ব্যাক পকেটে হাত দিল কিশোর। পেননাইফটা হাতে লাগতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। রবিনের হাতের দড়ি কাটতে শুরু করল। বেশির ভাগটাই কেটে যাবার পর সামান্য একটু যা লেগে রইল, টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলল রবিন।
ফিরে তাকাল কিশোর। ডেপুটি শেরিফকে প্লেনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বিল। অর্ধেক পথ চলে গেছে। সাঁতরে মুসার কাছে ফিরে এল কিশোর। দড়ি কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করল, ‘কিটি কোথায়?’
চারপাশে তাকাল মুসা। কিটিকে দেখতে পেল না। অথচ খানিক আগেও ছিল। বাঁধন কেটে যেতেই প্লেনের দিকে সাঁতরাতে শুরু করল ও। পিছনে কিশোর। সাঁতরানোর সময় চারপাশে কিটিকে খুঁজছে ওদের চোখ।
কিশোরের কাঁধ চেপে ধরল মুসা। ‘পানিতে তলিয়ে গিয়ে থাকলে আর ভাসতে পারবে না! ডুব দিয়ে দেখব নাকি?’
মুসার হাত ধরে টান দিল কিশোর। ‘পাগল! এই ঢেউয়ের মধ্যে ডুব দিলে আর ভাসতে পারবে?’
মুসাও সেটা জানে। মনে একটা খুঁতখুঁতি নিয়ে প্লেনের দিকে সাঁতরে চলল ও। পৌছে গেছে বিল আর ডেপুটি ক্যানার। পন্টুনে উঠে ক্যানারের বাঁধন খুলে দিয়েছে বিল। দুজনে হাত বাড়িয়ে দিল কিশোরকে উঠতে সাহায্য করার জন্য।
প্লেনের প্যাসেঞ্জার সাইডের পন্টুন থেকে আরেকটা হাত বাড়িয়ে দেয়া হলো মুসাকে তোলার জন্য। হাঁ হয়ে গেল মুসা। ‘কিটি! তুমি কী করে এলে?’
‘সেমিনোল ম্যাজিক,’ হেসে জবাব দিল কিটি। ‘একে আমরা বলি ডলফিন-সাঁতার। অনেকটা বাটারফ্লাই সাঁতারের মত, হাত বাঁধা অবস্থায় সাঁতরানো। ‘
হেসে উঠল মুসা। ওপরে উঠে কিটির কাঁধ চাপড়ে দিল। হঠাৎ বন্দুকের গুলির শব্দ হলো। ওদের কয়েক ফুট পিছনে পানি ছিটাল গুলি।
পঞ্চাশ গজ দূরে এয়ারবোটের গলুইয়ে বসে থাকতে দেখা গেল তাকে। হাতে একটা দোনলা বন্দুক। দ্বিতীয় নল থেকে আবার গুাণ করল ও। বাঁয়ের পন্টুনে এসে লাগল গুলি।
‘ভিতরে ঢোকো!’ চিৎকার করে বলল কিশোর।
হাইড্রোপ্লেনের ছোট্ট ককপিটে গাদাগাদি করে বসল সবাই। সবার শেষে প্লেনে উঠল মুসা। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘এত বোঝা নিয়ে এখন এটা উড়তে পারলে হয়!
‘আরও বিপদ আসছে!’ হাত তুলে দেখাল ক্যানার। উইন্ডশীল্ডের ভিতর দিয়ে তাকিয়ে আছে। ডেনভারের জাহাজ ‘শার্ক’ ছুটে আসছে ওদের দিকে।
‘কী করছে?’ ভয় পেয়ে গেল মুসা।
চোখ বড় বড় হয়ে গেছে রবিনের। ‘প্লেনের গায়ে গুঁতো মারবে!’
এক মুহূর্ত দেরি না করে ইঞ্জিন স্টার্ট দিল কিশোর। থ্রটল খুলে গতি বাড়ানো শুরু করল।
ডানে ঘুরে গিয়ে ওদের পথ আটকানোর চেষ্টা করল শার্ক।
‘কোনভাবেই সময়মত ওড়া সম্ভব না,’ ক্যানার বললেন।
ভারি দম নিল কিশোর। জবাব দিল না। নিজের কাজ করে গেল।
মরিসকে শটগানে আবার গুলি ভরতে দেখল রবিন। নাক বরাবর সামনে চলে গেছে এখন শার্ক। চেঁচিয়ে বলল, ‘কিশোর, জলদি করো!’
