চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে, অবাক হয়ে ডোরিয়েন গ্রে তাঁর কথাগুলি শোনেন। লাইল্যাক ফুলের পাপডিগুলি তাঁর হাত থেকে খসে নীচে শানুবাঁধানো জায়গায় পড়ে যায়, একটা ব্যস্তবাগীশ মৌমাছি কাছে এসে একটু ভনভন করে। তারপরে সে ফুলের ওপরে ঘোরার আশায় ছুটে বেরিয়ে যায়। সামান্য জিনিসের ওপরে কৌতূহলে নিয়ে তিনি এর দিকে তাকিয়ে থাকেন। ভয়ে বড়ো জিনিসের কাছাকাছি ঘেঁষতে না পেরে আমারা ঠিক এই ভাবেই ছোটোর দিকে ঝুঁকে পড়ি। কোনো নতুন ভাবধারা প্রকাশ করতে না পেরে, অথবা ভয়ঙ্কর কোনো চিন্তা যখন হঠাৎ আমাদের মগডাকে অবরোধ করে বসে, এবং তার কাছে আমাদের আত্মসমর্পণের দাবী জানায়-তখন আমরা এই ধরনের ক্ষুদ্র জিনিস নিয়ে মেতে থাকি। কিছুক্ষণ পরে মৌমাছিটা উড়ে গেল, গিয়ে বসল আর একটি ফুলের ওপরে। ফুলটি এপাশ থেকে ওপাশে ধীরে ধীরে নড়তে লাগল।
স্টুডিওর দরজার সামনে হঠাৎ চিত্রকরকে দেখা গেল, তিনি ভেতরে আসতে তাঁদের ইশারা করলেন।
তিনি বললেন, আমি অপেক্ষা করছি তোমাদের জন্যে। আলো বেশ ভালোই রয়েছে। তোমাদের পানীয় নিয়ে এস।
তাঁরা দুজনে উঠে পড়লেন, তারপরে ধীরে ধীরে স্টুডিওর দিকে এগিয়ে গেলেন, সবুজ আর সাদা রঙে মেশানো দুটি প্রজাপতি তাঁদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে উড়তে লাগল, বাগানের কোণে একটা পিয়ারা গাছে একটা থ্রাসপাখি গান শুরু করল।
লর্ড হেনরি তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, মিঃ গ্রে, আমাকে দেখে আপনি খুশি হয়েছেন?
হ্যাঁ। বর্তমানে আমি খুশি। ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে এই রকম আনন্দ কি সব সময় আমি পাব?
সব সময়! শব্দ দুটো সত্যিই বড়ো ভয়ঙ্কর। কথাটা শুনলেই আমি কাঁপতে থাকি। এই কথাটা বলতে মহিলাদের বেশ ভালো লাগে। চিরকালের জন্যে ধরে রাখতে চাওযার ফলে প্রতিটি রোমান্সকেই তারা নষ্ট করে ফেলে। তা ছাড়া, কথাটা অর্থহীন, খামখোল আর জীবনব্যাপী আকাঙ্খার মধ্যে তফাৎ এই সে খামখেয়াল একটু বেশি দীর্ঘস্থায়ী।
স্টুডিওতে ঢোকার পরে ডোরিয়েন গ্রে তাঁর একটি হাত লর্ড হেনরির কাঁধের ওপরে রেখে। বললেন, তাহলে, আমাদের বন্ধুত্ব খামখেয়াল-ই হোক।
এই বল তিনি প্ল্যাটফর্মের ওপরে উঠে গিয়ে মডেলের ভঙ্গিমায় দাঁড়ালেন।
একটা বড়ো আরাম কেদারার ওপরে বসে লর্ড হেনরি তাঁকে দেখতে লাগলেন। চারপাশে। নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে কেবল ক্যানভাসের ওপরে ব্রাশের মৃদু খসখসানি সেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করছিল, আর যখন চিত্রকর কখনো-সখনো দু-এক পা পিছিযে দূর থেকে তাঁর ছবিটিকে দেখছিলেন তখন। খোলা দরজার ভিতর দিয়ে তির্যক ভঙ্গিতে সূর্যের আলো এসে পড়েছিল, সেই আলোর মধ্যে সোনালি রঙের ধূলিকণাগুলি নাচতে লাগল। গোলাপ ফুলের ভারী গন্ধ এসে ভরিয়ে দিয়েছিল ডায়গাটা।
প্রায় মিনিট পনেরো কাজ করার পরে হলওয়ার্ড থামলেন। অনেক্ষণ ধরে ডোরিয়েন গ্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপরে তাঁর বিরাট একটা ব্রাশের ডগা দাঁতের মধ্যে চেপে ধরে। তাকলেন তাঁর ছবিটির দিকে, ভ্রূকুটি করলেন।
প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে ছবিটা।
এই বলেই তিনি এগিয়ে গিয়ে ক্যানভাসের বাঁদিকের এক কোণে সিঁদুরে অক্ষরে নিজের নামটা লিখে দিলেন।
চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন লর্ড হেনরি। ছবিটিকে বেশ ভালো করে পরীক্কা করলেন। অপরুপ চিত্রকলাই বটে, যেন জীবন্ত, প্রাণচঞ্চল, একেবারে দ্বিতীয় ডোরিয়েন গ্রে।
তিনি বললেন, বন্ধু, আমার আন্তরিক অবিনন্দন গ্রহণ করা আধুনিক যুগের একটি সুন্দরতম প্রতিকৃতি তুমি সৃষ্টি করেছ। মিঃ গ্রে, নেমে আসুন, নিজের প্রতিকৃতির দিকে একবার তাকান।
যুবকটি চমকে উঠলেন, মনে হল হঠাৎ যেন তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠেছন।
প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে এসে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সত্যিই কি শেষ হয়েছে?
