এই কথা চিন্তা করতে করতে একটি তীক্ষ্ণ বেদনা শাণিত লৌহ শলকার মতো বুকে গিয়ে খোঁচা দিল। তাঁর দেহের প্রতিটি স্পর্শকাতর তন্ত্রী সেই আঘাতে আর্তনাদ করে উঠল। ঘোলাটে হয়ে উঠল তাঁর চোখ দুটি, ধীরে ধীরে সে দুটি অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে গেলা মনে হল কার যেন তুষারশীতল একটি হাত তার বুকের ওপরে এসে পড়েছে।
ডোরিয়েন গ্রে-কে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন হলওয়ার্ড, ব্যাপারটা কী ঠিক বুঝতে না পেরে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, পছন্দ হচ্ছে না?
লর্ড হেনরি বললেন, অবশ্যই ওঁর পছন্দ হয়েছে। এ ছবি কার পছন্দ হবে না?
আধুনিক চিত্রকলায় এটি হচ্ছে সর্বোত্তম চিত্র। এর জন্যে তুমি আমার কাছে যা চাও তাই দেব। ছবিটা আমার চাই।
এটা আমার সম্পত্তি নয় হ্যারি।
কার সম্পত্তি?
কার আবার? ডোরিয়েনের
ভাগ্যবান মানুষ।
ডোরিয়েন গ্রে তখনো তাঁর প্রতিকৃতির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন, সেইভাবে তাকিয়ে থেকেই বিড়বিড় করে অনেকটা স্বগতোক্তির মতোই তিনি বললেন, কী দুঃখের, কী দুঃখের! আমি বৃদ্ধ হব, বিকৃত আর ভয়ঙ্কর হবে একদিন। কিন্তু এই প্রতিকৃতি চিরকালই যৌবনের। আবেগে থাকবে ভরা। আজকের এই উঁচুন মাসের বিশেষ দিনটিতে সে যেমন রয়েছে, চিরকাল সে ঠিক তেমনিই থাকবে। মনে হবে এ যেন এই সেদিনের ব্যাপার। যদি ঠিক উল্টোটা হত, আমি চিরকালই যুবক থাকতাম, আর এই প্রতিকৃতিটা যেত বুডিযে। এর জন্য আমি আমার সর্বস্ব দিতে পারতাম। হ্যাঁ, পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যা আমি দিতে পারতামি না। প্রয়োজন হলে, আমার আত্মাকেও বিকিয়ে দিতে পারতাম।
লর্ড হেনরি হেসে বললেন, এ ব্যবস্থার নিশ্চয় তুমি রাজি হবে না বেসিল। এর জন্য তুমি অনেক পরিশ্রম করে।
হলওয়ার্ড বললেন, আমার খুব বেশি আপত্তি রয়েছে হ্যারি।
ডোরিয়েন গ্রে ঘুরে তাঁদের দিকে তাকলেন, বললেন, বেসিল, আমি জানি তা তুমি করবে। বন্ধুদের চেয়ে তোমার চিত্রকলাকে তুমি বেশি ভালোবাসা একটা সবুজ ব্রোঞ্জের মূর্তি ছাড়া তোমার কাছে আমি আর কিছু নই। মনে হয় ততটুকুও নয়।
চিত্রকর অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। ডোরিয়েন তো ঠিক এইভাবে কথা বলেন না? ওঁর হল কী? মনে হচ্ছে যেন বেশ চটেছেন তিনি। তাঁর মুখ আর গাল দুটি লাল টকটকে হয়ে উঠেছে।
ডোরিয়েন বলে গেলেন, হ্যাঁ, তোমার হাতির দাঁতের ‘হারমিস’ অথবা রুপোর ফন যা, আমার দাম তোমার কাছে তার চেয়েও কম। তুমি তাদের সব সময়েই পছন্দ করবে। কিন্তু আমকে তোমার কতদিন ভালো লাগবে? যতদিন পর্যন্ত আমার মুখে প্রথম কুঞ্চন না দেখা। দেয়। তাই না? এখন আমি বুঝতে পারছি, দেহের সৌন্দর্য, তার দাম যাই হোক, নষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তার সব কিছু হারিয়ে ফেলে, তোমার ছবি আমাকে সেই শিক্ষাই দিয়েছে। লর্ড হেনরি খাঁটি কথা বলেছেন। পরম-পাওয়া বলে যদি মানুষের কিছু থাকে তা হল একমাত্র ওই যৌবন। যখনি আমার মনে হবে আমি বুড়ো হচ্ছি তখন আমি আত্মহত্যা করব।
