রুবাইয়াত্-ই-ওমর খৈয়াম – ১৫১-১৬০
১৫১
আসনি তো হেথায় আমি আপন স্বাধীন ইচ্ছাতে,
যাবও না নিজ ইচ্ছামতো, খেলার পুতুল তাঁর হাতে।
ক্ষীণ কাঁকালে জড়িয়ে আঁচল, ঢালো সাকি বিলাও মদ,
পিয়ালা ভরো সেই পানিতে – ধরার কালি ধোয় যাতে।
১৫২
ঘেরাটোপের পর্দা-ঘেরা দৃষ্টি-সীমা মোদের ভাই,
বাইরে ইহার দেখতে গেলে শূন্য শুধু দেখতে পাই।
এই পৃথিবীর আঁধার বুকে মোদের সবার শেষ আবাস –
বলতে গেলে ফুরোয় না আর বিষাদ-করুণ সেই কথাই।
১৫৩
আমার রোগের এলাজ করো পিইয়ে দাওয়াই লাল সুরা,
পাংশু মুখে ফুটবে আমার চুনির লালি, বন্ধুরা!
মরব যেদিন – লাল পানিতে ধুয়ো সেদিন লাশ আমার,
আঙুর-কাঠের ‘তাবুত’ করো, কবর দ্রাক্ষাদল-ঝুরা।
১৫৪
পেয়ালার প্রেম যাচ্ঞা করো, থেমো না এক মু্হূর্তও
থাকবে হৃদয় মগজ তাজা মদ দিয়ে তায় ভিজিয়ে থোও!
আদমেরে করত প্রণাম শয়তান দু-হাজার বার –
হায় যদি সে গিলতে পেত বিন্দু-প্রমাণ আঙুর-মউ।
১৫৫
অঙ্গে রক্ত-মাংসের এই পোশাক আছে যতক্ষণ
তকদিরের ওই সীমার বাইরে করিসনে তুই পদার্পণ।
নোয়াসনে শির, ‘রুস্তম জাল’ শত্রু যদি হয় রে তোর,
দোস্ত যদি হয় ‘হাতেম-তাই’ তাহারও দান নিসনে শোন।
১৫৬
কইল গোলাপ, “মুখে আমার ‘ইয়াকুত’ মণি, রং সোনার,
গুলবাগিচার মিশর দেশে য়ুসোফ আমি রূপকুমার।”
কইনু, ‘প্রমাণ আর কিছু কি দিতে পারো?’ কইল সে,
‘রক্তমাখা এই যে পিরান পরে আছি, প্রমাণ তার!’
১৫৭
হৃদয় ছিল পূর্ণ প্রেমে, পেয়েছিলাম তায় একাও,
বক্ষে ছিল কথার সাগর, একটি কথা কইনি তাও।
দাঁড়িয়ে ভরা নদীর তীরে মরলাম আমি তৃষ্ণাতুর,
বিস্ময়কর এমন শহিদ দেখেছ আর কেউ কোথাও?
১৫৮
‘ইয়াসিন’ আর ‘বরাত’ নিয়ে, সাকি রে, রাখ, তর্ক তোর!
আমায় সুরার হাত-চিঠে দাও, সেই সে ‘সুরা বরাত’ মোর।
যে রাতে মোর শ্রান্তি ব্যথা ডুবিয়ে দেবে মদের স্রোত,–
সেই সে ‘শবে-বরাত’ আমার সেই তো আমার বরাত জোর।
১৫৯
ভূলোক আর দ্যুলোকেরই মন্দ ভালোর ভাবনাতে,
বে-পরোয়া ঘুরে বেড়াই ভাটিখানার আড্ডাতে।
গোলোক হয়ে পড়ত যদি মোর ঘরে ওই যুগল লোক,
মদের নেশায় বিকিয়ে দিতাম ওদের একটা আধলাতে।
১৬০
এই নেহারি – নিবিড় মেঘে মগ্ন আছে মুখ তোমার,
একটু পরেই ঠিকরে পড়ে ভুবন-মোহন দীপ্তি তার।
মহলা দাও নিজ মহিমার নিজের কাছেই, হে বিরাট,
দ্রষ্টা তুমি, দৃশ্য তুমি তোমার অভিনয়-লীলার!