চিত্রকর বললেন, প্রায়। আজ তোমার বাটি হচ্ছে অদ্ভুত, চমৎকার। তোমার কাছে আমি ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ।
লর্ড হেনরি বললেন, সেই সাফল্যের মূলে রয়েছি আমি। তাই না মিঃ গ্রে?
কোনো উত্তর দিলেন না ডোরিয়েন, অন্যমনস্কভাবে একবার তাঁর প্রতিকৃতির সামনে দিয়ে হাঁটলেন। তারপরে সেই দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। প্রতিকৃতিটির সঙ্গে চোখাচোখি হওয়া মাত্র তিনি পিছ ফিরলেন, আনন্দের আতিশয্যে কয়েকটি মুহূর্তের জন্যে তাঁর গাল দুটি হয়ে উঠল। তাঁর চোখের মধ্যে বেরিয়ে এল আনন্দের এক টুকরো জ্যোতি, মনে হল, তিনি যেন এই প্রথম নিজেকে চিনতে পেরেছেন। সেখানে তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন, ভাবতে ভাবতে অবাক হয়ে কেমন যেন নির্বাক হয়ে গেলেন তিনি। মনে হল, হলওয়ার্ড তাঁকে যেন কিছু বলছেন, কিন্তু ঠিক কী বলছেন তা তাঁর কানে ঢুকল না। তিনি যে এত সুন্দর এই কথাটা আজই যেন তিনি জীবনে প্রথম বুঝতে পারলেন। এর আগে ঠিক এমনভাবে তিনি বোঝেননি। বেসিল হলওয়ার্ড এতদিন তাঁকে যে-সব কথা বলে এসেছিলেন সেগুলিকে তিনি বন্ধুর মিষ্ট ভাষণ বলেই মনে করতেন। সে সব কথা তিনি শুনতেন, হাসতেন, এবং ভুলে। যেতেন। সেই কথাগুলি তাঁর চরিত্রের ওপরে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তারপরে এলেন লর্ড হেনরি যৌবনের প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠলেন তিনি, কিন্তু সেই সঙ্গে বলে দিলেন, সাবধান, যৌবন ক্ষণস্থায়ী।
কথাটা শোনার সময় তাঁর মনে লেগেছিল সত্যি কথা, কিন্তু এখন নিজের পূর্ণ প্রতিকৃতির মাযার সামনে দাঁড়িয়ে সেই কথাগুলি তাঁকে বিপুলভাবে নাড়া দিয়ে গেল। হেনরির বক্তব্যের আসল ব্যঞ্জনাটা তিনি বুঝতে পারলেন। হ্যাঁ, সত্যি কথাই। এমন একটা দিন আসবে যেদিন তাঁর মুখের রেখাগুলি কুঁচকে যাবে, ঝুলে পড়বে গালের চামড়া, চোখের দৃষ্টি হবে নিষ্প্রভ, বির্বণ, হ্যাঁ লাবণ্য নষ্ট হয়ে যাবে, নিটোল প্রাণবন্ত স্বাহ্যটি ঝুরঝুর করে পড়বে ভেঙে। তাঁর ঠোঁটের লালিমা, চুলের সোনালি বর্ণ সব নষ্ট হয়ে যাবে, নিঃশব্দে মিলিয়ে যাবো আত্মার পরিপোষক যে জীবন, সেই জীবনই তাঁর দেহটিকে বিকৃত করে তুলবে। তিনি পরিণত হবেন একটি ঘৃণ্য জঘন্য, ভয়ঙ্কর মাংসপিণ্ডে।