বোট থেকে নেমে হোলিহেডে গাড়িতে উঠলাম। মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারকেও আমার কামরায় দেখতে পেলাম। কামরায় আরও লোক ছিল, তাই ভয় পাওয়ার কিছু ছিল না। আমার উল্টো দিকেই বসেছিলেন, মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী।
ট্রেনের ঝাঁকুনিতে সম্ভবতঃ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ভাঙ্গতেই চোখ খুলে দেখতে পেলাম–সেই ভদ্রলোক মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের হাতে কিছু কাগজ তুলে দিচ্ছেন। দুজনের মুখেই কেমন অদ্ভুত হাসি।
আমি খুবই ভয় পেয়ে যাই। উঠবার উদ্যোগ করতেই মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার আচমকা আমার নাকে মুখে কি চেপে ধরলেন। আমি হাত ছাড়াতে চেষ্টা করি, আর আমার মাথায় প্রচণ্ড একটা আঘাত লাগল।
যখন জ্ঞান ফিরল, দেখি, একটা নোংরা বিছানায় শুয়ে আছি। চারদিকে পর্দা। মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের গলা পেলাম। কারো সঙ্গে কথা বলছেন।
কান পেতে শুনে বুঝতে পারলাম, তারা তেলাকাগজের প্যাকেটে কিছু পায়নি বলে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। আমার ওপর অত্যাচার করে আসল কাগজগুলোর সন্ধান করবে। ভয়ে আঁৎকে উঠলাম।
ওরা দুজন আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আমি চোখবুজে অচেতন হবার ভান করে রইলাম, আর ভাবতে লাগলাম, কি করে এদের উৎপীড়ন এড়ানো যায়।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল, স্মৃতি লোপের কথা বইতে পড়েছিলাম, আমিও সেই অভিনয় করতে পারি। তখনই ফরাসিতে কথা বলতে শুরু করলাম।
মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার কেমন হকচকিয়ে গেলেন। তার সঙ্গের লোকটি এগিয়ে এসে আমার হাত মুচড়ে ধরল। আমি ফরাসিতেই চেঁচাতে লাগলাম।
যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ধীরে ধীরে জ্ঞান হারালাম। ওদের শেষ কথাটা কেবল মনে আছে, না, এটা ধাপ্পা হতে পারে না।
ওরা আমাকে সোহোর সেই বাড়িতেই নিয়ে গিয়েছিল। ওখানেই মিঃ বেরেসফোর্ডকে আটকে রাখা হয়েছিল। জ্ঞান ফিরলে চোখে পড়ল, চেয়ারে আমার কোটটা রয়েছে, আর পকেটে সেই পত্রিকাটাও।
অবহেলায় ওটা ফেলে রাখায় কিছু সন্দেহ করেনি, তাই নিশ্চিন্ত হলাম। বিছানাতেই শুয়েছিলাম। মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার লক্ষ্য রাখছিলেন। আমার সামনে তেলাকাগজটা ধরে জানতে চাইলেন, আমি চিনি কিনা।
হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম, চেনা চেনা মনে হল, কিন্তু মনে করতে পারলাম না।
মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার বললেন, তীব্র মানসিক আঘাতে সাময়িক স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে, শিগগিরই স্মৃতি ফিরে আসবে। আমাকে বললেন, তাকে রিটা পিসী বলে ডাকতে।
সে রাতটা যে কিভাবে কেটেছে, বলে বোঝাতে পারব না। কেবলই ভয় হচ্ছিল, যদি সাময়িকপত্রটা ফেলে দেয় তাহলেই তো সর্বনাশ। মাথা দপদপ করছিল।