রুবাইয়াত্-ই-ওমর খৈয়াম – ১৬১-১৭০
১৬১
আমরা দাবা খেলার ঘুঁটি, নাই রে এতে সন্দ নাই!
আশমানি সেই রাজ-দাবাড়ে চালায় যেমন চলছি তাই।
এই জীবনের দাবার ছকে সামনে পিছে ছুটছি সব,
খেলার শেষে তুলে মোদের রাখবে মৃত্যু-বাক্সে ভাই!
১৬২
আশমানি হাত হতে যেমন পড়বে ঘুঁটি ভাগ্যে তোর।
পণ্ডশ্রম করিসনে তুই হাতড়ে ফিরে সকল দোর!
এই জীবনের জুয়াখেলায় হবেই হবে খেলতে ভাই
সৌভাগ্যের সাথে বরণ করে নে দুর্ভাগ্য তোর।
১৬৩
চাল ভুলিয়ে দেয় রানি মোর, খঞ্জন ওই চোখ খর,
বোড়ে দিয়ে বন্দী করে আমার ঘোড়া গজ হরো!
তোমার সকল বল আগিয়ে কিস্তির পর কিস্তি দাও,
শেষে লালা-রুখ দেখিয়ে ‘রুখ’ নিয়ে মোর মাত করো!
১৬৪
আশমানে এক বলীবর্দ রয় ‘পর্বিণ’ নাম তাহার,
আছে আরেক বৃষভ নীচে বইতে মোদের ধরার ভার।
কাজেই, এই যে মানবজাতি – জ্ঞানীর চক্ষে হয় মালুম –
ওই সে ভীষণ ষাঁড় যুগলের মধ্যে যেন ঝাঁক গাধার!
১৬৫
শ্রেষ্ঠ শরাব পান করে নেয় বদরসিকে, হায় রে হায়!
স্থূল-আত্মা মূর্খ ধনিক শ্রেষ্ঠ বিলাস বিভব পায়।
হায় রে যত চিত্তহারী রূপকুমারী জর্জিয়ার
শুকায় কিনা গুম্ফবিহীন বালক-সাথে মাদ্রাসায়!
১৬৬
রূপ লোপ এর হয় অরূপে, অস্থি ইহার হয় না নাশ।
এই মদিরা – হাজার রূপে অরূপে এর হয় প্রকাশ,
ভেবো না কেউ সুরার সাথে সুরার সারও যায় উবে,
কভু এ হয় প্রাণী কভু তরুলতা, ফুল-সুবাস।
১৬৭
লাল গোলাপে কিস্তি দিয়ে তোমার ও গাল করে মাত,
খেলতে গিয়ে চীনকুমারী হারে প্রিয়া তোমার সাথ।
খেলতে বাবিল-রাজার সাথে হানলে চাউনি একটিবার
মন্ত্রী ঘোড়া গজ নিলে তার হেনে ওই এক নয়নপাত!
১৬৮
তোমার-আমার কী হবে ভাই তাই ভেবে মোর ব্যাকুল মন!
মীনকুমারী হংসীরে কয়, ‘শুকাবে এই বিল যখন!’
মরালী কয়, ‘কাবাব যদি হই দু-জনাই তুই-আমি,
ভাসলে এ বিল মদের স্রোতে মোদের কি তায় লাভ তখন।’
১৬৯
ঘূর্ণমান ওই কুগ্রহ-দল – সদাই যারা ভয় দেখায় –
ঘুরছে ওরা ভোজবাজির ওই লন্ঠনেরই ছায়ার প্রায়
সূর্য যেন মোমবাতি আর ছায়া যেন পৃথ্বী এই,
কাঁপছি মোরা মানুষ যেন প্রতিকৃতি আঁকা তায়।
১৭০
ফিরনু পথিক সাগর মরু ঘোর বনে পর্বতশিরে
এই পৃথিবীর সকল দেশে গুহায় ঘরে মন্দিরে,
শুনলাম না – ফিরছে কেউ তীর্থ-পথিক এই পথের,
আজ এ পথে যাত্রা যাহার, আসল না সে কাল ফিরে!
