মিলারের সবচেয়ে ছোটো ছেলেটা বলল–কিন্তু তাঁকে কি আমরা এখানে আনতে পারি নে? যদি তিনি সত্যিকার দারিদ্রে পড়ে থাকেন আমি তাহলে তাঁকে আমার অর্ধেকটা খাবার দিতে পারি–আর দেখাতে পারি আমার সাদা খরগোসগুলি।
মিলার বেশ উঁচু স্বরে বলল–আচ্ছা বোকা ছেলে তো! তোমাকে স্কুলে পাঠিয়ে যে কী সুরাহা হচ্ছে তা আমি বুঝতে পারছি না কিছুই শিখছ বলে তো মনে হচ্ছে না। হ্যানস যদি এখানে এসে আমাদের এই ভালো-ভালো খাবার, ভালো-ভালো লাল মুদ, আর এমন আরামের গৃহস্থালী দেখে তাহলে তার মনে হিংসার উদ্য হতে পারে, এই হিংসাটাই হচ্ছে বন্ধুত্বের পহেল্ক বড়োই বিপজ্জনক। এতে মানুষের স্বভাব-চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়। আমি কিছুতেই হ্যানসকে তার চরিত্র নষ্ট করতে দেব না। তার সবচেয়ে প্রিয়ে বন্ধু আমি। সব সময় আমি তার ওপরে নডরে রাখব। দেখব সে যাতে লোভের পথে পা না বাড়ায। তাছাড়া সে যদি এখানে আসে তাহলে আমার কাছ থেকে ধারে কিছু ময়দা নেওয়ার প্রস্তাব সে দিতে পারে। কিন্তু আমি তাকে ধার দিতে পারি নে। মযদা আর বন্ধুত্ব এক জিনিস নয। দুটো জিনিসের বানাই। আলাদা। তাদের অর্থও যে আলাদা সেকথা সবাই জানে।
বিরাট একটা পাত্রে মদ ঢেলে তার স্ত্রী বলল–বা! কী সুন্দর কথা! মনে হচ্ছে, আমি গির্জায় রয়েছি।
মিলার বলল–অনেক মানুষই ভালো অভিনয় করতে পারে। কিন্তু ভালো কথার শক্তি কম মানুষেরই রয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায় দুটোর মধ্যে ভালো কথা বলাটাই বেশি শক্ত-আর সেই সঙ্গে সূতর।
এই বলে ছেলের দিকে এমন রুষ্টভাবে সে তাকিয়ে রইল যে বেচারা লজ্জায় মাথা নীচু করল। যাই হোক, তার ব্যস এত কম যা তাকে হমা করা যেতে পারে।
জলের ইঁদুর জিজ্ঞাসা করল–তোমার গল্প শেষ?
লিনেট বলল–মাত্র শুরু।
জলের ইঁদুর বলল–তুমি তো তাহলে দেখছি সেকেলে হয়ে গিয়েচ্ছ। আজকাল প্রতিটি দক্ষ। কথকই শেষ থেকে শুরু করে, তারপরে চলে যায় প্রথমে, শেষ করে মাঝখানে। এইটিই হচ্ছে নতুন রীতি। সেদিন একজন সমালোচক একটি যুবককে সঙ্গে নিয়ে পুকুরের ধারে বেড়াতে বেড়াতে এই কথা বলছিলেন। আমি তা শুনেছি। কথাটা সত্যি বলেই মনে হচ্ছে আমার। কারণ ভদ্রলোকের চোখে নীল চশমা, মাথায় টাক আর যখনই যুবকটি কিছু বলতে চাইছিল তখনই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাঁর কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হচ্ছিল একটিমাত্র ধ্বনি-পুঃ। কিন্তু গল্পটা শুরু কর ভাই। তোমার এই মিলারটিকে আমার বেশ ভালো লাগছে। অনেক সৎগুণ তার মধ্যে দেখতে পাচ্ছি।
লিনেট বলল–বসন্ত আসার সঙ্গে সঙ্গে মিলার তার স্ত্রীর কাছে ঘোষণা করল যে খুদে হ্যালস-এর সঙ্গে দেখা করতে যাবে।
তার স্ত্রী সানন্দেই বলল–সত্যিই তোমার হৃদয় কত উদার। তুমি সব সময় অন্য লোকের কথা ভাবা যাই হোক, ফুল আনার জন্যে সেই বড়ো ঝুড়িটা নিয়ে যেতে ভুলো না যেন।
যথারীতি ব্যবস্থা গ্রহণ করে মিলার হ্যানস-এর সঙ্গে দেখা করতে গেল।
গুডমর্নিং হ্যানসা শীতকালটা কাটল কেমন?
হ্যানস বলল–প্রশ্নটা করে তোমার হৃদ্যতারই পরিচয় দিযে। না, খুব কষ্টেই গিয়েছে। কিন্তু বসন্তকাল এসে গিয়েছে। আমি এখন খুশিই। আমার ফুল সব ভালোই কাটছে।
মিলার বলল–সারা শীতকালটাই আমরা তোমার কথা ভেবেছি। তুমি যে কেমন করে কাটাচ্ছ তাই ভেবেই অবাক হচ্ছিলাম আমরা।
ধন্যবাদ। ধন্যবাদ। আমি তো ভেবেছিলাম তোমরা আমাকে প্রায় ভুলেই গিয়েছ।
তোমার কথা শুনে অবাক হচ্ছি হ্যানসা বন্ধুত্ব কাউকে ভুলতে দেয় না। এর সম্বন্ধে ওইটাই হল সবচেয়ে আশ্চর্য কথা মনে হচ্ছে, জীবন-কাব্য বলতে কী বোঝায় তা তুমি জান না। ভালো। কথা! তোমার ওই প্রিমরোভগুলি সত্যিই কী সুন্দর।
হ্যানস বলল–নিশ্চয়, নিশ্চয়। আমার ভাগ্য ভালো যে অতগলো সন্দর প্রিমরোজ ফল আমার বাগানে ফুটেছে। আমি ওগুলি বাজারে নিয়ে গিয়ে বার্গোমাস্টারের মেযেকে বিক্রি করব; আর সেই টাকায় আমার একচাকার ঠেলাগাড়িটা ফিরিয়ে নিয়ে আসব।
ফিরিয়ে আনবে? তুমি কি সেটা বিক্রি করে দিয়েছিলে?
বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলাম। বুঝতেই পাচ্ছ শীতকালটাই হচ্ছে আমার দুঃসময়। তখন রুটি কেনার মতো পয়সাও আমার হাতে থাকে না। প্রথমে বিক্রি করলাম রুপোর বোতাম, তারপরে কুপোর চেন, তারপরে সেই বড়ো পাইপ, তারপরে ঠেলাগাড়ি, এখন আমি সব কটাই ফিরিয়ে আনব।
মিলার বলল–হ্যানস, আমি তোমাকে আমার ঠেলাগাড়িটা দেব। গাড়িটা অবশ্য খুব একটা ভালো অবস্থায় যে নেই সেকথা অবশ্য মিথ্যে নয়। তবু সেটা আমি তোমাকে দেব। আমি জানি এ থেকে আমার হৃদযটা যে কতটা দরাজ তাই প্রমাণিত হবে; আর ওটা বিলিয়ে। দেওয়ার জন্যে অনেকে যে আমাকে মূর্খ বলবে সেদিক থেকেও আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি বিশ্বের আর দশটা মানুষের মতো নই। আমি জানি উদারতাই হচ্ছে বন্ধুত্বের মূল কথা। আর তা ছাড়া, আমার একটা নতুন ঠেলাগাড়ি রয়েছে। তুমি নিশ্চিন্ত হও। আমি ওটা তোমাকে দেব।
খুদে চেহারার হ্যানস-এর মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল; সে বলল–সত্যিই বড়ো উদার তুমি। বাড়িতে আমার কিছু কাঠের তক্তা রয়েছে। ওগুলি দিয়ে কম খরচেই আমি ওটা সারিয়ে নিতে পারব।
মিলার বলল–কী বললে! কাঠের তক্তা। আরে, আমার গোলার ছাদের জন্য ঠিক ওইগুলিই তো আমার চাই। ছাদে একটা বিরাট গর্ত হয়েছে সেই গর্তটা বোজাতে না পারলে বৃষ্টির জলে আমার সব শস্য নষ্ট হয়ে যাবে। কী সৌভাগ্য যে তুমি খবরটা দিলে! একটা সৎকাজের ইঙ্গিত আর একটা সৎকাডের সংবাদ কী করে দেয় এইটাই হল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমি তোমাকে আমার ঠেলাগাড়ি দিয়েছি; তুমি আমাকে তোমার তক্তা দাও। অবশ্য তক্তার চেয়ে ঠেলাগাড়ির দাম অনেক বেশি। কিন্তু সত্যিকার বন্ধুত্ব কোনোদিন দর কষাকষি করে না। অনুগ্রহ করে ওগুলি আমাকে দাও; আমি এখনই কাজ শুরু করে দিই।