আর কোন উপায় না দেখে রাস্টিও এসে বসল অ্যালিগেইটরের পিঠে। মেঝেতে চেপে ধরে রাখতে চাইল। কোনভাবে যদি উল্টে যেতে পারে ওটা, পিঠের নীচে ফেলে ভর্তা বানিয়ে ফেলবে দুজনকেই।
‘পালাও!’ বিলের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
মাথা দিয়ে বাড়ি মেরে দরজার পাল্লা লাগিয়ে দিয়েছে অ্যালিগেইটর। ওখান দিয়ে বেরোনোর উপায় নেই। জানালার দিকে ছুটল বিল। মাথা নিচু করে ডাইভ দিল। পর্দা ছিঁড়ে ডিগবাজি খেয়ে গিয়ে পড়ল বাইরের অন্ধকারে।
মারাত্মক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছে অ্যালিগেইটর। দুজন লোক পিঠে চেপে বসে চোয়াল চেপে ধরেও কিছুই করতে পারছে না।
‘আর পারব না!’ হাঁপিয়ে গেছে কিশোর। চেপে ধরে রাখতে রাখতে অবশ হয়ে আসছে হাত।
‘আমিও না!’
লেজ আছড়াচ্ছে অ্যালিগেইটর। যা নাগালে পাচ্ছে তাতেই বাড়ি মারছে। একটা চেয়ার বাঁধল লেজের ডগায়। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
‘আমি এক দুই তিন গোনার সাথে সাথে গিয়ে জানালায় ঝাঁপ দেবেন! ঠিক আছে?’ চেঁচিয়ে বলল কিশোর।
‘আমি না, তুমি!’ গুণতে আরম্ভ করল রাস্টি, ‘এক…দুই…তিন!’
‘দুজনে একসঙ্গে!’ কিশোর বলল।
আচমকা অ্যালিগেইটরের চোয়াল থেকে হাত সরিয়ে আনল দুজনে। জানালার দিকে দৌড় দিল। চোখের পলকে দেহটাকে বাঁকিয়ে কামড় মারল দানবটা। ভয়ানক শব্দে বন্ধ হলো চোয়াল। এক ইঞ্চির জন্য ফসকে গেল কিশোরের ডান গোড়ালি।
মাথা নিচু করে ডাইভ দিয়ে জানালার বাইরে চলে এল রাস্টি। ডিগবাজি খেল শূন্যে। বেমক্কাভাবে কাঁধটা পড়ল মাটিতে। গড়ান দিয়ে সোজা হলো।
কিশোর দুই হাতে জানালার কিনার ধরে ঝুলছে। একটা সেকেন্ড ঝুলে থেকে ছেড়ে দিল হাত। পড়ল খাড়া হয়ে, পায়ের ওপর। নিরাপদে।
মাটিতে বসে হাঁপাচ্ছে বিল। কিশোরকে দেখে বলল, ‘আমি ভাল আছি!’
‘রাস্টি, আপনার খবর কী?’ জানতে চাইল কিশোর।
‘পঞ্চাশটা খেপা ষাঁড়ের পিঠে চড়েছি আমি, একশোটা বুনো ঘোড়া, কিছুই হয়নি,’ রাস্টি জানাল। ‘কিন্তু একটামাত্র কানা অ্যালিগেইটরের পিঠে চড়েই হাতটা ভাