- বইয়ের নামঃ রুবাইয়াত-ই-হাফিজ
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃঅনুবাদ বই
রুবাইয়াত-ই-হাফিজ – ০১-১০
১
তোমার ছবির ধ্যানে, প্রিয়, দৃষ্টি আমার পলক-হারা।
তোমার ঘরে যাওয়ার যে-পথ, পা চলে না সে-পথ ছাড়া।
হায়, দুনিয়ায় সবার চোখে নিদ্রা নামে দিব্য সুখে,
আমার চোখেই নেই কি গো ঘুম দগ্ধ হল নয়ন-তারা॥
২
আমার সুখের শত্রু হতে লুকিয়ে চলে আয় লো ত্বরা।
আয়েশ-সুখের আমন্ত্রণ আজ শরাব দিয়ে পাত্র ভরা।
ঈর্ষাতুরের কুমন্ত্রণায় কোথায় যাবে, হে মোর ভীরু?
আমার প্রিয়া! শোনো শুধু আমার কথা দুখ-পাসরা॥
৩
করল আড়াল তোমার থেকে যেদিন আমার ভাগ্য-লেখা,
সেদিন হতে ফোটেনি আর আমার ঠোঁটে হাসির রেখা।
কী নিদারুণ সেই বিরহের বাজল ব্যথা আমার হিয়ায়; –
আমি জানি, আর সে জানে অন্তর-বিহারী একা॥
৪
আমার সকল ধ্যানে জ্ঞানে বিচিত্র সে সুরে সুরে
গাহি তোমার বন্দনা-গান, রাজাধিরাজ, নিখিল জুড়ে!
কী বলেছে তোমার কাছে মিথ্যা করে আমার নামে
হিংসুকেরা, – ডাকলে না আজ তাইতে আমায় তোমার পুরে॥
৫
আনতে বলো পেয়ালা শরাব পার্শ্বে বসে পরান-বঁধুর।
নিঙারি লও পুষ্প-তনু তন্বঙ্গীর অধর-আঙুর।
আহত যে – ক্ষত-ব্যথায় সোয়াস্তি চায়, চায় সে আরাম;
বিষম তোমার হৃদয়-ক্ষত, ডাকো হাকিম কপট চতুর॥
৬
ভাবনু, যখন করছে মানা বন্ধুরা সব আগলে ভাঁটি –
দিলাম ছেড়ে এবার ফুলের মরশুমে ভাই শরাব খাঁটি।
ফুল-বাগিচায় বুলবুলিরা উঠল গেয়ে, – হায় রে বেকুব,
এমন ফাগুন, ফুলের ফসল, নাইকো শরাব? – সকল মাটি॥
৭
বিশ্বে সবাই তীর্থ-পথিক তোমার পথের কুঞ্জ-গলির।
ছুটছে নিখিল মক্ষী হয়ে তোমার আনন-আনারকলির ।
আজকে যদি তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে রয় গো কেহ,
কোন্ চোখে কাল দেখবে তোমায় হায় রে বে-দিল সেই মুসাফির!
৮
তোমার আকুল অলক – হানে গভীর ছায়া রবির করে।
শুক্লা চতুর্দশীর শশী তোমার মুকুট, আঁধার হরে।
ও-কস্তুরী-কালো কেশের নিশান ওড়ায় সন্ধ্যারানি,
হেরে ও-মুখ, – উদয়-উষা – পাণ্ডুর চাঁদ ডুবে মরে॥
৯
ভিন্ন থাকার দিন গো আমার আজকে পরান-প্রিয়ার সাথে।
বন্ধু নিয়ে খুশির মউজ – নেই গো সময় আজকে রাতে।
কী ফল রয়ে সাবধানে আজ, কাছে যখন নেইকো শরাব?
না, না, – কাছে শরাব আছে, নেইকো প্রিয়াই মন ভোলাতে॥
১০
আমার পরান নিতে যে চায় নিঠুরা রূপের পরি,
পরির মতোই রূপেরে সে রাখে আঁখির আড়াল করি।
কইনু তারে, ‘তুমি যে কও, এই তো এ-মুখ কী আর এমন?’
