রুবাইয়াত্-ই-ওমর খৈয়াম – ০৯১-১০০
৯১
শরাব নিয়ে বসো, ইহাই মহ্মুদেরই সুলতানৎ,
‘দাউদ’ নবির শিরীন-স্বর ওই বেণু-বীণার মধুর গত।
লুট করে নে আজের মধু, পূর্ণ হবে মনস্কাম,
আজকে পেয়ে ভুলে যা তুই অতীত আর ভবিষ্যৎ।
৯২
ওগো সাকি! তত্ত্বকথা চার ও পাঁচের তর্ক থাক,
উত্তর ওই সমস্যার গো এক হোক কী একশো লাখ!
আমরা মাটির, সত্য ইহাই, বেণু আনো, শোনাও সুর!
আমরা হাওয়া, শরাব আনো! বাকি যা সব চুলোয় যাক।
৯৩
এক নিশ্বাস প্রশ্বাসের এই দুনিয়া রে ভাই, মদ চালাও!
কালকে তুমি দেখবে না আর আজ যে জীবন দেখতে পাও।
খামখেয়ালির সৃষ্টি এ ভাই কালের হাতে লুঠের মাল,
তুমিও তোমার আপনাকে এই মদের নামে লুটিয়ে দাও!
৯৪
কায়কোবাদের সিংহাসন আর কায়কাউসের রাজমুকুট,
তুসের রাজ্য একছিটে এই মদের কাছে সব যে ঝুট!
ধর্ম-গোঁড়ার উপাসনার কর্কশ যে প্রভাত-স্তব
তাহার চেয়ে অনেক মধুর প্রেমিক-জনের শ্বাস অফুট।
৯৫
এই যে প্রমোদ-ভবন যেথায় জলসা ছিল বাহরামের,
হরিণ সেথায় বিহার করে, আরাম করে ঘুমায় শের!
চিরজীবন করল শিকার রাজশিকারি যে বাহ্রাম,
মৃত্যু-শিকারির হাতে সে শিকার হল হায় আখের।
৯৬
ঘরে যদি বসিস গিয়ে ‘জমহুর’ আর ‘আরাস্তু’র,
কিংবা রুমের সিংহাসনে কায়সর হস শক্তি-শূর–
জামশেদিয়া জামবাটি ওই যে শুষে রে, সময় নাই,
বাহ্রামও তুই হস যদি, তোর শেষ তো গোর আঁধারপুর!
৯৭
প্রেমের চোখে সুন্দর সেই হোক কালো কি গৌর-বরন,
পরুক ওড়না রেশমি কিংবা পরুক জীর্ণ দীন বসন।
থাকুক শুয়ে ধুলোয় সে কি থাকুক সোনার পালঙ্কে,
নরকে সে গেলেও প্রেমিক করবে সেথায় অন্বেষণ।
৯৮
খৈয়াম – যে জ্ঞানের তাঁবু করল সেলাই আজীবন,
অগ্নিকুণ্ডে পড়ে সে আজ সইছে দহন অসহন।
তার জীবনে সূত্রগুলি মৃত্যু-কাঁচি কাটল, হায়!
ঘৃণার সাথে বিকায় তারে তাই নিয়তির দালালগণ!
৯৯
সাত-ভাঁজ ওই আকাশ এবং চার উপাদান-সৃষ্ট জীব!
ওই এগারোর মারপ্যাঁচে সব ধোয়াস গলিস, বদ-নসিব।
যে যায় সে যায় চিরতরে, ফেরত সে আর আসবে না,
পান করে নে বলব কত, বলে বলে ক্লান্ত জিভ!
১০০
খরাব হওয়ার শরাব-খানায় ছুটছি আমি আবার আজ,
রোজ পাঁচবার আজান শুনি, পড়তে নাহি যাই নামাজ!
