আজ বাগানে কাজ করে আমি বেশ আনন্দ পাব–এই কথা বলে সে তক্ষুনি বাগানে বেরিয়ে গেল।
কিন্তু তার বন্ধু মিলার প্রায়ই তার বাগানে এসে নানা কাজে তাকে ডেকে নিয়ে যেতে লাগল। ফলে মন দিয়ে সে বাগানে কাজ করার সময় পেল না। এই জন্যে মাঝে মাঝে সে মনে বড়ো কষ্ট পেত; কিন্তু এই ভেবে নিজেকে সে সান্ত্বনা দিতে চাইত যে মিলার তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। মিলারের সব ভালো-ভালো কথাগুলি সে একটা খাতায় টুকে নিয়ে প্রতিদিন রাত্রিতে সে সেগুলি পড়ত।
একদিন সন্ধেবেলায় খুদে হ্যানস ঘরের মধ্যে বসে-বসে আরাম করে আগুন পোহাচ্ছিল এমন সময় দরজায় বেশ জোরে-ডোরে কে যেন আঘাত করল। রাত্রিটা ছিল ঝড়ো; বাইরে তখন প্রচণ্ড ঝড়ের দাপাদাপি চলেছে। সে ভাবল ওই ঝড়ই তার কপাটে ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু তারপরেই আবার একটা ধাক্কা এল, তারপরে আবার, আবার। আর প্রতিটি ধাক্কাই আগের ধাক্কার চেয়ে বেশি ডোরাল।
নিশ্চয় কোনো হতভাগ্য পথিক–এই মনে করে সে দৌড়ে এসে খিল খুলে দিল। দেখল একটা লণ্ঠন আর লাঠি নিয়ে মিলার দাঁড়িয়ে রয়েছে।
চেঁচিয়ে বলল মিলার–প্রিয় হ্যানস, আমি বড়োই বিপদে পড়েছি। সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে আমার বাচ্চা ছেলেটা খুব চোট খেয়েছে। আমি ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছি। কিন্তু তিনি এত দূরে থাকেন, আর রাত্রিটা এত খারাপ যে হঠাৎ আমার মনে হল তোমাকে ডাক্তারের বাড়ি পাঠানোটাই সব দিক থেকে ভালো হবে। তুমি জান তোমাকে আমার ঠেলাগাড়িটা দান। করছি। সেই দিক থেকে এটাই সঙ্গত যে প্রতিদানে তুমি আমার এই কাজটা করে দেবে।
হ্যানস উৎসাহিত হয়ে বলল–নিশ্চয়, নিশ্চয়। তুমি যে এসেছ এতে নিজেকে আমি ভাগ্যবান বলেই মনে করছি। আমি এখনই যাচ্ছি। কিন্তু তোমার ওই লণ্ঠনটা দাও-কারণ রাত্রিটা বড়ো অন্ধকার-আলোর অভাবে আমি হয়তো খানায় পড়ে যেতে পারি।
মিলার বলল–খুবই দুঃখিত। এটা এইমাত্র কিনেছি কিনা! এটার কিছু হলে আমার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।
ঠিক আছে, ঠিক আছে আমি অন্ধকারেই বেরিয়ে যাচ্ছি।
এই বলেই সে ঝড়ের রাতে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়।
ওঃ! কী ভীষণ রাত! এত অন্ধকার যে তার পষ্কে পথ চেনা দায় হয়ে উঠল, এত ঝড়ের দাপাদাপি যে রাস্তায় পা ফেলাই দায়। যাই হোক, দুঃসাহসী ছিল বলেই হয়তো প্রায় ঘন্টা। তিলেক ঝড় আর অন্ধকারের সঙ্গে লড়াই করে সে ডাক্তারের বাসায় এসে হাজির হল এবং দরজায় করাঘাত করল।
শোওয়ার ঘরের জানালার ভেতর দিয়ে উঁকি দিয়ে ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন–কে?
খুদে হ্যানস, ডাক্তার।
কী চাই?
