা বুঝতে পেরে আমি খুশি হয়েছি। আমি ভাবতে পারিনি যে তুমি তা পারবে।
মূল্য বোঝার কথা বলছ? আমি এর প্রেমে পড়ে গিয়েছি, বেসিল। ওটা আমার অচ্ছেদ্য অংশ। এটা আমার মুখের নয়, মনের কথা।
ঠিক আছে তোমার ছবিটা শুকিয়ে গেলেই তাকে বার্নিশ করা হবে, বাঁধানো হবে ফ্রেম দিয়ে। তারপর তোমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তখন তোমার প্রতিকৃতিটা নিয়ে তোমার যা খুশি তা-ই করতে পারা।
এই কথা বলে তিনি ঘরের একপ্রান্তে এসে চা আনার জন্য বেল বাজালেন, ডোরিয়েন, নিশ্চয় তুমি চা খাবে? হ্যারি, তুমিও? অথবা এই সাধারণ আনন্দে তোমাদের কোনো আপত্তি রয়েচ্ছে।
লর্ড হেনরি বললেন, সাধারণ আনন্দকে আমি পুজো করি। জটিলতার শেষ আশ্রয় তারাই। কিন্তু একমাত্র স্টেডের ওপরে ছাড়া আমি হইচই পছন্দ করি না। তোমরা দুজনেই কি অদ্ভুত জীব বল তো? আমি ভেবে আশ্চর্য হই কে মানুষকে সামাজিক বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী বলে চিহ্নিত করেছেন। যত অপরিপক্ক ব্যাখ্যা রয়েছে এটি হচ্ছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে অর্বাচীন। মানুষ অনেক কিছু সন্দেহ নেই, কিন্তু সে আদৌ বিচারবুদ্ধিসম্মপন্ন নয়। সব দিক দিয়ে। ভাবতে গেলে সে যে মোটের ওপরে তা নয় এতে আমি খুশিই হয়েছি। যদিও আমি মনে করি একটা ছবি নিয়ে তোমাদের মতো ছোকরাদের এতটা কচকচি করা উচিত হয়নি। বেসিল, এত গোলমালে কাজ নেই। ওটা বরং আমাকে দিয়ে দাও। এই মূর্খ বালক সত্যি সত্যিই ওটা চায় না। আমি চাই।
ডোরিয়েন গ্রে চিৎকার করে উঠলেন, আমাকে না দিয়ে ও-ছবি যদি তুমি আর কাউকে তাহলে আমি তোমাকে কোনোদিনই ক্ষমা করব না, বেসিল এবং অন্য লোকে আমাকে বোকা বলবে তা-ও আমি সহ্য করব না।
ডোরিয়েন, তুমি জান এ ছবি তোমার। আঁকার আগেই এটা আমি তোমাকে দান করেছি।
এবং আপনি যে কিছুটা বোকার মতো কাজ করেছেন তা আপনি জানেন, মিঃ গ্রে। আপনাকে নিশ্চয় স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না যে আপনার বয়সটা খুব কাঁচা।
লর্ড হেনরি, আজ সকালেই আমার ভীষণ আপত্তি জানানো উচিত ছিল।
হ্যাঁ, আজকে সকাল! তখন থেকেই আপনি বেঁচে আছেন।
দরজায় একটি টোকা পড়ল, বাটলার একটা পেতলের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। তারপরে সেটিকে একটি ছোটো জাপানি টেবিলের ওপরে রেখে দিল। চায়ের কাপ আর সসারের টুঙ-টাঙ আওয়াজ হল, একটি চাকর বয়ে নিয়ে এল দুটি গোলাকার চায়না ডিশ। ওই দুজনে অবসন্নভাবে টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন ঢাকনির তলায কী রয়েছে।
লর্ড হেনরি বললেন, আজকে রাত্রিতে আমরা সবাই থিয়েটারে যাই চল। কোথাও না কোথাও নিশ্চয় কিছু-না-কিছু হচ্ছে। হোয়ইট-এ আভা আমার ডিনার খাওয়ার কথা। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তিটি হচ্ছে আমারই এক বৃদ্ধ বন্ধু। তাঁকে আমি একটা টেলিগ্রাম করে দেব, বলব শারীরিক অসুস্থতার জন্যে যেতে পারলাম না। অথবা হঠাৎ জরুরি কাজ পড়ায় যেতে পারলাম না। সেকথাও বলতে পারি। আমার ধারণা অজুহাত হিসাবে ওটা বেশ জুৎসই হবে। অকপটতার মধ্যে যত বিস্ময রয়েছে এটা হবে তাদের মধ্যে আর এক বিস্ময়।
হলওয়ার্ড বিড়-বিড় করলেন, এটা হচ্ছে নিজের পোশাক পরার মতো একঘেয়ে। পরার পরেই মনে হয় সেগুলি কত বিতিকিচ্ছিরি।
লর্ড হেনরি স্বপ্নিল চোখে বললেন, ঠিক কথা। উনবিংশ শতাব্দীর পোশাকই হচ্ছে জঘন্য এটা যেমন জাঁকালো তেমনি হতাশাব্যঞ্জক। আধুনিক জীবনে পাপই হচ্ছে একমাত্র রঙিন।
হ্যারি, ডোরিয়েনের কাছে ওই সব কথা বলা তোমার নিশ্চয় উচিত হচ্ছে না।
কোন ডোরিয়েনের কথা তুমি বলছ? যিনি এখন আমাদের জন্যে চা করছেন, তিনি? না, ওই ছবির ডোরিয়েন?
দুজনের কাছেই।
ডোরিয়েন বললেন, লর্ড হেনরি, আমি আজ আপনার সঙ্গে থিয়েটারে যাচ্ছি।
তাহলে আপনি আসুন। বেসিল, তুমিও নিশ্চয় আসছ। না কি?
না, সত্যিই যেতে পারব না। অনেক কাজ পড়ে রয়েছে আমার।
মিঃ গ্রে, এই পরিস্থিতিতে আমরা একাই যাব।
খুব খুশি হব আমি।
ঠোঁট কামড়ালেন চিত্রকর। তারপরে একটি কাপ হাতে নিয়ে তিনি ছবিটির দিকে এগিয়ে গেলেন। বিষণ্ণভাবে তিনি বললেন, আমি আসল ডোরিয়েলের সঙ্গেই থাকব।
জীবন্ত ছবিটি তাঁর কাচ্ছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এটাই কি তোমার আসল ডোরিয়েন? আমি কি সত্যিই ওই রকম দেখতে?
হ্যাঁ, তুমি তাই।
কী চমৎকার, কী চমৎকার বেসিল!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে হলওয়ার্ড বললেন, অন্তত বাইরে থেকে দেখতে। তবে এটার কোনো পরিবর্তন হবে না। তারও দাম যথেষ্ট।
লর্ড হেনরি চেঁচিয়েই বললেন, আনুগত্য নিয়ে মানুষ কেন যে এত হইচই করে বুঝি না। এমনকি প্রেমের ব্যাপারেও জিনিসটা শারীরবৃত্ত ছাড়া অন্য কিছু নয়। আমাদের নিজস্ব ইচ্ছা-অনিচ্ছার সঙ্গে এর কোনো সম্বন্ধ নেই। যুবকরা বিশ্বাসী হতে চায়, কিন্তু তারা বিশ্বাসী নয়। বৃদ্ধেরা অবিশ্বাসী হতে চান, কি হতে পারেন না। এছাড়া আর কিছুই বলার নেই আমাদের।