পানির ওপর দিয়ে তাকাল রবিন। সকালের সূর্য চোখে লাগছে। কপালে হাত রেখে আড়াল করল। ‘ওই যে, যাচ্ছে!’
সরু একটা খাঁড়ির দিকে এগোচ্ছে এয়ারবোট। কয়েকটা গাছের আড়ালে হারিয়ে গেল।
‘খুব তাড়া মনে হচ্ছে ওদের,’ কিশোর বলল।
‘এই যে, নিয়ে এসেছি!’
রাস্টির ডাক শুনে ফিরে তাকাল ছেলেরা। দুটো ঘোড়া আর একটা খচ্চর নিয়ে এগোতে দেখল রাস্টি ও ডিনকে।
‘এতদূর থেকে এত পথ পাড়ি দিয়ে যখন এসেই পড়লে, ‘ নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল রাস্টি, ‘আসল কাউবয় হওয়ার স্বাদটা নিয়েই যাও। উইকএন্ডের জন্যে ডিন তোমাদেরকে এগুলো ধার দিয়েছে।’
ধূসর ঘোড়াটা ইঙ্গিতে দেখালেন ডিন। ‘ওর নাম গ্রে স্টোন। দ্বিতীয় ঘোড়াটা সাদা রঙের একটা পিন্টো, গায়ে ছোট ছোট বাদামী দাগ। ‘আর ও সোয়াম্প রাইডার।’
বিকট স্বরে হাঁক ছাড়ল খচ্চরটা। ‘আরে আস্তে, আস্তে।’ বুড়ো খচ্চরটার গলায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন ডিন। ‘এর নাম বুড়ো জন। রোডেওতে অংশ নিতে আসা লোকেরা আমার আস্তাবল খালি করে সব নিয়ে গেছে, রেখে গেছে একমাত্র এই বুড়োগুলোকেই।’
‘এতেই চলবে, মিস্টার ওয়াটারম্যান,’ রবিন বলল। ‘একটা কিছু তো পেলাম। পায়ে হেঁটে তো আর রোডেওতে যেতে হচ্ছে না।’
‘এরা এখানেই থাক। বিকেল বেলা এসে নিয়ে যেয়ো,’ রাস্টি বলল। ‘এখন চলো, ফিশিং ক্যাম্পে। পেটে খিদে নিয়ে নিশ্চয় অতিথিরা আমাদের পথ চেয়ে বসে আছে।’
দশ মিনিট পর হাইড্রোপ্লেন একটা ছোট দ্বীপের কিনারে নামল। গেইটর সোয়াম্পের পানি এখানে মিলিত হয়েছে ফ্লোরিডা বে’র সঙ্গে। নদীর মোহনার মতই জায়গাটা, জলাভূমির বাড়তি পানি সাগরে পড়ছে।
‘এই দ্বীপের নাম কালাহান’স-কী,’ গর্বের সঙ্গে জানাল রাস্টি ‘আমার দাদার-দাদার নামের সঙ্গে মিলিয়ে একশো বছর আগে রাখা হয়েছিল এই নাম।’
নয়া চাঁদের মত চেহারা দ্বীপটার। বালিতে ভর্তি। পূর্ব তীর ঘেঁষে খুঁটির ওপর বসানো ডজনখানেক কেবিন। ছোট দ্বীপটার নিচু উত্তরাঞ্চল ঘন করাত-ঘাসে ছাওয়া।
ভাসমান ডকের মুরিঙে প্লেন বাঁধতে বাঁধতে রাস্টি বলল, ‘কালাহান’স ফিশিং ক্যাম্পে স্বাগতম। এখানে ফিশিং ক্যাম্প করেছি বলে সবাই আমাকে পাগল ভাবে, কিন্তু আসল সমঝদাররা ঠিকই চিনে নিয়েছে জায়গাটা।’
‘আমার কিন্তু খুব ভাল লাগছে,’ চারপাশে তাকিয়ে বলল রবিন। ‘এত শান্ত। এত চুপচাপ।’
কিন্তু শান্ত পরিবেশ খানখান হয়ে গেল হঠাৎ গর্জে ওঠা শটগানের শব্দে।
‘কে গুলি করল?’ চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে মুসা।
‘নিশ্চয় হ্যারিস, আমার কেয়ারটেকার,’ উদ্বিগ্ন শোনাল রাস্টির কণ্ঠ। ‘ওর একটা শটগান আছে। কিন্তু কীসের ওপর গুলি চালাল তা তো বুঝতে পারছি না!’