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আলতো করে টান দিল কন্ট্রোলে। নাক উঁচু করল প্লেন। শটগানের গুলি ওদের ঠিক নীচ দিয়ে চলে গেল।
জাহাজের দিকে উড়ে যাচ্ছে প্লেন। উঁচু! আরেকটু উঁচু! জাহাজের গায়ে গুঁতো লাগে লাগে অবস্থা। ককপিটে বসা সবাই চেঁচিয়ে উঠল। জাহাজের ডেকের মাত্র কয়েক ফুট ওপর দিয়ে উড়ে গেল প্লেন। শেষ মুহূর্তে জাহাজের ডেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল গুজ বার্নার। নইলে প্লেনের পন্টুনের বাড়ি খেত মাথায়।
‘ইয়াহু!’ রোডেও-চিৎকার দিয়ে উঠল কিটি। ‘মনে হচ্ছে হারিক্যানের পিঠে চড়েছি!’
নীচে তাকিয়ে আছে রবিন। এয়ারবোট থেকে মরিসের বাড়িয়ে দেয়া একটা বস্তা জাহাজে টেনে তুলতে দেখল বার্নার আর ডেনভারকে। ‘মোহরের বস্তা! ওদের এই পালানো দেখতে ভাল লাগছে না আমার!’
‘পালাতে পারবে না,’ কিটি বলল।
ভুরু নাচাল মুসা। ‘ভবিষ্যৎ দেখারও ক্ষমতা আছে নাকি আপনার?’
‘না। ওই দেখো, কোস্ট গার্ডের বোট।’
কোস্ট গার্ডের কাটার জাহাজটাকে কিশোরও দেখল। শক্তিশালী ইঞ্জিনওয়ালা ওই জাহাজের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার সাধ্য নেই ফিশিং বোটের। আনন্দে হই-চই শুরু হলো হাইড্রোপ্লেনের ছোট্ট ককপিটে। এত বোঝা না থাকলে ফিশিং বোটটাকে পাকড়াও করার দৃশ্যটা না দেখে যেত না কিশোর।
ফিশিং ক্যাম্পের আলো দেখা গেল। শক্ত হয়ে বোসো সবাই। আমি এখন ল্যান্ড করব!’
একটু পর পানিতে আঘাত হানল প্লেনের একপাশের একটা পন্টুন। সাগরের ঢেউয়ের খাঁজে নামার চেয়ে জলাভূমির অপেক্ষাকৃত স্থির পানিতে নামাটা কঠিন হলো। প্রচণ্ড ঝাঁকি লাগল। দ্বিতীয় পন্টুনটাও পানি ছুঁলো। আবার প্রচণ্ড ধাক্কা। ডকের দিকে ছুটে যাচ্ছে তীব্র গতিতে। আর রক্ষা নেই। চোখ বুজে ফেলল সবাই। কিন্তু ভাসমান ডকের ওপর উঠে পড়ল পন্টুন দুটো। পিছলে ছুটল।
মনে হলো যেন অনন্তকাল পর অবশেষে থামল প্লেনটা। এক এক করে চোখ মেলল সবাই। ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ। আবার শুরু হলো গুঞ্জন। বেঁচে গেছে এবারকার মত।
কোথায় আছে বুঝতে পেরে হেসে উঠল রবিন। হাসিটা সংক্রমিত হলো মুসার মাঝেও। প্লেনের দুদিকে দুটো খুঁটি। ওদের কেবিনটার ঠিকনীচে এসে থেমেছে প্লেন।
‘একেবারে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে।’ প্লেনের গা চাপড়ে দিয়ে বলল রবিন, ‘সাবাস বেটা!’
‘কিন্তু কেবিনের ভিতর কে আটকা পড়ে আছে শুনলে আনন্দের সীমা থাকবে না তোমাদের,’ হেসে জবাব দিল কিশোর। বিলও ওর হাসিতে যোগ দিল। রবিন, মুসা, কিটি আর ক্যানার এ-ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগল। কিছু না বুঝে বোকার হাসি হাসল।