রাত দুটোয়, নিঃশব্দে উঠে দেয়াল থেকে একটা ছবি নামালাম। সেটা ছিল গয়নাপরা মার্গারেটের ছবি।
ছবির পেছনের বাদামি কাগজটা খুলে পত্রিকা থেকে কাগজদুটো বের করে ছবির পেছনে রেখে দিলাম। বাদামীকাগজটা এঁটে ছবিটা আবার টাঙিয়ে রাখলাম।
এতক্ষণে একটু স্বস্তি পেলাম। ভাবলাম, ওরা নিশ্চয় ভাববে, ডেনভারস সাদা কাগজই নিয়ে আসছিল।
ওরা আমাকে হয়ত মেরেই ফেলতো। কিন্তু দলের একনম্বরের জন্যই পারেনি। আমাকে আয়ার্ল্যান্ডে নিয়ে এলো। সকলে জানল, আমি মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের ভাইঝি। কিন্তু বুঝতে পারতাম অনেকেই আমাকে দেখে এসব বিশ্বাস করতে চাইত না।
এরপর বোর্নমাউথে এক স্যানাটরিয়ামে আমাকে পাঠানো হল। যে নার্স আমার দেখাশোনা করত সে-ও ছিল ওই দলের লোক। সে গোপনে ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলত।
আমি যে জেন ফিন একথাটা ভুলে থাকবার চেষ্টা করতাম প্রাণপণে। জেনেট ভ্যান্ডেমেয়ার হয়েই অভিনয় করে চললাম।
এখানে ডাক্তার আর মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন একাধিকবার। কিন্তু আমি ভেঙ্গে পড়িনি।
সেই স্যানাটরিয়াম থেকে এক রাতের মধ্যে আমাকে সোহোর বাড়িতে নিয়ে আসা হল। ওরা আমাকে এবারে অদ্ভুত একটা কাজে লাগিয়ে দিল। মিঃ বেরেসফোর্ডের দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ল আমার ওপরে।
রবিবার বিকেলে ওদের ফিসফাস কথাবার্তা কানে এলো। বুঝতে পারলাম, মিঃ বেরেসফোর্ডকে মেরে ফেলার হুকুম এসেছে। এর পরের ঘটনা তো আপনারা জানেন।
আমি ফটোর পেছনে লুকিয়ে রাখা কাগজটা উদ্ধার করতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ধরা পড়ে যাই। তখনই চিৎকার করে বলি আমি মার্গারেটের কাছে যাব। যাতে ওরা বোঝে আমি মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের কথা বলছি।
জেন তার কাহিনী শেষ করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।
কাগজগুলো তাহলে সেই ছবির পেছনেই রয়ে গেছে? স্যার জেমস বললেন।
–হ্যাঁ।
স্যার জেমস তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, এখুনি যাওয়া যাক তাহলে চল।
–এই রাতে? অবাক হয়ে বলল টুপেনস।
-হ্যাঁ। দেরি করা ঠিক হবে না। তাছাড়া রাতে গেলে নাটের গুরু মিঃ ব্রাউনকেও হাতে নাতে ধরা যেতে পারে। তোমাদের কোনো ভয় নেই, পথে কোনো বিপদ হবার সম্ভাবনা নেই। মিঃ ব্রাউনের মতলব হল, জেনকে আমরা আসল জায়গায় নিয়ে যাবো। সে জন্য সে ওঁৎ পেতে থাকবে। সোহোর বাড়ি পুলিসের নজরে রয়েছে। তৎসত্ত্বেও মিঃ ব্রাউন সেখানে ঢোকার চেষ্টা করবেন–হয়তো বন্ধুর ছদ্মবেশ নিয়েই।
টুপেনস ইতস্তঃ করে বলল, আপনি জানেন, মিঃ ব্রাউন কে?
আমি জানি। মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের রহস্যময় মৃত্যুর রাত থেকেই আমি জেনেছি।
-আশ্চর্য!
-হ্যাঁ, তার মৃত্যুর দুটো কারণ আমি যুক্তিসঙ্গত মনে করছি। হয় তিনি নিজে ক্লোরাল খেয়েছিলেন অথবা