জবাব দিল, ‘তাই তো বলি লোভ কোরো না এ মুখ স্মরি।’
রুবাইয়াত-ই-হাফিজ – ১১-২০
১১
রক্ত-রাঙা হল হৃদয় তোমার প্রেমের পাষাণ-ব্যথায়।
তোমার ও-রূপ জ্ঞান-অগোচর, পৌঁছে নাকো দৃষ্টি সেথায়।
জড়িয়ে গেল ভীরু হৃদয় তোমার আকুল অলক-দামে,
সন্ধ্যা-কালো কেশে বাঁধা দেখছি ওরে ছাড়ানো দায়॥
১২
রবি, শশী, জ্যোতিষ্ক সব বান্দা তোমার, জ্যোতির্মতি!
যেদিন হতে বান্দা হল – পেল আঁধার-হরা জ্যোতি।
রাগে-অনুরাগে মেশা তোমার রূপের রৌশনীতে
চন্দ্র হল স্নিগ্ধ-কিরণ সূর্য হল দীপ্ত অতি॥
১৩
যেদিন হতে হৃদয়-বিহগ ব্যথার জালে পড়ল ধরা,
সেই হতে তার মাথার পরে ঝুলছে ছুরি রক্ত-ঝরা।
ত্যক্ত আমি হাতের কাছের পেয়ালা-ভরা শরবতে, তাই
করতেছি পান-পাত্রে ব্যথার রক্ত আমার হৃদয়-ক্ষরা॥
১৪
আমার করে তোমার অলক জড়িয়ে বীণার তারের মতো।
এ হৃদি-ভার আমার – শুধু তোমার ঠোঁটে হয় আনত।
চিকন তোমার ও-মুখখানি ভুখা হিয়ার সান্ত্বনা মোর
সর্বগ্রাসী মোর ক্ষুধার খোরাক ওই দেহটুক? হায় বিধাতঃ॥
১৫
তোমার পথে মোর চেয়ে কেউ সর্বহারা নাইকো, প্রিয়!
আমার চেয়ে তোমার কাছে নাই সখী, কেউ অনাত্মীয়।
তোমার বেণির শৃঙ্খলে গো নিত্য আমি বন্দি কেন? –
মোর চেয়ে কেউ হয়নি পাগল পিয়ে তোমার প্রেম-অমিয়॥
১৬
দলতে হৃদয় ছলতে পরান দক্ষ সদা আমার প্রিয়া।
তারই মিলন মাগি ঝুরে ভাগ্য-হত আমার হিয়া।
গোলাব-ফুলী গাল গো তাহার, রুপালি মুখ, চিকন অধর;
ফুলকে ভোলায় ফুল্লমুখী মিঠে হাসির ছিটেন দিয়া॥
১৭
পরান-ভরে পিয়ো শরাব, জীবন যাহা চিরকালের।
মৃত্যু-জরা-ভরা জগৎ, ফিরে কেহ আসবে না ফের।
ফুলের বাহার, গোলাব-কপোল, গেলাস-সাথি মস্ত্ ইয়ার,
এক লহমার খুশির তুফান, এই তো জীবন! – ভাবনা কীসের॥
১৮
আয়না তোমার আত্মার গো – তরল তোমার ওই লাবণি
সাধ জাগে ওই ধ্যানের চরণ করি আমার নয়ন-মণি।
না, না, আমার ভয় করে গো, নয়ন-পাতার কাঁটায় পাছে
কমল-পায়ে বাজে ব্যথা! ধেয়ানে থাক সারাক্ষণই॥
১৯
রঙিন মিলন-পাত্র প্রথম পান করালে ইমান্দারি ।
নেশায় যখন বুঁদ হয়েছি – জাল বিছালে অত্যাচারী।
আঁখির সলিল-ধারা গো, আর বুকের আগুন-জ্বালা নিয়ে
ভেজাই পোড়াই আপনারে পথের ধূলি হয়ে তারই॥
২০
তোমার মুখের মিল আছে, ফুল, সাথে সে এক কমল-মুখীর।
যে-ফুল হেরে দিল দেওয়ানা , গন্ধ যথা সদাই খুশির।
সাধ জাগে – এক ফুলদানিতে রাখি তোরে আর তাহারে,
ফুলেল ঠোঁটে চুম্ব নিতে লাগবে সুবাস পুষ্প-মদির॥
রুবাইয়াত-ই-হাফিজ – ২১-৩০
২১
আপন করে বাঁধতে বুকে পারেনি কেউ তনু প্রিয়ার –
জ্ঞান-বুদ্ধি-বিত্ত মাঝে বদ্ধ থাকে চিত্ত-যাহার।
আমার কথা ঠাঁই পেল না চপল-আঁখি প্রিয়ার কানে –
রত্ন-দুল সে রইল পড়ে, কর্ণে কভু উঠল না আর!
