লর্ড হেনরী বলে গেলেন, হ্যাঁ, প্রবৃত্তি দিয়ে আত্মাকে নীরোগ করা, আর আত্মা দিয়ে প্রবৃত্তির নিবৃত্তি করা–এটি হল জীবনের একটি প্রধান গোপন কথা। আপনি একটি অনবদ্য সৃষ্টি। যতটুকু জানেন বলে আপনার ধারণা তার চেয়ে অনেক বেশি আপনি জানেন, ঠিক যেমন যতটা আপনি ভানতে চান তার চেয়ে অনেক কম জ্ঞান আপনার রয়েছে।
ভ্রুকুটি করে ডোরিয়েন গ্রে তাঁর মাথাটা ঘুরিয়ে নিলেন। তাঁর সামনে যে দীর্ঘাঙ্গ সুন্দর যুবক দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁকে তাঁর ভালো না লেগে উপায় ছিল না। তাঁর রোমান্টিক অলিভ রঙের। মুখ এবং ক্লিষ্ট কণ্ঠস্বর তাঁকে কৌতূহলী করে তুলেছিল। তার সেই খাদে বাঁধা এবং ক্লান্ত স্বরের মধ্যে এমন একটি জিনিস ছিল সেটা তাঁকে মুগ্ধ না করে পারেনি। এমন কি তাঁর ঠান্ডা, সাদা, ফুলের মতো হাতের মধ্যেও কেমন যেন একটা অদ্ভুত কমনীয়তা ছিল। কথা বলার সময় লর্ড হেনরির হাতগুলি নড়ছিল। মনে হচ্ছিল সেগুলি যেন সঙ্গীতের তালে তালে দুলছে, তাদের যেন নিজস্ব একটি ভাষা রয়েছে। কিন্তু ডোরিয়েনের কেমন যেন ভয় লাগছিল, এবং সেই ভয় পাওয়ার জন্য তিনি যেন লজ্জিত-ও হচ্ছিলেন। নিজের কাছে নিজেকে প্রকাশ করার জন্যে একজন অপরিচিতের প্রয়োজন হল কেন? বেসিল হলওয়ার্ডকে তিনি অনেক দিনই জানেন, কিন্তু তাঁদের বন্ধুত্ব কোনোদিনই তাঁর মনে কোনোরকম পরিবর্তন আনতে পারেনি। হঠাৎ তাঁর সামনে এমন একজনের আবির্ভাব হল যিনি তাঁর কাছে জীবনের রহস্যটি প্রকাশ করে দিলেন। কিন্তু তবু ভয় করার কী রয়েছে? তিনি তো স্কুলের ছাত্র অথবা ছাত্রী নন। ভয়। পাওয়াটা তো একটা হাস্যকর ব্যাপার।
লর্ড হেনরি বললেন, চলুন, ওই ছায়ায় গিয়ে বসি, পার্কার পানীয় নিয়ে এসেছে, এবং এই রোদের ঝাঁডে আপনি যদি আরো কিছুক্ষণ বসে থাকেন তাহলে আপনার দফা রফা হয়ে যাবে, বেসিল আর কখনো আপনার ছবি তুলবে না। রোদে পোড়া আপনার চলবে না। এটা ঠিক উচিত হবে না আপনার।
বাগানের ধারে বসে হাসতে হাসতে ডোরিয়েন বলেলন, তাতে ক্ষতি কী?
তাতে আপনারই সমূহ ক্ষতি, মিঃ গ্রে।
কেন?
কারণ আপনার অনবদ্য যৌবন রয়েছে আর যৌবন এমন একটা জিনিস যাকে পাওয়ার জন্য মানুষ লালায়িত হয়।
লর্ড হেনরি, আমার কিন্তু সে রকম কিছু মনে হয় না।
না, এখন তা আপনারা মনে হবে না। একদিন আপনি যখন বৃদ্ধ হবেন, আপনার দেহের চামড়া যখন কুঁচকে যাবে, আপনি যখন দেখতে কদাকার হয়ে যাবেন, দুশ্চিন্তা আপনার কপালের রেখাগুলিকে যখন কুঞ্চিত করে তুলবে, আর কামনায় আপনার ঠোঁট দুটি মারাত্মকভাবে জ্বলতে থাকবে, তখনি যৌবনের কথা আপনার মনে পড়বে, তখনি আপনি। এর অভাবটা ভীষণভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। এখন যেখানেই আপনি যাবেন সেখানেই সবাইকে আনন্দ দেবেন। এটা কি সব সময়েই সম্ভব হবে? আপনার মুখটা কেবল সুন্দর নয়, অসম্ভব সুন্দর, মিঃ গ্রে, হাসবেন না। কথাটা সত্যি। আর যৌন্দর্য যে প্রতিভার এ অথবা তার চেয়েও বড়ো–সেকথা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনীয়তা নে আলো, বসন্তকাল, অথবা কালো জলের ওপরে চাঁদের প্রতিফলনের মতো এটাও বিশ্বের একটি বড় সত্য। এ নিয়ে তর্ক করার অবকাশ নেই। এর সার্বভৌমত্ব ঈশ্বর ঠিক করে দিয়েছেন। যাঁদের এই বস্তুটা রয়েছে তাঁরা রাজকুমারের পর্যায়ে পড়েন। হাসছেন? হায়, যখন আপনার যৌবন থাকবে না তখন কিন্তু আপনি আর হাসবেন না। লোকে মাঝে মাঝে বলে সৌন্দর্য নাকি দেহের বাইরের জিনিস। তা হতে পারে। কিন্তু চিন্তা যতটা