সে মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্রাট আমার দিকে ঘুরে তাকালেন; তাঁর কপালের ওপরে তখন বড়ো বড়ো ফোঁটার ঘাম জমে উঠেছিল। ছোটো একটা রুমাল দিয়ে সেই ঘাম মুছে তিনি। আমাকে বললেন–আপনি কি নবী, না, ঈশ্বরের পুত্র যে আপনাকে আমি আঘাত করতে পারলাম না? আপনাকে অনুরোধ করছি আজ রাত্রিতেই আমার শহর ছেড়ে আপনি চলে যান। কারণ, যতক্ষণ আপনি এখানে থাকবেন ততক্ষণ আমি আর এখানে রাজত্ব করতে পারব না।
এই কথা শুনে আমি বললাম-তোমার ধনরত্নের অর্ধেক পেলে আমি চলে যেতে রাজি আছি।
সম্রাট আমার হাত ধরে বাগানে নিয়ে গেলেন। সেখানে একটা ঘর রয়েছে। সেই ঘরে শক্ত লাল পাথরের আটটা দেওয়াল। সম্রাট একটা দেওয়ালের গায়ে হাত দিতেই সেটো সরে গেল। আমরা সিড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলাম। সিড়িঁর তখন অনেকগুলো টর্চ একসঙ্গে জ্বলছিল। তুমি বললে বিশ্বাস করবে না কী অদ্ভুত সেই জায়গাটা! হীরে, মুক্তো, মণি, ডহরৎ, পান্না, চুনি, দামি-দামি পাথরে একেবারে বোঝাই।
সম্রাট বললেন–এই আমার ধনরত্ন। এর অর্ধেক আপনার। আমি প্রতিজ্ঞা করছি। আমি আপনাকে উট দেব, উট চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার লোক দেব। আপনি আপনার অর্ধেক সম্পত্তি নিয়ে আজ রাত্রেই এই শহর ছেড়ে চলে যান। পৃথিবীর যেখানেই যান না কেন আমার। লোকজন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। কিন্তু আভ রাত্রিতেই আপনাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। আমার শহরে এমন একডনি রয়েছেন যাঁকে আমি হত্যা করতে পারি নে এই কথাটা আমার পিতা সূর্যদেব জানতে পারুন তা আমি চাই নে।
বললাম-সোনা, রুপো, মূল্যবান সমস্ত পাথর যা এখানে রয়েছে তা সব তোমার। কিছুই আমার চাই নে। শুধু ওই ছোটো আংটিটা আমাকে দাও, ওই যেটো তুমি পরে আছ। তাহলেই। আমি চলে যাব।
সম্রাট ভ্রূকুটি করে বললেন–এটা তো সীসের আংটি। এর কোনো দাম নেই। তার চেয়ে আপনি বরং আমার অর্ধেক ধনরত্ন নিয়ে যান।
উহু! ওটা ছাড়া আর কিছুই আমি লেবু না। ওতে কী লেখা রয়েছে আর কী জন্যে লেখা রয়েছে তা আমি জানি।
সম্রাট কাঁপতে কাঁপতে বললেন–আমার অর্ধেক ধনরত্ন নিয়ে যান।
সেই শুনে আমি একটা অদ্ভুত কাজ করলাম। কিন্তু সেকথা থাকা আমি একটা গুহায় সেটা। লুকিয়ে রেখে এসেছি। ওটা হচ্ছে অর্থের আংটি। জায়গাটা এখান থেকে একদিনের যাত্রাপথ। এই আংটি যার হাতে থাকবে বিশ্বের সমস্ত ধন হবে তার। তুমি আমার সঙ্গে এসে সেটি গ্রহণ কর। বিশ্বের সম্পদ তোমার কারও হবে।
কিন্তু যুবক ধীরবটি হেসে বলল–অর্থের চেয়ে প্রেম অনেক বড়ো; এবং খুদে জল-অপ্সরীটি আমাকে ভালোবাসে। এই বলে সে সমুদ্রে ডুবে গেল। কাঁদতে-কাঁদতে ফিরে গেল আত্মা।
তৃতীয় বছরে শেষ হওয়ার পরে আত্মাটি আবার সমুদ্রোপকূলে ফিরে এসে ধীবরকে ডাকাল। ধীবর উঠে এসে ডিাসা করল–আমাকে ডাকছ কেন?