২২
সোরাই -ভরা রঙিন শরাব নিয়ে চলো নদীর তটে।
নিরভিমান প্রাণে বসো – অনুরাগের ছায়া-বটে।
সবারই এই জীবন যখন সেরেফ দুটো দিনের রে ভাই,
লুঠ করে নাও হাসির মধু, খুশির শরাব ভরো ঘটে॥
২৩
তোমার হাতের সকল কাজে হবে শুভ নিরবধি –
প্রিয়, তোমার ভাগ্যবশে নিয়তির এই নিদেশ যদি;
দাও তাহলে, পান করে নিই তোমার-দেওয়া শিরীন শরাব,
হলেও হব চির-অমর, হয়তো ও-মদ সুধা-নদী॥
২৪
কুঁড়িরা আজ কার্বা -বাহী বসন্তের এই ফুল-জলসায়।
নার্গিসেরা দল নিয়ে তার পাত্র রচে সুরার আশায়।
ধন্য গো সে-হৃদয়, যে আজ বিম্ব হয়ে মদের ফেনায়
উপচে পড়ে শরাব-খানার তোরণ-দ্বারের পথের ধুলায়॥
২৫
কুন্তলেরই পাকে প্রিয়ার – আশয় খোঁজে আমার পরান।
অভিশপ্ত এই জীবনের কারার থেকে চায় যেন ত্রাণ।
‘কী দেবে দাম’ শুধায় তাহার দেহের গেহের রূপ-দুয়ারী
প্রিয়ার ভুরুর তোরণ-তলে পরান দিলাম নজরানা-দান॥
২৬
চাঁদের মতো রূপ গো তোমার ভরছে কলঙ্কেরই দাগে।
অহংকারের সোনার বাজার ডুবছে ক্রমে ক্রান্তি-ফাগে।
লজ্জা অনেক দেছ আমায়, প্রেম নাকি মোর মিথ্যাভাষণ!
আজ তো এখন পড়ল ধরা কলঙ্ক কোন্ মুখে জাগে॥
২৭
রূপসিরা শিকার করে হৃদয়-বনের শিকারীকে –
দেহে তাহার রূপের অধিক অলংকারের চমক লিখে।
নার্গিস – যার শিরে হের ফুলের রানির মুকুট-পরা
নিরাভরণ – তবু তারই রটে খ্যাতি দিগ্বিদিকে॥
২৮
তোমার ডাকার ও-পথ আছে ব্যথার কাঁটায় ভরে খালি।
এমন কোনো নেই মুসাফির ও-পথ বেয়ে চলবে, আলি!
জ্ঞানের রবি ভাস্বর যার, তুমি জান কে সে সুজন –
প্রাণের রূপের পিলসুজে যে দেয় গো ব্যথার প্রদীপ জ্বালি॥
২৯
যেদিন আমায় করবে সুদূর তোমার থেকে কাল-বিরহ,
পড়বে যতই মনে, ততই দিন হবে মোর দুর্বিষহ।
ভুলেই যদি এ চোখ পড়ে আর-কোনো রূপসির রূপে,
অন্ধ আমি বইব তোমার রূপের দাবি অহরহ॥
৩০
দাও মোরে ওই গেঁয়ো মেয়ের তৈরি খাঁটি মদ পুরানা।
তাই পিয়ে আজ গুটিয়ে ফেলি জীবনের এই গালচেখানা।
যদি ধরার মন্দ ভালো দাও ভুলিয়ে মস্ত্ করে,
জানিয়ে দেব এই সৃষ্টির রহস্যময় সব অজানা॥
রুবাইয়াত-ই-হাফিজ – ৩১-৪০
৩১
পূর্ণ কভু করে নাকো সুন্দর-মুখ দিয়ে আশা।
প্রেমের লাগি যে বিবাগি – ভাগ্য তাহার সর্বনাশা।
প্রিয়া তব লক্ষ্মী সতী তোমার মনের মূর্তিমতী?