বাহ্যিক, এ অন্তত ততটা নয়। আমার কাছে সৌন্দর্য হচ্ছে সকল বিস্ময়ের সেরা বিস্ময়। বাইরের চেহারা দেখে যারা মানুষকে বিচার করে না তাদের বৈদগ্ধ্য সম্বন্ধে আমার সন্দেহ রয়েছে। বিশ্বের আসল রহস্য যা আমরা সাদা চোখে দেখতে পাই তার মধ্যে নিহিত, যা দেখতে পাই না তার মধ্যে ন্য। হ্যাঁ, মিঃ গ্রে, দোতারা আপনার ওপরে অদয়। কিন্তু দেবতারা যা দেন তা তাঁরা তাড়াতাড়িই ফিরিয়ে নেন। মাত্র কয়েকটি বছরই আপনি ভালোভাবে, পরিপূর্ণভাবে বাঁচতে পারেন। যৌবন চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার যৌন্দর্য শেষ হয়ে যাবে। তখনি আপনি হঠাৎ আবিষ্কার করবেন জয় করার মতো আর আপনার কিছু নেই। যেটুকু রয়েছে সে শুধু অতীতের স্মৃতি। সেই স্মৃতি পরাজযের চেয়েও আপনার কাছে তিক্ত বলে মনে হবে। প্রতি মাসে এই ক্ষয়মান সৌন্দর্য আপনাকে এমন সব পরিবেশের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ফেলবে সেগুলি ভয়নক ছাড়া আর কিছু নয়। সময় আপনাকে হিংসা করে, আপনার লিলি আর গোলাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আপনার বুদ্ধিবৃত্তি কমে যাবে, গাল যাবে তুড়ে, চোখের দৃষ্টি যাবে হক্কীণ হয়ে। ভীষণভাবে দুঃখ পাবেন আপনি। হায, যতক্ষণ আপনার যৌবন রয়েছে ততক্ষণই তাকে উপলব্ধি করুন। নীরস নীতিকথা শুনে, অপরিবর্তনীয় ব্যর্থতাকে দেখার ভল্যে, অজ্ঞদের জন্য জীবন বিসর্জন দিয়ে, সাধারণ আর অশিক্ষিতদের সেবা করার বাসায আপনার সোনার দিনগুলিকে নষ্ট করবেন না। এ যুগের এইগুলিই হচ্ছে রুগ্ন আদর্শ, মিথ্যা উন্মাদনা। বাঁচুন, ভগবান আপনাকে যে সুন্দর জীবন দিয়েছেন তাকে পরিপূর্ণ ভাবেউপলব্ধি করুন। কোনো কিছুই যেন আপনার কাছে নগণ্য বলে গণ্য না নয়, সব সময় নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চযের পথে এগিয়ে যান, কিছুই ভয় করবেন না, একটি নতুন ভোগসুখবাদ–আমাদের শতাব্দী এই মতবাদেই বিশ্বাসী। আপনি হয়তো এর প্রকাশ্য প্রতীক। এমন কিছু নেই যা আপনি আপনার ব্যক্তিত্ব নিয়ে করতে পারেন না। কিছুদিনের জন্যে পৃথিবী আপনার, যখনি আপনার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হল তখনি দেখলাম আপনি নিজে কী, এবং কী হতে পারেন সে বিষয়ে আপনি নিজেই জানেন না। আপনার মধ্যে অনেক জিনিস আমি দেখেছি যেগুলি আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমার মনে হয়েছিল আপনার সম্বন্ধে আপনাকে আমি কিছু বলব। আমার মনে হয়েছিল আপনি যদি নষ্ট হয়ে যান তাহলে ব্যাপারটা খুবই মর্মান্তিক হবে। কারণ, খুব। অল্পদিনই আপনার যৌবন বেঁচে থাকবে। সাধারণ পাহাড়ি চুল ঝরে যায় বটে, কিন্তু আবার তারা ফোটো এখনো যেমন আগামী জুন মাসেও ল্যাবারনাম ফুল তেমনি হলুদ রঙা হয়ে ফুটবে। এখন থেকে একমাসের মধ্যে ক্লিম্যাটিস লতা গাছের পাতায় বেগনে রঙের তারকা চিহ্নগুলি ফুটে বেরোবে এবং বছরের পর বছর এর পাতার সবুভ রাত্রিগুলি বেগনে তারকা চিহ্নগুলিকে মেলে ধরবে। কিন্তু কোনো দিনই আমরা আমাদের হারানো যৌবনের ফিরে পাব না। বিশ বছর বয়সে আমাদের মধ্যে যে আনন্দের জয়ধ্বনি ওঠে সেই আনন্দ শেষ পর্যন্ত। ঝিমিযে আসে। আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি শিথিল হয়ে আসে, আমাদের প্রবৃত্তিগুলি পচে যায়। ভয়ঙ্কর অতলে আমরা অধঃপতিত হই। সে বাসনার জন্যে আমরা অতিমাত্রায় ভয় পাই তারই অতৃপ্তির স্মৃতি আমাদের পিছু ধাওয়া করে। যৌবন! যৌবন! এ পৃথিবীতে এ ছাড়া দ্বিতীয় আর কিছু নেই।