যেমনি দেখি উদগ্রীব ওই মদের কুঁজো, অমনি ভাই–
কুঁজোর মতোই উদগ্রীব হই, কন্ঠ সটান হয় দরাজ।
রুবাইয়াত্-ই-ওমর খৈয়াম – ১০১-১১০
১০১
এই কুঁজো – যা আমার মতো ভোগ করেছে প্রেম-দাহন,
সুন্দরীদের মাথায় থাকি পেল খোঁপার পরশন।
এই সোরাহির পার্শ্বদেশ এই যে হাতল দেখতে পাও,
পেল কতই তন্বঙ্গীর ক্ষীণ কাঁকালের আলিঙ্গন!
১০২
দ্রাক্ষা সাথে ঢলাঢলির এই তো কাঁচা বয়স তোর,
বৎস, শরাব-পাত্র নিয়ে ঠায় বসে দাও আড্ডা জোর।
একবার তো নূহের বন্যা ভাসিয়েছিল জগৎখান,
তুইও না হয় ভাসিয়ে দিলি মদের স্রোতে জীবন তোর!
১০৩
সাবধান! তুই বসবি যখন শরাব পানের জলসাতে,
মদ খাসনে বদমেজাজি নীচ কুৎসিত লোক সাথে।
রাত্তির ভর করবে সে নীচ চিৎকার আর গণ্ডগোল,
ইতর সম চেঁচিয়ে কারণ দর্শাবে ফের সে প্রাতে।
১০৪
যদিও মদ নিষিদ্ধ ভাই, যত পার মদ চালাও,
তিনটি কথা স্মরণে রেখে ; কাহার সাথে মদ্য খাও?
মদ-পানের কি যোগ্য তুমি? কী মদই বা করছ পান?
জ্ঞান পেকে না ঝুনো হলে মদ খেয়ো না এক ফোঁটাও!
১০৫
তোমরা – যারা পান কর মদ আর সব দিন, কিন্তু যা
পান কর না শুক্রবারে, ছোঁও না শরাবের কুঁজা–
তাদের বলি – আমার মতো সব বারকে সমান জান,
খোদার তোরা পূজারি হ, করিস নাকো বার পূজা।
১০৬
করছে ওরা প্রচার – পাবি স্বর্গে গিয়ে হুরপরি,
আমার স্বর্গ এই মদিরা, হাতের কাছের সুন্দরী।
নগদা যা পাস তাই ধরে থাক, ধারের পণ্য করিসনে,
দূরের বাদ্য মধুর শোনায় শূন্য হাওয়ায় সঞ্চরি।
১০৭
এই যে আঁধার প্রহেলিকা পারবিনে তুই পড়তে মন!
তুই কি সফল হবি যথায় হার মেনেছে বিজ্ঞজন?
শরাব এবং পেয়ালা নিয়ে খুশির স্বর্গ রচ হেথাই–
পাবি কি না পাবি বেহেশত, বলতে পারে কেউ কখন?
১০৮
দোহাই! ঘৃণায় ফিরিয়ো না মুখ দেখে শরাব-খোর গোঁয়ার
যদিও সাধু সজ্জনেরই সঙ্গে কাটে কাল তোমার।
শরাব পিয়ো, কারণ শরাব পান কর আর না-ই কর,
ভাগ্যে ধার্য থাকলে নরক যায় না পাওয়া স্বর্গ আর।
১০৯
জীবন যখন কন্ঠাগত – সমান বলখ নিশাপুর,
পেয়ালা যখন পূর্ণ হল – তিক্ত হোক কি হোক মধুর!
ফুর্তি চালাও, নিভে যাবে হাজার তপন লক্ষ চাঁদ,
আমরা ফিরে আসব না আর এই ধরণির পথ সুদূর!
১১০
আয় ব্যয় তোর পরীক্ষা কর ঠিক সে হিসাব করতে পেশ,
আসার বেলায় আনলি কী আর নিয়েই বা কী যাস সে দেশ।
‘আনব নাকো বিপদ ডেকে শরাব পিয়ে’ কস যে তুই,
মদ খাও আর না খাও তবু মরতে তোমায় হবেই শেষ।
রুবাইয়াত্-ই-ওমর খৈয়াম – ১১১-১২০
১১১
হঠাৎ সেদিন দেখলাম, এক কর্মরত কুম্ভকার,
করছে চূর্ণ মাটির ঢেলা, ঘট তৈরির মাল দেদার।
দিব্য দৃষ্টি দিয়ে এসব যেই দেখলাম, কইল মন,
নূতন ঘট এ করছে সৃজন মাটিতে মোর বাপ দাদার।
১১২
একী আজব করছ সৃষ্টি, কুম্ভকার হে, হাত থামাও!
চূর্ণ নরের মাটি নিয়ে করছ কী তা দেখতে পাও?
কায়খসরুর হৃদয় এবং ফরীদুনের অঙ্গুলি
বে-পরোয়া হয়ে তোমার নিঠুর চাকায় মিশিয়ে যাও!
১১৩
চূর্ণ করে তোমায় আমায় গড়বে কুঁজো কুম্ভকার,
ওগো প্রিয়া! পার হবার সে আগেই মৃত্যু-খিড়কি-দ্বার–
পাত্রে ব্যথার শান্তি ঢালো – এই সোরাহির লাল সুরা,
এক পেয়ালা তুমি পিয়ো, আমায় দিয়ো পেয়ালা আর।
১১৪
এই যে রঙিন পেয়ালাগুলি নিজ হাতে যে গড়ল সে
ফেলবে ভেঙে খেয়াল-খুশির লীলায় এদের বিন-দোষে?
এতগুলি সুষ্ঠু শোভন চটুল আঁখি চন্দ্রমুখ
প্রীতির ভরে সৃষ্টি করে করবে ধ্বংস ক্রোধবশে?
১১৫
পিয়ালাগুলি তুলে ধরো চৈত্রী লালা ফুলের প্রায়
ফুরসুত তোর থাকলে, নিয়ে বস লালা-রুখদিল প্রিয়ায়।
মউজ করে শরাব পিয়ো, গ্রহের ফেরে হয়তো ভাই
উলটে দেবে পেয়ালা সুখের হঠাৎ-আসা ঝঞ্ঝাবায়।
১১৬
মসজিদ আর নামাজ রোজার থামাও থামাও গুণ গাওয়া,
যাও, গিয়ে খুব শরাব পিয়ো, যেমন করেই যাক পাওয়া!
খৈয়াম, তুই পান করে যা, তোর ধূলিতে কোন একদিন
তৈরি হবে পিয়ালা, কুঁজো, গাগরি, গেলাস মদ-খাওয়া।
১১৭
মৃত্যু যেদিন নিঠুর পায়ে দলবে আমার এই পরান,
আয়ুর পালক ছিন্ন করি করবে হৃদয়-রক্ত পান,
আমায় মাটির ছাঁচে ঢেলে পেয়ালা করে ঢালবে মদ,
হয়তো গন্ধে সেই শরাবের আবার হব আয়ুষ্মান!
১১৮
রে নির্বোধ! এ ছাঁচে-ঢালা মাটির ধরা শূন্য সব,
রং-বেরং-এর খিলান-করা এই যে আকাশ – অবাস্তব।
এই যে মোদের আসা-যাওয়া জীবন-মৃত্যু-পথ দিয়ে,
একটি নিশাস ইহার আয়ু, আকাশ-কুসুমের এ টব।
১১৯
তিরস্কার আর করবে কত জ্ঞান-দাম্ভিক অর্বাচীন?
লম্পট নই, পান যদিও করি শরাব রাত্রিদিন!
তোমার কাছে তসবি দাড়ি, তাপস সাজার নানান মাল,
আমার পুঁজি দিল্-প্রিয়া আর লাল পেয়ালি মদ-রঙিন!
১২০
মসজিদের ওই পথে ছুটি প্রায়ই আমি ব্যাকুল প্রাণ,
নামাজ পড়তে নয় তা বলে, খোদার কসম! সত্যি মান
নামাজ পড়ার ভান করে যাই করতে চুরি জায়নামাজ ,
যেই ছিঁড়ে যায় সেখানা, যাই করতে চুরি আরেকখান।