হলওয়ার্ডের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেলা ডোরিয়েনের একটা হাত ধরে তিনি বললেন, ডোরিয়েন, ডোরিয়েন! ওকথা বলো না। তোমা মতো বন্ধু আমার নেই, আর হবেও না। এইসব জিনিসগুলোকে নিশ্চয় তুমি হিংসে কর না। কর কি? এইসব জিনিসের চেয়ে তুমি অনেক বেশি সুন্দর।
পৃথিবীতে যাদের সৌন্দর্য নষ্ট হয় না তাদের সকলেরই আমি হিংসে করি। আমার যে চিত্রটি তুমি এঁকে সেটিকেও হিংসা করি আমি। আমি যা হারাব তা এ ধরে রাখবে কেন? চলমান প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছ থেকে কিছু-না সরিয়ে নিচ্ছে, তার পরিবর্তে কিছু দিচ্ছে। হায়রে, এর উল্টোটা যদি হত! যদি চিত্রটারই পরিবর্তন ঘটত, আমি এখন যা রয়েছি তাই যদি আমি চিরকাল থাকতাম! তুমি এ-ছবি কেন আঁকলে? একদিন না একদিন এ আমাকে বিদ্রুপ করবে, মর্মান্তিকভাবে বিদ্রুপ করবে।
উষ্ণ অশ্রু তাঁর চোখের ওপরে ছলছল করে উঠল। তিনি তাঁর হাতটাকে ছিনিয়ে নিলেন। তারপর ডিভানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুখটাকে লুকিয়ে ফেললেন, মনে হল তিনি যেন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করছেন।
চিত্রকর তিক্তভাবে বললেন, এর জন্যে হ্যারি তুমি দায়ী।
লর্ড হেনরি চিত্রকরের তিরস্কারকে গ্রাহ্য না করে কাঁধে একা শ্রাগ করে বললেন, এ-ই হচ্ছে আসল ডোরিয়েন গ্রে-অন্য কিছু নয়।
না, এ তা নয়।
এ যদি তা-ই না হয়, তাহলে একে নিয়ে আমি কি করব?
চিত্রকর বিড়বিড় করে বললেন, তোমাকে যখন চলে যেতে বলেছিলেন তখনি তোমার চলে যাওয়া উচিত ছিল হ্যারি।
লর্ড হেনরি বললেন, তুমি থাকতে বললে বলেই তো থাকলাম।
হ্যারি, একই সঙ্গে আমার দুটি প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে আমি ঝগড়া করে থাকতে পারব না। কিন্তু আমার জীবনের যেটি শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, তোমরা দুজনে সেটিকে ঘৃণা করতে আমাকে বাধ্য করছ আমি এটাকে নষ্ট করে ফেলব। এটা ক্যানভাস আর রঙ ছাড়া আর কী! আমাদের তিনটা ভীবলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ধ্বংস করতে আমি আর কী! আমাদের তিনটি জীবনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ধ্বংস করতে আমি একে দেব না।
এই বলে হলওয়ার্ড ভারী পর্দা দেওয়া জানালার নীচে বসানো ছবি আঁকার টেবিলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় ডোরিয়েন গ্রে বালিশের ওপর থেকে মাথাটা তুলে বিবর্ণ মুখে আর অশ্রুসিক্ত লোচনে তাঁর দিকে তাকালেন। হলওয়ার্ড ওখানে কী করছেন? টিনের টিউব আর শুকনো ব্রাশের জঙ্গলে তিনি কি যেন হাতড়ে বেড়াতে লাগলেন। হ্যাঁ, তিনি লম্বা পাতলা ব্লেডের স্টিলের ছুরিটা খুঁজছিলেন। শেষ পর্যন্ত জিনিসটা খুঁজে পেলেন তিনি, তারপরেই প্রতিকৃতিটা এফোঁড়-ওফোঁড় করার জন্য তিনি তৈরি হলেন।