‘চলুন, দেখি,’ বলে শব্দটা যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে ছুটতে শুরু করল কিশোর।
করাত-ঘাস গম ক্ষেতের মত ঘন। ঘাসের ডগা কোথাও কোথাও সাত ফুট উঁচু। এর মধ্যে ঢুকে নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলল কিশোর। চারপাশে ঘাস ছাড়া আর কোন কিছুই চোখে পড়ছে না।
‘ওরে বাবারে, খেয়ে ফেললরে!’ চিৎকার শোনা গেল।
ঘাস ঠেলে সেদিকে ছুটল কিশোর। ঘাসের লম্বা পাতার ধারাল কিনারা হাতের চামড়ায় আঁচড় কাটছে। এসে পড়ল দাঁড়টানা ছোট একটা নৌকার কাছে। নৌকায় একজন লোক বসা। গালে ধূসর দাড়ি। হাতের শটগানের নল থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। থরথর করে কাঁপছে লোকটা।
মুসাকে সঙ্গে নিয়ে রাস্টিও এসে দাঁড়াল। ‘কী হয়েছে, হ্যারিস!’
‘অ্যালিগেইটর!’ নৌকার পাটাতনে ফেলে রাখা একটা দাঁড়ের অর্ধেকটা দেখাল ও, বাকি অর্ধেকটা নেই। ‘দেখুন, কীভাবে কেটেছে। ক্ষুরের মত ধারাল দাঁত। আস্ত একটা দানব। পনেরো ফুটের কম না। একটা চোখ সাদা। এ রকম অ্যালিগেইটর জীবনে দেখিনি আমি!’
কিশোর জানে, অ্যালিগেইটর হলো কুমির প্রজাতির এক ভয়ঙ্কর প্রাণী। অনেক সময় মানুষখেকো হয়ে ওঠে।
‘ওই দাঁড় দিয়ে আর নৌকা বাওয়া যাবে না,’ রাস্টি বলল। ‘নৌকাটা টেনে আনতে হবে।’
ঘাসের ওপর দিয়ে নৌকাটাকে ডাঙায় টেনে আনা হলো। ফিরে তাকাল কিশোর। দানবীয় অ্যালিগেইটরটা ওদের পিছু নিল কিনা দেখল। কিন্তু স্থির হয়ে আছে পানি। দূরে একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল হঠাৎ। পাশের একটা দ্বীপে পাশাপাশি দুটো সাইপ্রেস গাছ আছে, অবিকল একই রকম দেখতে। একটা গাছের উঁচু ডালে একজন মানুষ বসা। ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে মনে হলো।
‘মিস্টার কালাহান, ওই দ্বীপে কেউ থাকে?’ কিশোর জিজ্ঞেস করল।
কিশোরের দৃষ্টি অনুসরণ করে ফিরে তাকাল রাস্টি। টুইন সাইপ্রেস-কী’তে? নাহ্, গত একশো বছর ধরে খালি পড়ে আছে। কেন?’
‘কিন্তু একটা লোক…’ থেমে গেল কিশোর। উধাও হয়ে গেছে লোকটা। ‘আশ্চর্য! এক সেকেন্ড আগেও তো ছিল!’
‘নিশ্চয় আজব কিটি’ হ্যারিস বলল।
‘আজব কিটি!’ ভুরু কুঁচকে তাকাল কিশোর।
‘আজব! আজব!’
‘তোমার কাছে আজব! আর তোমার কিছু মাথামোটা বন্ধুর কাছে!’ রেগে উঠল রাস্টি। ছেলেদের দিকে তাকাল। ‘ডিন ওয়াটারম্যানের নাতি কিটি। মিশুক না, এটা ঠিক। তবে আজব বলতে যা বোঝায় তা-ও না। বেশিরভাগ সময় জলাভূমিতে কাটায়, পূর্বপুরুষদের মত। সৌখিন মাছশিকারি আর টুরিস্ট এসে জায়গাটাকে যেভাবে ওলট-পালট করে দিচ্ছে, সেটা ওর পছন্দ না। টুইন সাইপ্রেস-কী’র একটা বিশেষ মর্যাদা আছে ওর কাছে।’