রেস্তোরাঁ থেকে বাইরে বেরিয়ে হুইটিংটন সঙ্গীকে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে ওয়াটার্ল স্টেশনে এল। হুইটিংটন প্ল্যাটফর্মে নেমে বোর্নমাউথের একটা প্রথম শ্রেণীর টিকিট কাটল। পেছনে পেছনে টমিও তাই করল।
বোরিস বলল, ট্রেনের এখনো আধঘণ্টা দেরি। আগেই এসে পড়েছ।
টমি বুঝতে পারল, হুইটিংটন একাই যাচ্ছে। বোরিস লন্ডনেই থাকছে।
ওরা প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করছে। এই ফাঁকে পাশের একটা টেলিফোন বুথে ঢুকল টমি।
-হ্যাঁ হার্সিমার, এখুনি ওয়াটালুতে চলে এসো। হুইটিংটন আর একজনকে অনুসরণ করছি। গাড়ি ছাড়ার দুমিনিট আগেই হার্সিমার টমির সঙ্গে মিলিত হল। টিকিট কাটার পর পকেটে আর টাকা ছিল না। টমি কিছু টাকা চেয়ে নিল। টিকিটটা হার্সিমারকে দিল, হুইটিংটনকে দেখিয়ে দিল।
এবারে উঠে পড়। ওকে অনুসরণ কর। ট্রে
ন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে গেল। টমি দেখতে পেল বোরিস এগিয়ে যাচ্ছে। সে পেছু নিল।
ওয়াটার্লু ছেড়ে পিকাডেলি হয়ে শ্যাপটবেরী অ্যাভেনিউ ছাড়িয়ে সোহোর দিকের একটা কানা গলির ভেতরে ঢুকে পড়ল বোরিস। টমি পেছনে লেগে আছে।
শেষ পর্যন্ত ধুলো ময়লায় নোংরা, একটা নির্জন জায়গায় চলে এলো টমি। আশপাশে পুরনো ভাঙাচোরা বাড়ি। এমনি একটা বিপজ্জনক বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠল বোরিস। দরজায় অদ্ভুত শব্দ করল। একজন দরজাটা খুলল। দুজনে দুচারটে কথা বলল, ভেতরে ঢুকে সে দরজা বন্ধ করে দিল।
বোরিসের বেরিয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করল না টমি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সিঁড়ি বেয়ে উঠে দরজায় বোরিসের মতোই শব্দ করল।
দরজাটা খুলল একটা লোক। তার কোঁকড়া চুল, শয়তানের মতো মুখ।
–কাকে চাই?
–মিঃ ব্রাউন। কিছু না ভেবেই বলে ফেলল টমি।
–ওপরে, বাঁদিকে দ্বিতীয় দরজা।
লোকটা দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল।
.
বাড়িটা যত জীর্ণ, ততোধিক সিঁড়িটা। চারপাশে আবর্জনা। সতর্ক পায়ে এগিয়ে চলল টমি। সিঁড়ির বাঁক ঘোরার মুখে দেখতে পেল নিচের লোকটা পেছনের একটা ঘরে ঢুকে গেল। সে নিঃসন্দেহ হলো–এখনো কেউ সন্দেহ করেনি। মিঃ ব্রাউনের নামটাই এবাড়িতে রক্ষাকবচ।
সিঁড়ির শেষে বারান্দা। দু পাশে ঘর। একটা ঘর থেকে কথাবার্তার শব্দ আসছে। এটাই বাঁদিকের দ্বিতীয় ঘর।
কোনো সংকেত জানা নেই তাই ওই ঘরে ঢোকার সাহস করল না টমি। নিচের লোকটা দলের সবাইকে চেনে না বলেই কিছু সন্দেহ করেনি। টমি উল্টোদিকের ছেঁড়া ভেলভেটের আড়ালে আত্মগোপন করল।
নিচের দরজায় শব্দ হল হঠাৎ। পর্দার ফাঁকে চোখ রাখল টমি। একটা অপরাধী চেহারার লোক উঠে আসছে।
উল্টো দিকের দরজায় সাংকেতিক শব্দ করল লোকটা। ভেতর থেকে কিছু বলল। সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।
চকিতে চোখে পড়ল–বিরাট টেবিল ঘিরে চার পাঁচজন বসে আছে। একেবারে সামনে বসেছিল নাবিকের মতো ছুঁচলো দাড়িওয়ালা একজন লোক। জার্মান বলেই মনে হল। সে জিজ্ঞেস করল, আপনার নম্বর, কমরেড?