প্রেমিক-দলের নও তুমি কেউ, পাওনি প্রিয়া-ভালোবাসা॥
৩২
মদ-লোভীরে মৌলোভী কন, – পান করে এই শরাব যারা,
যেমন মরে তেমনি করে গোরের পারে উঠবে তারা।
তাই তো আমি সর্বদা রই শরাব এবং প্রিয়ার সাথে,
কবর থেকে উঠব – নিয়ে এই শরাব, এই দিল-পিয়ারা ॥
৩৩
তারই আমি বান্দা গোলাম, শৌখিন যে রস-পিয়াসি।
গলায় যাহার দোলায় বিধি পাগল প্রেমের শিকলি ফাঁসি।
প্রেমের এবং প্রেম জানানোর স্বাদ অ-রসিক বুঝবে কীসে?
পান করে এ সুরার ধারা সুর-লোকের রূপ-বিলাসী॥
৩৪
হয় না ধরার বিভবরাশি জোর জুলুমে হস্তগত,
আনন্দের এই জীবন-সুধার পায় নাকো স্বাদ বিষাদ-হত।
খুঁজছ তুমি পাঁচটা দিনের দুঃখ ভোগের পরিশ্রমে,
সাতশো হাজার বছর ধরে জমল ধরায় খুশি যত!!
৩৫
আনন্দ আর হাসি-গানের প্রমত্ততার সময় হল
পেয়ালা, শরাব, দিল-দরদি , দিলরুবা নাও, বেরিয়ে চলো!
একটি ফুঁয়ের এই তো জীবন! তাই তো বলি, ক্ষণেক তরে
কুঁজোর আঙুর-রক্ত ঢেলে গেলাস বাটি রঙিয়ে তোলো!
৩৬
দরবেশ – আমার সামনে এল ফিরে তোমার সেই বিরহ,
বুকের কাঁটা-ঘায়ে যেন নুনের ছিটে দুর্বিষহ।
ভয় ছিল, যে, তোমার থেকে আর কিছুদিন রইব দূরে,
দেখছি শেষে আসল আবার সেই অশুভ দিন অ-বহ॥
৩৭
বিষাদ-ক্ষীণ এ অন্তরে মোর থাকে যেন তোমার নজর,
তৃণকুটোর পরে তো গো পড়ে রবির প্রভাতি কর!
যদি তোমার পথের ধূলি হই গো প্রিয়, – নারাজ হয়ে
গাল দিয়ো না! পাছে শোনে পথের ধূলি তোমার সে স্বর॥
৩৮
বিশ্বাসেরে মেরে – হল প্রাণের বন্ধু শত্রু শেষে,
কত পথিক পথ হারাল অবিশ্বাসের গহন দেশে।
পুরুষ-‘দিবা’র ঔরসে গো ‘রাত্রি’ নাকি গর্ভযুতা,
দেখল না যে পুরুষ – হল ধৃতগর্ভা কেমনে সে॥
৩৯
ক্ষত হৃদয় যেমন চাহে, হয় যদি গো, তেমনিটি হোক।
নয় উড়ে যাক হৃদয়-বিহগ অলখ-বিহার আত্মার লোক।
আজও খোদার দরগাতে গো এতটুকু ভরসা রাখি,
সকল দুয়ার খুলবে গো তার ভাগ্যদেবীর স্বর্গ অ-শোক॥
৪০
কী লাভ, যখন দুষ্ট ভাগ্য হাসল নাকো মুখ ফিরিয়ে,
পেল না দিল সুখের সোয়াদ, দিন কাটাল ব্যথাই নিয়ে!
যে ছিল মোর চোখের জ্যোতি, পুতলা আঁখির, গেছে চলে!
নয়ন-মণিই গেল যদি, কী হবে এ নয়ন দিয়ে॥
রুবাইয়াত-ই-হাফিজ – ৪১-৫০
৪১
সকল-কিছুর চেয়ে ভালো সুরাই – যখন কাঁচা বয়েস,
প্রণয়-বেদন, মওতা, পাপ – যৌবনেরই একার আয়েশ
এই সে তামাম দুনিয়াটা-ই বরবাদ আর খারাব রে ভাই,
মন্দ ধরায় মন্দ যা – তার প্রমত্ততাই মানায় যে বেশ॥
৪২
আয়ুর মরু বেয়ে এল খ্যাপা প্লাবন আকুল ধারায়,
এই তো জীবন পান-পিয়ালা ভরার সময় কানায় কানায়।
হুঁশিয়ার হও সাহেব! যেন খুশি হয়ে কালের কুলি
তোমার জীবন-গেহ থেকে আসবাব সব উঠিয়ে নে যায়॥
৪৩
আলতো করে আঙুল রেখে প্রিয়ার কালো পশমি কেশে,
কইনু তারে, ‘দাও গো জীবন, এসেছি অমৃতের দেশে।’
কইল প্রিয়া, ‘অলক ছাড়ো, তার চেয়ে এই অধর ধরো!
