রুবাইয়াত্-ই-ওমর খৈয়াম – ০৩১-০৪০
৩১
বলতে পার, অসার-শূন্য ভবের হাটের এই ঘরে
জ্ঞান-বিলাসী সুধীজনের হৃদয় কেন রয় পড়ে?
যেই তাহারা শ্রান্ত হয়ে এই সে ঘরের শান্তি চায়,
‘সময় হল, চল ওরে’, কয় অমনি মরণ হাত ধরে!
৩২
খাজা! তোমার দরবারে মোর একটি শুধু আর্জি এই–
থামাও উপদেশের ঘটা, মুক্তি আমার এই পথেই।
দৃষ্টি-দোষে দেখছ বাঁকা আমার সোজা সরল পথ,
আমায় ছেড়ে ভালো করো ঝাপসা তোমার চক্ষুকেই।
৩৩
কাল কী হবে কেউ জানে না, দেখছ তো হায়, বন্ধু মোর!
নগদ মধু লুঠ করে লও, মোছো মোছো অশ্রু-লোর।
চাঁদনি-তরল শরাব পিয়ো, হায়, সুন্দর এই সে চাঁদ
দীপ জ্বালিয়ে খুঁজবে বৃথাই কাল এ শূন্য ধরার ক্রোড়।
৩৪
প্রেমিকরা সব আমার মতো মাতুক প্রেমের মত্ততায়,
দ্রাক্ষা-রসের দীক্ষা নিয়ে আচার-নীতি দলুক পায়।
থাকি যখন সাদা চোখে, সব কথাতে রুষ্ট হই,
শরাব পিয়ে দিল-দরিয়া উড়িয়ে দি ভয়-ভাবনায়।
৩৫
মানব দেহ – রঙে-রূপে এই অপরূপ ঘরখানি–
স্বর্গের সে শিল্পী কেন করল সৃজন কী জানি,
এই ‘লাল-রুখ’ বল্লি-তনু ফুল-কপোল তন্বীদের
সাজাতে হায় ভঙ্গুর এই মাটির ধরার ফুলদানি!
৩৬
তিন ভাগ জল এক ভাগ থল এই পৃথিবীর এও মায়া,
এই ধরাতে দেখছ যা তার সকল-কিছু সব মায়া,
এই যে তুমি বলছ যা সব, শুনছ কলরব – মায়া।
গোপন প্রকাশ সত্য মিথ্যা এ সব অবাস্তব মায়া।
৩৭
দোষ দেয় আর ভর্ৎসে সবাই আমার পাপের নাম নিয়া,
আমার দেবী-প্রতিমারে পূজি তবু প্রাণ দিয়া।
মরতে যদি হয় গো আমায় শরাব-পানের মজলিশে–
স্বর্গ-নরক সমান, পাশে থাকবে শরাব আর প্রিয়া।
৩৮
মুসাফিরের এক রাত্রির পান্থ-বাস এ পৃথ্বীতল–
রাত্রি-দিবার চিত্র-লেখা চন্দ্রাতপ আঁধার-উজল।
বসল হাজার জামশেদ ওই উৎসবেরই আঙিনায়
লাখ বাহ্রাম এই আসনে বসে হল বেদখল।
৩৯
কারুর প্রাণে দুখ দিয়ো না, করো বরং হাজার পাপ,
পরের মনে শান্তি নাশি বাড়িয়ো না তার মনস্তাপ।
অমর-আশিস লাভের আশা রয় যদি, হে বন্ধু মোর,
আপনি সয়ে ব্যথা, মুছো পরের বুকের ব্যথার ছাপ।
৪০
ছেড়ে দে তুই নীরস বাজে দর্শন আর শাস্ত্রপাঠ,
তার চেয়ে তুই দর্শন কর প্রিয়ার বিনোদ বেণির ঠাট;
ওই সোরাহির হৃদয়-রুধির নিষ্কাশিয়া পাত্রে ঢাল,
কে জানে তোর রুধির পিয়ে কখন মৃত্যু হয় লোপাট।
রুবাইয়াত্-ই-ওমর খৈয়াম – ০৪১-০৫০
অজ্ঞানেরই তিমির-তলের মানুষ ওরে বে খবর!