রুবাইয়াত্-ই-ওমর খৈয়াম – ১৭১-১৮০
১৭১
দুই জনাতেই সইছি সাকি নিয়তির ভ্রুভঙ্গি ঢের,
এই ধরাতে তোমার আমার নাই অবসর আনন্দের।
তবুও মোদের মাঝে আছে মদ-পিয়ালা যতক্ষণ
সেই তো ধ্রুব সত্য, সখী, পথ দেখাবে সেই মোদের!
১৭২
স্রষ্টা মোরে করল সৃজন জাহান্নমে জ্বলতে সে,
কিংবা স্বর্গে করবে চালান – তাই বা পারে বলতে কে!
করব না ত্যাগ সেই লোভে এই শরাব সাকি দিলরুবা,
নগদার এ ব্যবসা খুইয়ে ধারে স্বর্গ কিনবে কে?
১৭৩
দুর্ভাগ্যের বিরক্তি পান করতে যেন না হয় আর,
পানই যদি করি, পানি পান করব পানশালার।
এই সংসার হত্যাকারী, রক্ত তাহার লাল শরাব,
আমাদের যে খুন করে, কি? করব না পান খুন তাহার?
১৭৪
ওমর রে, তোর জ্বলছে হৃদয় হয়তো নরকেই জ্বলি,
তাহার বহ্নি-মহোৎসবে হয়তো হবি অঞ্জলি।
খোদায় দয়া শিখাতে যাস সেই সে তুই, কী দুঃসাহস।
তুই শিখাবার কে, তাঁহারে শিখাতে যাস কী বলি?
১৭৫
কুগ্রহ মোর! বলতে পারিস, করেছি তোর ক্ষতি কোন
সত্যি বলিস, মোর পরে তুই বিরূপ এত কী কারণ।
একটু মদের তরে এত উঞ্ছবৃত্তি তোষামোদ
এক টুকরো রুটির তরে, ভিক্ষা করাস অনুক্ষণ।
১৭৬
জল্লাদিনি ভাগ্যলক্ষ্মী, ওর্ফে ওগো গ্রহের ফের!
স্বভাব-দোষে চিরটা কাল নিষ্ঠুরতার টানছ জের।
বক্ষ তোমার বিদারিয়া দেখতে যদি এই ধরা
খুঁজে পেত ওই বুকে তার হারা-মণি-মানিক ঢের।
১৭৭
ভাগ্যদেবী! তোমার যত লীলাখেলায় সুপ্রকাশ
অত্যাচারী উৎপীড়কের দাসী তুমি বারো মাস।
মন্দকে দাও লাখ নিয়ামত ভালোকে দাও দুঃখ শোক,
বাহাত্তুরে ধরল শেষে? না এ বুদ্ধিভ্রম বিলাস?
১৭৮
সইতে জুলুম খল নিয়তির চাও বা না চাও শির নোওয়াও!
বাঁচতে হলে হাত হতে তার প্রচুরভাবে মদ্য খাও।
তোমার আদি অন্ত উভয় এই সে ধুলামাটির কোল,
নিম্নে নয় আর এখন তুমি ধরার ধূলির ঊর্ধ্বে ধাও।
১৭৯
মোক্ষম বাঁধ বেঁধেছে যে মোদের স্বভাব-শৃঙ্খলে,
স্বভাব-জয়ী হতে আবার আমাদের সেই বলে!
দাঁড়িয়ে আছি বুদ্ধিহত তাই এ দুয়ের মাঝখানে-
উলটে ধরবে কুঁজো কিন্তু জল যেন তার না টলে!
১৮০
মানুষ খেলার গোলক প্রায় ফিরছে ছুটে ডাইনে বাঁয়,
যেদিক পানে চলতে বলে ক্রূর নিয়তির হাতা তায়।
কেন হলি ভাগ্যদেবীর নিঠুর খেলার পুতুল তুই,
সে-ই জানে – এক সে-ই জানে রে, আমরা পুতুল অসহায়।