খুঁজো নাকো দীর্ঘজীবন – ফুর্তি মউজ ওড়াও হেসে’॥
৪৪
বিনিদ্র কাল কাটল নিশি একলা জেগে তোমার ব্যথায়,
অশ্রু-মণির হার গেঁথেছি নয়ন-পাতার ঝালর-সুতায়।
তোমার তরে প্রাণ-পোড়ানি কইতে নারি কারুর কাছে,
আপন মনে তাই সারাদিন আপন ব্যথা কই আপনায়॥
৪৫
বীরত্ব শেখ ‘খয়বরী-দ্বার-ভগ্ন-কারী ‘আলি’ র কাছে,
দান কারে কয় শিখতে হলে ‘কুনবরের’ ওই বাদশা আছে।
ওরে হাফিজ, পিয়াসি কি তুই করুণা-বারির তরে?
শরাব-সুধার সাকি জানে উৎস তাহার কোন্ কানাচে॥
৪৬
প্রিয়া তোমায় দেছে দাগা? বন্ধু , পীড়ন সহ্য করো!
আমার পরামর্শ শোনো, সকল ভুলে শরাব ধরো।
মতলব হাসিল করো তোমার খুবসুরতি রতির সাথে,
অন্তর দিয়ো না তারে যে তব অযোগ্যতর॥
৪৭
‘বাবিলনের’ জাদু বুঝি গুরু তব চটুল চোখের,
হার মানে ও চোখের কাছে, জাদুকরি সকল লোকের!
দুলছে যে ওই অলক-গুছি রূপকুমারীর কর্ণমূলে
দুলে যেন হাফিজের এই কাব্য-মোতির চারপাশে ফের॥
৪৮
দেখ রে বিকচ ফুলকুমারীর রূপ-সুষমার আনন-শোভা,
দেখ বাদলের কাঁদন সাথে ফুলের হাসি মনোলোভা!
কীসের এত ঠমক দেখায় দেবদারু আজ দখনে হাওয়ায়,
ফুলরানিরে করবে বীজন দোল দিল এই আনন্দ বা!
৪৯
বুক হতে তার পিরান খোলে শ্যামাঙ্গী ওই তন্বী যখন,
ঠিক উপমা পাইনে খুঁজে সে মাধুরী দেখায় কেমন!
এমনি তরল রূপ গো তাহার – বুকের তলে হৃদয় দেখায়,
স্বচ্ছ দিঘির কালো জলে সুডৌল পাষাণ-নুড়ি যেমন॥
৫০
মোমের বাতি! পতঙ্গে এ ভুলেও কি গো স্মরণ করো?
আমার কাছে – ভালোবেসে ভুলে যাওয়া কেমনতর!
তোমার তরে যে বেদনার ফল্গুধারা বয় এ হৃদে,
জানে শুধু জীবন-মরুর বালুর চর এ রৌদ্র-খর॥
রুবাইয়াত-ই-হাফিজ – ৫১-৬০
৫১
কে দেখেছে সরল মনের প্রিয়া গো – যে দেখব আমি!
আমার মতো অনেকে ওই প্রাণ-পীড়নের মুক্তিকামী।
করব কী আর – পরান-প্রিয় তুমিই যদি কপট এত!
আমার মতো ভাগ্য সবার দেখনু সমান বিপথ-গামী॥
৫২
সেই ভালো মোর – এই শরাবের পিয়ালা দিয়ে তর করি দিল,
যে সাধ আমার পুরল না তা ভুলব গো আজ করব বাতিল।
ধার-করা এ জীবন আমার বন্দি নিতি বুদ্ধি-কারায়,
আজ নিমেষের মুক্তি দেব তারে, ভেঙে কারার পাঁচিল॥
৫৩
আনন্দের ওই বিহগ-পাখার শব্দ শুনি অদূর নভে,
কিংবা গো ও নম্র-চিতের ফুলবাগানের খোশবু হবে।
অথবা ওই মৃদুল হাওয়া তোমার শিরীন ঠোঁটের ভাষা,
কী এ যেন, এক অপরূপ রূপকথা কি শুনছি তবে?
