- বইয়ের নামঃ ডোরিয়েন গ্রে-র ছবি
- লেখকের নামঃ অস্কার ওয়াইল্ড
- প্রকাশনাঃ পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস, গোয়েন্দা কাহিনী
ডোরিয়েন গ্রে-র ছবি
১. গোলাপ ফুলের মিষ্ট গন্ধে
প্রথম পরিচ্ছেদ
গোলাপ ফুলের মিষ্ট গন্ধে স্টুডিওটি মশগুল হয়ে ছিল, আর বাগানের ভেতরে গ্রীষ্মকালীন বাতাস ঘুরপাক খাওয়ার সময় খোলা দরজার মধ্যে দিয়ে লাইল্যাক ঝাড়ের ঘন সুবাস, অথবা লাল ফুলে ভরা কাঁটাগাছের ঝোপ থেকে মিষ্টি মেভাজি একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল চারপাশে।
স্টুডিওর এক কোণে পারিশিয়ান-গদি মোড়া নীচু একটি বসার ‘কোচ’, তার ওপরে চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী লর্ড হেনরি ওটন শুয়ে শুয়ে একটার পর একটা সিগারেট ফুঁকে শেষ করছিলেন। মধুর মতো মিষ্টি আর রঙিন সোঁদাল গাছের ফুলের আভা তাঁর চোখে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল গাছটির কম্পমান শাখা-প্রশাখাগুলি তাদের আগুনে সমারোহের ভার বইতে পারছে না। বিরাট জানালার ওপরে সিল্কের পর্দা ঝোলানো ছিল, সেই পর্দার ওপরে মাঝে মাঝে উড়ন্ত পাখিদের ডানার ঝাপটায় মৃদু আলোড়ন ছড়িয়ে পড়ে জাপানি চিত্রকরদের চিত্রকলার সাময়িক ব্যঞ্জনার ইঙ্গিত দিচ্ছিল। এই দেখে টোকিওর চিত্রকরদের বিবর্ণ জরাজীর্ণ মুখগুলির কথা তাঁর মনে পড়ে গেল। যে আর্ট অচল, গতিহীন ছাড়া আর কিছু নয়, সেই আর্টের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য আর গতির সৃষ্টি করতে তাঁরা কী আয়াসই না করেন। চারপাশে নিস্তব্ধ। লম্বা ঘাসের মধ্যে অথবা ধূলিমলিন উডবাইন গাছের জড়ানো ডালের ভেতরে আসুরিক জেদ নিয়ে ঘূর্ণায়মান মৌমাছিদের ক্লান্তু গুঞ্জন সেই নিস্তব্ধতাকে আরো ক্লান্তিকর করে তুলেছিল। লন্ডন শহরের মৃদু গর্জন শুনে মনে হচ্ছিল দূরাগত কোনো সঙ্গীতযন্ত্রের উচ্চগ্রামের সুর ধ্বনিত হচ্ছে।
ঘরের মাঝখানে ছবি আঁকার একটি খাড়াই ফ্রেম দাঁড় করানো। তার ওপরে একটি যুবকের পূর্ণ প্রতিকৃতি দেখে মনে হল, যুবকটির চেহারা অদ্ভুত সুন্দর। সেই প্রতিকৃতির সামনে, সামান্য একটু দূরে, চিত্রকর নিজে বসেছিলেন। চিত্রকরের নাম বেসিল হলওয়ার্ড। বছর কয়েক আছে এর হঠাৎ অন্তর্ধানের কাহিনিকে কেন্দ্র করে জনসাধারণের মধ্যে ভীষণ একটি উত্তেজনা জেগেছিল, আর সেই সঙ্গে মুখর হয়ে উঠেছিল নানারকম অদ্ভুত অদ্ভুত গুজব।
যে মিষ্টি লাবণ্যময় প্রতিকৃতিটি তিনি দক্ষতার সঙ্গে এঁকেছেন তার দিকে চিত্রকর তাকিয়ে ছিলেন। ছবিটিকে দেখে তাঁর মুখের ওপরে একটুকরো আনন্দের হাসি ফুটে উঠল, শুধু উঠল না, মনে হল, হাসিটুকু লেগে রইল একটু। কিন্তু হঠাৎ তিনি চমকে উঠলেন, চোখ বোজলেন; আঙুলগুলি রাখলেন বোজালো চোখের পাতার ওপরে। মনে হল একটি অদ্ভুত স্বপ্নকে তিনি মগজের মধ্যে বন্দী করে রাখতে চান, ভয় হল, হয়তো তাঁর স্বপ্ন ভেঙে যাবে।
অবসন্নভাবে লর্ড হেনরি বললেন, বেসিল, এটি তোমার শ্রেষ্ঠ চিত্র। এত ভালো চিত্র জীবনে তুমি আর আঁকোনি। পরের বছর এটিকে নিশ্চয় তুমি গ্রসভেনর-এ পাঠাবে। অ্যাকাডেমি হচ্ছে যেমন বড়ো তেমনি কদর্য। যখনি আমি সেখানে গিয়েছি তখনি দেখেছি যে সেখানে এত মানুষের ভিড় জমেছে যে ছবি দেখার সুযোগ পাইনি এতটুকু, ব্যাপারটা ভয়ানক সন্দেহ নেই। অথবা, এত ছবির ভিড় হয়েছে যে মানুষ দেখার সময় পায়নি। এটি আরো খারাপ। গ্রসভেনর-ই একমাত্র জায়গা যেখানে তোমার ছবি তার উপযুক্ত মূল্য পাবে।