-চোদ্দ, স্যার।
–ঠিক আছে।
দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আরও কেউ আসতে পারে অনুমান করে জায়গা ছেড়ে নড়ল না। টমি।
কয়েক মিনিট পরেই আবার নিচের দরজায় শব্দ। যে লোকটি ওপরে উঠে এলো, সে আয়াল্যান্ডের সিনফিন। একই ভাবে দরজায় টোকা দিয়ে নম্বর বলে ভেতরে ঢুকে গেল।
এর পরও পর পর দুজন ঢুকল। একজনের চেহারা কেরানীর মত, দ্বিতীয় জন স্রেফ শ্রমিক।
সবশেষে যে এলো তার চেহারা ও পোশাকে কর্তৃত্বব্যঞ্জক ভাব। উঁচু চোয়াল দেখেই বোঝা গেল নোকটা শ্লাভ।
দরজায় টোকা দিল, কিন্তু অভ্যর্থনা পেল অন্যরকম। টমি অবাক হল। দাড়িওয়ালা জার্মান লোকটা সহ সকলেই উঠে দাঁড়াল।
দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। ভেতর থেকে টুকরো কথা ভেসে আসছে। সন্তর্পণে এগিয়ে দরজায় কান পাতল। কিন্তু কিছু বোধগম্য হল না।
টমি হাল ছাড়ল না। সামনে টানা দরজা। কয়েক পা এগিয়ে দ্বিতীয় দরজায় কান পাতল, হাতল ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকল। দরজা বন্ধ করল।
একটা ধুলো মলিন ঘর। ভাঙ্গা আসবাব। দু ঘরের মাঝে দরজা। আস্তে আস্তে খিল খুলল, পাল্লা ফাঁক করল।
সামনেই মখমলের পর্দা ঝোলোনো–তাকে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। টমি কান পেতে নিশ্চিন্তে কথা শুনতে লাগল।
কর্মসমিতির দলীয় সভা। খনি শ্রমিকদের সিদ্ধান্তের ওর আলোচনা। নেতাদের সিদ্ধান্ত ২৯ তারিখ রেলপথ অবরোধ…হাঙ্গামা সামলাবার গোলাবারুদ প্রস্তুত…এরপর ধর্মঘট…সবার শেষে এলো দলিলের প্রসঙ্গ…একজন মেয়ে উধাও…
কিন্তু এরপর আর কিছুই শুনতে পেল না টমি। মাথার পেছনে প্রচণ্ড আঘাত…চোখে অন্ধকার দেখল টমি।
.
০৩.
টুপেনস সহজ বুদ্ধিতেই বুঝতে পারল, লোক দুজন তিনতলার ফ্ল্যাট থেকেই এসেছে। আর ওই রিটা নামটাই বলে দিচ্ছে জেন ফিনকে কারা অপহরণ করেছে।
টমি বেরিয়ে যেতেই কর্তব্য স্থির করে নিল টুপেনস। হলের দিকে এগিয়ে লিফট বয়ের সঙ্গে কথা বলল।
ছোট ছেলেদের সহজেই আপন করে নিতে পারে টুপেনস। সে ছেলেটির নাম জেনে নিল। অ্যালবার্ট। তার গোয়েন্দা উপন্যাসের দিকে ঝোঁক বোঝা গেল পকেটে পেনি সিরিজের একটা বই দেখে।
নিজেকে আমেরিকান গোয়েন্দা দপ্তরের সদস্য পরিচয় দিয়ে অ্যালবার্টের সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিতে বেশি দেরি হল না। তাদের কথোপকথন ছিল এরকম–
–আপনি কি কোনো খুনীকে খুঁজছেন?
–হ্যাঁ, ২০ নম্বর ফ্ল্যাট–তার নাম ভ্যান্ডেমেয়ার। আমেরিকায় নাম রেডি রিটা। ডাকাতি।