আত্মাটি বলল–আমার কাছে এস। আমি কত অদ্ভুত জিনিস দেখেছি। সে সব কথা তোমাকে আমি বলব। ধীবরটি অগভীর জলে এসে তার কাহিনি শোনার জন্যে হাতের ওপরে মাথাটা রেখে হেলান দিয়ে বসল।
আত্মাটি বলে গেল–আমি একটি শহরের কথা জানি, সেখানে নদীর ধারে একটা সরাইখানা রয়েছে। নাবিকরা সেখানে বসে দুটি বিপরীত-রঙা মদ্য পান করছিল, খাচ্ছিল বার্লির। রুটি–আর ভিনিগার মেশানো ছোটো ছোটো লোনা মাছ। তাদের পাশেই আমি বসেছিলাম। আমরা বসে-বসে ফুর্তি করছি এমন সময় একটি বৃদ্ধ এসে হাজির হল। তার হাতে একটি চামড়ার কার্পেট, আর দুটো অম্বরের শিং-ওয়ালা একটা বাঁশি। কাছে এসে সে কার্পেটটি বিছিয়ে সেই বাঁশির তারে পাখির একটা পালক দিয়ে আঘাত করল। সেই শব্দ শুনে ঘোমটায়। মুখ ঢেকে একটি বালিকা দৌড়ে এসে আমাদের সামনে নাচতে শুরু করল। তার পা দুটি ছিল অনাবৃত। ছোটো-ছোটো সাদা পায়রার মতো সে দুটি ঘুরতে লাগল। এমন অপরূপ নাচ ডীবনে আর কোনো দিনই আমি দেখিনি। যে শহরে মেয়েটি নাচে সেটি এখান থেকে একদিনের হাঁটাপথ মাত্র।
তার আত্মার কথা শুনে ধীবরের মনে হল তার প্রেমিকা অপ্সরীটির পা নেই। সে নাচতে পারে না। তাই হঠাৎ সেই নাচ দেখার প্রবল একটা ইচ্ছে হল তার সে নিজের মনে মনে। বলল–মাত্র একদিনের পথ। আমি আবার আমার প্রেমিকার কাছে ফিরে আসতে পারব। এই ভেবে একুট হেসে সে উপকূলের দিকে জল কেটে-কেটে এগিয়ে আসতে লাগল। শুকনো জায়গায় এসে একটু হেসে সে আত্মার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল। আনন্দে চিৎকার করে তাকে সম্পূর্ণ করার জন্যে তার দিকে দৌড়ে গেল আত্মা; তারপরে তার ভেতরে ঢুকে গেল। যুবক ধীবরটি দেখতে পেল বালির ওপরে তার দেহের ছায়াটি লম্বা হয়ে পড়ে রয়েছে; আর। সেইটিই হচ্ছে তার আত্মার দেহ।
আত্মাটি বলল–আর অপেক্ষা করে লাভ কি? চল, আমরা তাড়াতাড়ি পালিযে যাই। কারণ সমুদ্রের দেবতারা বড়োই হিংসুটে, তাদের আজ্ঞা পালন করার জন্য দৈত্যেরা দৌড়ে আসে।
সুতরাং তারা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল, চাঁদের আলোতে তারা সারারাত হাঁটল; সূর্যের আলোতে হাঁটল সারাটা দিন; তারপর সন্ধের সময় তারা সেই শহরে এসে হাজির হল।
যুবক ধীবরটি জিজ্ঞাসা করল–এই শহরেই কি সেই মেয়েটি নাচে?
তার আত্মাটি বলল–এটা নয়! আর একটা। যাই হোক, চল, ভেতরে যাই।
সুতরাং তারা ভেতরে ঢুকল। রাস্তার দু’পাশে ভতুরিদের দোকান। তারা দেখল দোকানের। ওপরে একটা সুন্দর রুপোর কাপ বসানো রয়েছে। তার আত্মা বলল–ওই কাপটা নিয়ে লুকিয়ে ফেল।