পলকের মধ্যে লাফিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ত্রস্ত হাতে দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিল টমি। কনরাড দরজায় আঘাত করে চিৎকার করতে লাগল।
নিচে থেকে জার্মান লোকটার চিৎকার শোনা গেল–কি ব্যাপার কনরাড
দোতলায় অন্ধকারে টমিকে কে পাশে টানল–অ্যানেট…পাশের সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা চিলেকোঠায় ঠেলে দিল।
-চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকুন।
নিচে বন্ধ দরজায় দমাদম শব্দ হচ্ছে। জার্মান নোকটা চেঁচাচ্ছে। দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা চলছে।
অ্যানেট একটা জগের হাতলে একটুকরো দড়ি বাঁধল। টমিকে বলল, দরজার চাবিটা আমাকে দিন। দরজা বন্ধ, ভাঙ্গতে দেরি হবে। আমি নিচে যাচ্ছি–এই সুতোটা ধরে থাকুন…আমি দরজা খুলছি। ওরা বেরলেই দড়িটা ধরে টান মারবেন।
টমি কিছু বলার সুযোগ পেল না। অ্যানেট নিচে নেমে গেল। একটু পরেই সশব্দে দরজা খোলার শব্দ। কনরাডের চিৎকার–সে কোথায়?
-কেউ তো যায়নি, জার্মান লোকটা বলল।
–সে পালিয়েছে–
ঠিক এই সময় টমি দড়ি ধরে টানল। সঙ্গে সঙ্গে কাচের বাসন ভাঙ্গার শব্দ হল। লোক তিনটে দৈত্যের মত শব্দ তুলে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠল।
টমি বেরিয়ে এসে নিচে ছুটল। অ্যানেটকে দেখতে পেল। কিন্তু পলকের মধ্যে সে অদৃশ্য হয়ে গেল।
–লোকটা পালিয়েছে…কি করে হল?
জার্মান লোকটার গলা। অ্যানেটেরও গলা পাওয়া গেল–এ বাড়িতে আর নয়–আমি মার্গারেটের কাছেই চলে যাব
অ্যানেট আবার ফিরে গেছে। তার সঙ্গে যাবার ইচ্ছে নেই, টমি বুঝতে পারল…ওরা সিঁড়ি ভেঙ্গে নেমে আসছে…হলঘর পার হয়ে সে দৌড়ে রাস্তায় নেমে এল…
সকাল সাড়ে পাঁচটা। রেস্তোরাঁয় ঢুকে টমি প্রাতঃরাশ সারতে সারতে কাগজটা দেখল। প্রথম পাতাতেই ছবি দিয়ে ক্রেমেলিন সম্পর্কে প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। এই লোকটাই রুশ বিপ্লবের নায়ক, বলা হয়েছে। কদিন আগেই সে লন্ডনে এসেছে।
টমি মনে মনে বলল, এই লোকই তো সবার শেষে ঘরে ঢোকে, অন্য রকম অভ্যর্থনা পায়। তাহলে তুমিই একনম্বর।
বিল মিটিয়ে হোয়াইট হ্রলে এসে চিরকুট পাঠিয়ে মিঃ কার্টারের সঙ্গে দেখা করল সে। সব কথা খুলে বলল।
মিঃ কার্টার, টেলিফোনে কিছু জরুরী নির্দেশ দিলেন। টমিকে বললেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে, ওরা এতক্ষণে সরে পড়েছে নিশ্চয়। কিন্তু এটা গুরুত্বপূর্ণ, তারিখটা ২৯ শে, আর ক্রেমলিন উপস্থিত। সাধারণ ধর্মঘট সামলানো কষ্ট হবে না। কিন্তু চুক্তির খসড়ার ব্যাপার হলে ইংলন্ডকে বাঁচানো যাবে না। চল সোহোর বাড়িটা ঘুরে আসা যাক।
.
পাখি আগেই পালিয়েছিল। বাড়িতে কিছুই পাওয়া গেল না।
–মেয়েটাকে ওদের দলের বলে মনে হল না স্যার।
-ও ইচ্ছে করেই ফিরে যায় বলছ? তোমার মৃত্যু সে দেখতে চায়নি সম্ভবতঃ। কিন্তু কেমন খাপছাড়া লাগছে।
ওখানে আর কিছু করার ছিল না। একটা ট্যাক্সি নিয়ে টমি রিজে রওনা হল। সে ভাবল, টুপেনস হয়তো রিটাকে নিয়েই লেগে রয়েছে। অ্যানেট বোধহয় তাকেই মার্গারেট বলছিল।
.