শূন্য তোরা, বুনিয়াদ তোর গাঁথা শূন্য হাওয়ার পর।
ঘুরিস অতল অগাধ খাদে, শূন্য মায়ার শূন্যতায়,
পশ্চাতে তোর অতল শূন্য, অগ্রে শূন্য অসীম চর।
৪২
লয়ে শরাব-পাত্র হাতে পিই যবে তা মস্ত হয়ে
জ্ঞানহারা হই সেই পুলকের তীব্র-ঘোর বেদন সয়ে,
কী যেন এক মন্ত্রবলে যায় ঘটে কী অলৌকিক,
প্রোজ্জ্বল মোর জ্ঞান গলে, যায় ঝরনাসম গান বয়ে।
৪৩
‘শরাব ভীষণ খারাপ জিনিস মদ্যপায়ীর নেইকো ত্রাণ।’
ডাইনে বাঁয়ে দোষদর্শী সমালোচক ভয় দেখান –
সত্য কথাই! যে আঙুরে নষ্ট করে ধর্মমত,
সবার উচিত – নিঙড়ে ওরে করে উহার রক্ত পান!
৪৪
আমার কাছে শোন উপদেশ – কাউকে কভু বলিসনে–
মিথ্যা ধরায় কাউকে প্রাণের বন্ধু মেনে চলিসনে!
দুঃখ ব্যথায় টলিসনে তুই, খুঁজিসনে তার প্রতিষেধ,
চাসনে ব্যথার সমব্যথী, শির উঁচু রাখ ঢলিসনে!
৪৫
মউজ চলুক! লেখার যা তা লিখল ভাগ্য কালকে তোর,
ভুলেও কেহ পুঁছল নাকি থাকতে পারে তোর ওজর !
ভদ্রতারও অনুমতি কেউ নিল না অমনি ব্যস
ঠিক ঠাক সব হয়ে গেল ভুগবি কেমন জীবন-ভোর!
৪৬
আমি চাহি স্রষ্টা আবার সৃজন করুন শ্রেষ্ঠতর
আমি চাহি স্রষ্টা আবার সৃজন করুন শ্রেষ্ঠতর
সেই সাথে চাই – সৃষ্টি-খাতায় দিক কেটে সে আমার নাম,
কিংবা আমার যা প্রয়োজন তা মিটাবার দিক সে বর।
৪৭
নাস্তিক আর কাফের বলো তোমরা লয়ে আমার নাম,
কুৎসা গ্লানির পঙ্কিল স্রোত বহাও হেথা অবিশ্রাম।
অস্বীকার তা করব না যা ভুল করে যাই, কিন্তু ভাই,
কুৎসিত এই গালি দিয়েই তোমরা যাবে স্বর্গধাম?
৪৮
বদখশানী রক্ত-চুনির মতন সুরা চুঁইয়ে আন
তপ্তহিয়ার আনন্দ যা, শান্ত যাহে দগ্ধ প্রাণ।
মুসলমানের তরে শরাব হারাম নাকি, সবাই কয়,
বলতে পারে তাদের কেহ – আছে কি আর মুসলমান?
৪৯
মসজিদ মন্দির গির্জায় ইহুদ-খানায় মাদ্রাসায়
রাত্রি-দিবস নরক-ভীতি স্বর্গ সুখের লোভ দেখায়।
ভেদ জানে আর খোঁজ রাখে ভাই খোদার যারা রহস্যের
ভোলে না এই খোশ-গল্পের ঘুম-পাড়ানো কল্পনায়।
৫০
এক হাতে মোর তসবি খোদার, আর-হাতে মোর লাল গেলাস,
অর্ধেক মোর পুণ্য-স্নাত, আধেক পাপে করল গ্রাস।
পুরোপুরি কাফের নহি, নহি খাঁটি মুসলমানও–
করুণ চোখে হেরে আমায় তাই ফিরোজা নীল আকাশ।
রুবাইয়াত্-ই-ওমর খৈয়াম – ০৫১-০৬০
৫১
একমনি ওই মদের জালা গিলব, যদি পাই তাকে,
যে জালাতে প্রাণের জ্বালা নেভাবার ওষুধ থাকে!
পুরানো ওই যুক্তি তর্কে দিয়ে আমি তিন তালাক,
নতুন করে করব নিকাহ্ আঙুর-লতার কন্যাকে।
৫২
বিষাদের ওই সওদা নিয়ে বেড়িয়ো না ভাই শিরোপরি,
আঙুর-কন্যা সুরার সাথে প্রেম করে যাও প্রাণ ভরি!
নিষিদ্ধা ওই কন্যা, তবু হোক সে যতই অ-সতী,
তাহার সতী মায়ের চেয়ে ঢের বেশি সে সুন্দরী!
৫৩
স্বর্গে পাব শরাব-সুধা, এ যে কড়ার খোদ খোদার,
ধরায় তাহা পান করলে পাপ হয়, এ কোন বিচার?
‘হামজা’ সাথে বেয়াদবি করল মাতাল এক আরব–
তুচ্ছ কারণ – শরাব হারাম তাই হুকুমে ‘মোস্তফার’।
৫৪
‘রজব শাবান পবিত্র মাস’ বলে গোঁড়া মুসলমান,
‘সাবধান, এই দু-মাস ভাই কেউ করো না শারাব পান।’
খোদা এবং তার রসুলের ‘রজব’ ‘শাবান’ এই দু-মাস
পান-পিয়াসীর তরে তবে সৃষ্ট বুঝি এ ‘রমজান’?
৫৫
শুক্রবার আজ, বলে সবাই পবিত্র নাম জুম্মা যার,
হাত যেন ভাই খালি না যায়, শরাব চলুক আজ দেদার।
এক পেয়ালি শরাব যদি পান করো ভাই অন্যদিন,
দু-পেয়ালি পান করো আজ বারের বাদশা জুম্মা বার!
৫৬
মসজিদের অযোগ্য আমি, গির্জার আমি শত্রু-প্রায়,
ওগো প্রভু, কোন মাটিতে করলে সৃজন এই আমায়?
সংশয়াত্মা সাধু কিংবা ঘৃণ্য নগর-নারীর তুল
নাই স্বর্গের আশা আমার, শান্তি নাহি এই ধরায়।
৫৭
মুগ্ধ করো নিখিল-হৃদয় প্রেম-নিবেদন কৌশলে
হৃদয়জয়ী হে বীর, উড়াও নিশান প্রিয়ার অঞ্চলে।
এক হৃদয়ের সমান নহে লক্ষ ম-জিদ আর ‘কাবা’;
কী হবে তোর তীর্থে ‘কাবা’র শান্তি খোঁজ হৃদয় তলে।
৫৮
বিধর্মীদের ধর্মপথে আসতে লাগে এক নিমেষ,
সন্দেহেরই বিপথ-ফেরত বিবেক জাগে এক নিমেষ।
দুর্লভ এই নিমেষটুকু ভোগ করে নাও প্রাণ ভরে,
এই ক্ষণিকের আয়েস দিয়ে জীবন ভাসে এক নিমেষ।
৫৯
হৃদয় যাদের অমর প্রেমের জ্যোতির্ধারায় দীপ্তিমান,
মসজিদ মন্দির গির্জা, যথাই করুক অর্ঘ্য দান–
প্রেমের খাতায় থাকে লেখা অমর হয়ে তাদের নাম,
স্বর্গের লোভ ও নরক-ভীতির ঊর্ধ্বে তারা মুক্ত-প্রাণ।
৬০
মদ পিয়ো আর ফুর্তি করো – আমার সত্য আইন এই!
পাপ পুণ্যের খোঁজ রাখি না – স্বতন্ত্র মোর ধর্ম সেই।
ভাগ্য সাথে বিয়ের দিনে কইনু, ‘দিবি কি যৌতুক?’
কইল বধূ, ‘খুশি থাকো, তার বড়ো যৌতুক সে নেই!’