৫৪
কাঁদি তোমার বিরহে গো বেশি মোমের বাতির চেয়ে,
আরক্ত-ধার অশ্রু ঝরে মদের সোরাই সম বেয়ে।
আমি গো পান-পেয়ালা যেন, হৃদয় যখন কৃপণ হেরি –
দূর বাঁশরি-বিলাপ শুনি রক্ত-ধারায় উঠি ছেয়ে॥
৫৫
পরান-পিয়া! কাটাই যদি তোমার সাথে একটি সে রাত,
বসন সম জড়িয়ে রব নিমেষ পলক করব না পাত।
ভয় কী আমার, যদিই সখী তার পরদিন মৃত্যু আসে,
পান করেছি অমর-করা তোমার ঠোঁটের ‘আব-ই-হায়াত’॥
৫৬
আলিঙ্গন ও চুম্বন হায় মরল তোমার ধেয়ান করে
তোমার ঠোঁটের চুম না পেয়ে পান্না-চুনি গেল মরে।
কাহিনি আর বাড়াব না অল্পে সারি কল্পকথা, –
মরল কেহ ফিরে এসে প্রতীক্ষাতে জীবন ধরে॥
৫৭
দয়িত মোর! অল্পে এত ছাড়ব তোমায় কেমন করি,
মরকত-নীল ও-কেশ-ফাঁসে যতক্ষণ না প্রাণ বিসরি।
লোহিত চুনির ঠোঁট গো তোমার মোর জীবন-শক্তি সে যে,
লক্ষ প্রবাল বিনিময়েও পারব না তা দিতে, গোরি !
৫৮
দুঃখ ছাড়া এ-জীবন হল না আর কিছুই হাসিল,
বিষাদ হল সাথের সাথি তোমায় দিয়ে আমার এ দিল।
গোপন মনের স্বপন-সাথি পেলাম না গো বন্ধু কোনো,
ব্যথাই আমার ব্যথার ব্যথী, তোমার মতোই নিঠুর নিখিল॥
৫৯
আমায় প্রবোধ দেওয়ার তরে, ভোরের হাওয়া, বলো তারে –
যে পাষাণীর মন গলে না আমার শত অশ্রু-ধারে, –
‘সুখে তুমি ঘুমাও নিতি দুলে দুলে আরাম-দোলায়,
কার নয়নে ঘুম নাহি আর – উদয় কি হয় স্মরণ-পারে?’
৬০
আর কতদিন করবে, প্রিয়, এ উৎপীড়ন আমায় নিয়ে,
বিনা কারণ বিশ্ব-নিখিল জ্বালাবে ও -হৃদয় দিয়ে?
আশীর্বাদের সম অসি দুঃসাহসীর কঠোর হাতে,
তোমার হাতে পড়লে তাহা করবে তা খুন তোমায় প্রিয়ে॥
রুবাইয়াত-ই-হাফিজ – ৬১-৭৩ (শেষ)
৬১
কোরান হাদিস সবাই বলে – পবিত্র সে বেহেশ্ত নাকি,
মিলবে সেথাই আসল শরাব তন্বী হুরি ডাগর-আঁখি!
শরাব এবং প্রিয়ায় নিয়ে দিন কাটে মোর, দোষ কি তাতে?
বেহেশ্তে যা হারাম নহে – মর্ত্যে হবে হারাম তা কি?
৬২
চন্দ্র সূর্য রাত্রি দিবা বিচিত্র সে আবেগ ভরে,
ওগো প্রিয়, দেখি – তোমার ধূলির পরে নামটি করে!
হৃদয়-আঁখির সাধ হতে মোর করো না গো নিরাশ মোরে,
রইবে দূরে – বসিয়ে আমায় প্রতীক্ষার ওই অগ্নি পরে?
৬৩
মদের মতো কি আর আছে ভুলতে ব্যথা, তাতিয়ে তোলার?