মিলারের ছোটো ছেলেটা সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে চোট খেয়েছে, সে আপনাকে এক্ষুনি যেতে বলেছে।
‘ঠিক আছে’–এই বলে ডাক্তার সাজপোশাক করে লণ্ঠন নিয়ে গাড়িতে চেপে তক্ষুনি বেরিয়ে গেলেন মিলারের বাড়ির দিকে। আর তারই পিছু পিছু বেচারা হ্যানস চলতে লাগল হেঁটে-হেঁটে।
কিন্তু ঝড়ের দাপাদাপি বাড়তে লাগল; শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি। কোন দিকে যাচ্ছে হ্যানস-এর পক্ষে তা বোঝা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াল; গাড়ির সঙ্গেও আর সে তাল দিয়ে চলতে পারল না। তারপরে একসময় সে পথ হারিয়ে ফেলে সোডা জনবিরল মাঠের চারপাশে ঘুরতে লাগল। ডায়গাটা ছিল বিপজ্জনক। খানাখোঁদল আর গভীর জলাশয়ে ভর্তি ছিল জায়গাটা। তাদেরই একটা জায়গায় বেচারা হ্যানস ডুবে মারা গেল। পরের দিন বিরাট একটা জলাশয়ে তার মৃতদেহটাকে ভাসতে দেখল মেষপালকরা। তারপরে তার দেহটাকে তার বাড়িতে বয়ে আনা হল।
খুদে হ্যানসকে ভালোবাসত সবাই; সেই জন্যে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সবাই যোগ দিতে এল। মিলারই হল সেই ক্রিয়ার প্রধান পাণ্ডা।
মিলার বলল–আমিই ছিলাম তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু; তাই আমারই উচিত এই সভার সবচেয়ে ভালো স্থানটি দখল করা।
এই বলে গায়ে কালো পোশাক চডিযে, কালো রুমালে মাঝে মাঝে চোখের জল মুছতে মুছতে সে শোকযাত্রার পুরোভাগে চলতে শুরু করল।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার শেষে সরাইখানায় আরামের সঙ্গে বসে মশলা দেওয়া মদ আর মিষ্টি কেক খেতে-খেতে কামার বলল–খুদে হ্যানস-এর মৃত্যু প্রত্যেকের কাছে একটা ক্ষতি।
মিলার বলল–অন্য কারো কথা জানি নে, কিন্তু তার মৃত্যু আমার কাছে নিঃসংশয়ে বিরাট একটা ক্ষতি ছাড়া আর কিছু নয়। সে আমার এত প্রিয় বন্ধ ছিল যে তাকে আমার ঠেলাগাড়ি আর একটু হলে দানই করে ফেলতাম। এখন সেটাকে নিয়ে আমি কী করব ভেবে পাচ্ছি না। সেটা বাড়িতে ফেলে রাখতে আমার অসুবিধে হচ্ছে। তার অবস্থা এতই খারাপ যে এমন অবস্থায় বিক্রি করেও বিশেষ কিছু ঘরে আসবে না। এর পরে আর কাউকে যাতে কিছু দেওযার বাসনা আমার না হয় সেদিক থেকে খুব সতর্ক হতে হবে। উদার হতে গেলে মানুষকে দুঃখ পেতেই হয়।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পরে জলের ইঁদুর বলল–মানে?
লিনেট বলল–মানে, এইখানেই আমার গল্প শেষ।
জলের ইঁদুর জিজ্ঞাসা করল–কিন্তু মিলারের শেষ পর্যন্ত কী হল?
লিনেট বলল–তা আমি জানি নে; আর জানারও ইচ্ছে নেই।
জলের ইঁদুর বলল–এতেই বোঝা যাচ্ছে তোমার চরিত্রে সহানুভূতি বলে কোনো পদার্থ নেই।
লিনেট বলল–এই গল্পের নীতিটা কী তা নিশ্চয় তুমি বুঝতে পারছ না।
জলের ইঁদুর প্রায় গোঙিয়ে উঠল–কী-কী বললে!
নীতি।
তুমি বলতে চাও গল্পটার একটা নীতি রয়েছে?