একটু অদ্ভুতভাবে ঘাড় নাড়লেন চিত্রকর। অক্সফোর্ডে পড়ার সময় এইভাবেই তিনি ঘাড় নাড়তেন। সেই ঘাড়নাড়া দেখে তাঁর সহপাঠীরা সবাই হাসতেন। সেই রকম একটি ঘাড় নেড়ে তিনি বললেন, আমার মনে হয় না এটিকে আমি কোথাও পাঠাব। না, এটিকে আমি কোথাও পাঠাব না।
এই কথা শুলে লর্ড হেনরি কেমন যেন আবাক হয়েই মুখটা তুলে আফিঙের গুঁড়ো মেশানো সিগারেটের জমাট ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, কোথাও পাঠাবে না? কেন বন্ধু? এর পেছনে কি কোনো যুক্তি রয়েছে? তোমাদের এই চিত্রকরের জাতটা সত্যিই বড়ো কিম্ভুতকিমাকার। নাম কেনার জন্যে এ দুনিয়ায় তোমরা সব কিছু করতে পার। আর নাম হওয়া মাত্র তোমরা তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাও। সুনামটাকে পরিত্যাগ করা মুর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ আলোচনা করার চেয়ে খারাপ, এবং যে জিনিসটি লোকে প্রায় আলোচনা করতে চায় না এরকম একটি জিনিসই পৃথিবীতে রয়েছে। এই রকম একটি প্রতিকৃতি ইংলন্ডের সমস্ত যুবকদের ওপরে তোমাকে বসাবে, আর বৃদ্ধেরা তোমাকে হিংসা করবে, অবশ্য কোনোরকম ভাব প্রকাশের শক্তি যদি তাদের থাকে।
বেসিল বললেন, আমি জানি আমাকে তুমি উপহাস করবে। কিন্তু আমি সত্যিই বলছি এটিকে আমি বাইরের প্রদর্শনীতে পাঠাতে পারব না। এর মধ্যে আমার নিজেকে অনেকখানি মিশিয়ে দিয়েছি।
সোফার ওপরে শরীরটাকে বেশ ভালো করে ছড়িয়ে দিয়ে লর্ড হেনরি হাসলেন।
হ্যাঁ, আমি জানি তুমি হাসবে, কিন্তু কথাটা যে সত্য সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
কী বলছ তুমি, বেসিল! তোমার অনেকখানি এই প্রতিকৃতির ভেতরে রয়েছে? তুমি যে এতটা অন্তঃসারশূন্য তা তো আমি জানতাম না। আর সত্যি কথা বলতে কি তোমাদের দুজনের মধ্যে আমি কোনো সাদৃশ্য দেখতে পাচ্ছি না। তোমার মুখ রুক্ষ, পুরুষ্টু চুলগুলি আলকাতরার মতো কালো; আর ওই যৌবনোদ্দল যুবকটিকে দেখলে মনে হবে যেন হাতির দাঁত আর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে তার দেহটি তৈরি হয়েছে। তোমার ওই প্রতিকৃতিটি আত্মপ্রেমিক নারসিসাস বলে মনে হচ্ছে আমার; অবশ্য ওর মধ্যে তুমি কিছুটা বুদ্ধির কারুকার্য ফুটিয়ে তুলেছ–এই যা। কিন্তু বুদ্ধির জলুস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সৌন্দর্য, সত্যিকার সৌন্দর্য বলতে অবশ্য বোঝা যায়, তা নষ্ট হয়ে যায়। বুদ্ধি জিনিসটাই হচ্ছে অতিশয়োক্তির বহিপ্রকাশ। এর কাজ হচ্ছে মুখের কমনীয়তা নষ্ট করা। যে মুহূর্তে মানুষ চিন্তা করতে বসে সেই মুহূর্তেই তার মুখের ওপর থেকে লালিত্য সরে যায়। এক কথায়, মুখের আর কোনো চিহ্নই থাকে না। মানুষ তখন একটা নাক বা কপালে রূপান্তরিত হয়। ঘটনাটা ভয়ঙ্কর ছাড়া আর কিছু নয়। বিদগ্ধ পেশায় সাফল্য অর্জন করেছেন এমন যে কোনো একটি মানুষের দিকে লক্ষ কর। তাঁরা দেখতে কী ভয়ানক! অবশ্য গির্জার পাদরি ছাড়া। কিন্তু সত্যিকার চিন্তা করার বালাই পাদরিদের নেই। আঠার বছর বয়সে বিশপকে যা বলতে শেখানো হয় আশি বছর বয়সেও তিনি তাই বলতে থাকেন। ফলে, চিন্তার ভার থেকে তিনি সব সময়েই মুক্ত, সব সময়েই তিনি খুশি থাকেন। তোমার এই রহস্যময় যুবক বন্ধুটি–যাঁর নাম তুমি কোনো দিনই আমাকে বলনি এবং যিনি আমাকে মুগ্ধ করেছেন, কোনো দিনই চিন্তা করেন না। এদিকে থেকে আমার কোনো সন্দেহ নেই। ভদ্রলোকটি নির্বোধ, সুন্দর মানুষ ছাড়া আর কিছু নয়। শীতকালে তাকিয়ে দেখার মতো যখন কোনো ফুল ফোটে না তখন এখানে তাঁর উপস্থিতি আমাদের আনন্দ দেবে। গ্রীষ্মকালে বুদ্ধির ধার ভোঁতা করার প্রয়োজন দেখা দিলে তাঁর সাহচর্য সব আমাদের কাছে উপাদেয় বলে মনে হবে। আমার কথা শুনে উৎফুল্ল হয়ো না, বেসিল। কিন্তু তুমি আদৌ ওর মতো নও।