যুদ্ধ করার সাধ জাগে কি সেনার সাথে এই বেদনার?
এই তো তোমার কাঁচা মাথা, এরই মাঝে বাতিল শরাব?
কাঁচা সবুজ বয়েসই তো খুশির, গানের পান-পিয়ালার॥
৬৪
পাতার পর্দানশিন মুকুল, ফুটেই হেরে তোমায় পাছে!
মাতোয়ালা ‘নার্গিস’ শরমে তোমায় হেরি মরণ যাচে।
তোমার কাছে রূপের বড়াই কেমন করে করবে গো ফুল?
ফুল পেল রূপ চাঁদ চোঁয়ায়ে, চাঁদ পেল রূপ তোমার কাছে॥
৬৫
আশ্বাসেরই বাণী তোমার প্রতীক্ষার ওই দূর সাহারায়
ফিরছে আজও, আর কতদিন ঢাকবে রবি মরুর ধুলায়?
বাঘের মুখে যাও গো যদি লালসা আর লোভের বশে,
আখেরে যে শিকার হবে গোরের হাতে মাটির তলায়!
৬৬
তোমার আঁখি – জানে যাহা বঞ্চনা আর ছল-চাতুরী,
চমকে বেড়ায় অসি যেন রণাঙ্গণে ঘুরি ঘুরি।
তড়িৎ-জ্বালার ও-চোখ ত্বরিত গোল বাধাবে বঁধুর সাথে,
যে হিয়াতে শিলা ঝরে, হায় গো তারই তরে ঝুরি॥
৬৭
দাও এ হাতে, ফুর্তি শিকার করে সদা যে বাজপাখি,
প্রিয়ার মতো প্রিয়ংবদা মদ-পিয়ালা দাও গো সাকি!
কুঞ্চিত ওই কুন্তল – যা পাক খেয়েছে শিকলি সম –
আনো গো তায় দোস্ত্, করো এই দিওয়ানার হস্ত-রাখি!
৬৮
হায় রে, আমার এ বদনসিব হত যদি মনের মতো!
কিংবা গ্রহের চক্র ঘুরে আবার আমার বন্ধু হত!
পালিয়ে যেত যৌবন মোর যখন হাতের মুঠি হতে,
রেকাব সম রাখতে ধরে এই জরারে সমুন্নত॥
৬৯
ফুল্লমুখী দিল-পিয়ারি, বীণা, বেণু, একটু আড়াল,
এক রেকাবি কাবাব, সাথে এক পেয়ালি শিরাজি লাল –
ধমনিতে উঠবে জ্বলে লকলকিয়ে অগ্নিশিখা, –
‘হাতেম-তাই’ -এর অনু্গ্রহও চাই না তখন মুহূর্ত কাল!
৭০
শাহি তখ্তে বসেছে ফুল – দেখনু সেদিন গুল-বাগিচায়,
কইনু – শোনো সত্য যদি দীপ্ত তুমি রাজ-মহিমায়,
নিষ্পাপ এক কিশোর আমি জ্বালাও তারেই রাত্রি দিবা,
তবু তোমার স্পর্শে না পাপ, চিরন্তনী, আপশোশ, হায়!
৭১
বন্দি বোঁটায় কইল কুসুম, থাকত যদি শক্তি আমার
পালিয়ে যাবার রাস্তা পেলে পালিয়ে যেতাম দূর বন-পার।
বিনা অপরাধেই মোরে এমন করে জ্বালায় যদি,
সত্যিকারের দোষী হলে না জানি সে করত কী আর॥
৭২
সেও এ মন্দ-ভাগ্যসম এমনি জালে ফাঁসত যদি
হত লাখো খারাবি তার শরাব নিয়ে নিরবধি।
আমি মাতাল, প্রেম-বিলাসী, পাগল, ভুবন-দাহনকারী, –
বসলে কাছে রটবে কুযশ তাই তো থাকি দুয়ার রোধি॥
৭৩
ওরে হাফিজ, শেষ কর তোর কৃত্রিম এই কলমবাজি!
হল সময় – খোলা পাতা ঝোলায় তুলে রাখার আজি।
নীরব হয়ে বসার পালা এবার রে তোর, আজকে শুধু
শূন্য গেলাস টইটম্বুর, কর রে ঢেলে শেষ শিরাজি ॥
– তামাম শোদ্ –