হোটেলের অফিসে খবর নিয়ে জানা গেল, টুপেনস পনেরো মিনিট আগেই বেরিয়ে গেছে।
রেস্তোরাঁয় এসে খাবার নিয়ে বসল টমি।
–হ্যাল্লো টমি। ওহ, কী ভাবনায় ফেলেছিলে।
পাশে এসে বসল পার্সিভেল-কোথায় ছিলে এতদিন?
টমি তার অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী শোনাল।
–একেবারে যেন সিনেমা।
–টুপেনস নেই দেখলাম। তোমাদের কথা শোনাও। বলল টমি।
–অ্যাডভেঞ্চার আমরাও কম করিনি।
হার্সিমার, মিসেস ভ্যান্ডেমেয়ারের মৃত্যুর ঘটনা পর্যন্ত সমস্ত কথা বলল।
–সব ক্ষেত্রেই দেখছি মিঃ ব্রাউন, অবাক হয়ে বলল টমি, লোকটার ক্ষমতা অবিশ্বাস্য। খানিক পরে ওপরে উঠে এলো টমি। একটা বাচ্চা ছেলে এসে খবর দিল, মিস ট্যাক্সি করে বেরিয়ে গেছে।
এরপর তার কাছ থেকেই সাংঘাতিক খবরটা জানতে পেল টমি। সাড়ে বারোটা নাগাদ একটা টেলিগ্রাম সে এনে দিয়েছিল। সেটা পড়ার পরেই টুপেনস ঝপপট ট্যাক্সি ডাকিয়ে চেয়ারিংক্রশ যাচ্ছে বলে চলে গেছে।
টেলিগ্রামটা টুপেনস সঙ্গে নেয়নি। সেটা পাকিয়ে চুল্লীর মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। টমি আর হার্সিমার সেটা খুঁজে বার করল। টেলিগ্রামটা এরকম :
এখনই এসো। মোটহাউস, এবারি, ইয়র্কশায়ার। টমি।
–সর্বনাশ। এ টেলিগ্রাম আমি পাঠাইনি।
–তুমি পাঠাওনি, হার্সিমার আঁৎকে উঠল, টুপেনসকে ওরা ফাঁদে ফেলেছে নির্ঘাৎ।
ওরা আর সময় নষ্ট করল না। ব্রাডশ দেখে ট্রেনের সময় খুঁজে বার করল।
-এই তো, এবারি, ইয়ার্কশায়ার, বলল টমি, কিন্তু ট্রেন তো চেয়ারিংক্রশ থেকে নয়। ছেলেটা ভুল শুনেছে। বারোটা পঞ্চাশের ট্রেনই টুপেনস ধরেছে। কিংক্রশ বা সেন্ট প্যানক্রাশ থেকে।
–আমরা তিনটা কুড়ির ট্রেনই ধরব। বলল হার্সিমার।
.
জনশূন্য এবারি স্টেশনে নেমে মোটহাউস খুঁজে বার করতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজল ওদের।
শ্যাওলা ধরা পুরনো একটা বাড়ি।
দরজা জানালা বন্ধ।
ঘন্টা বাজিয়ে সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
বাড়িটার চারপাশ ঘুরেও ভেতরে কাউকে দেখা গেল না।
একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করতে সে জানাল, মোটহাউস, বহুবছর খালি পড়ে আছে।
বাধ্য হয়ে ইয়র্কশায়ার আর্মস বলে কাছাকাছি একটা জায়গায় ছোট্ট সরাইতে রাতটা কাটাল তারা।
পরদিন সকাল থেকেই তারা এসে খোঁজাখুঁজি শুরু করল। বাড়ির ভেতরে ধুলোর আস্তরণের ওপরে টুপেনসের একটা সোনার ব্রোচ খুঁজে পাওয়া গেল। ওরা নিশ্চিত হল, টুপেনস এখানে এসেছিল। তাকে কেউ জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে।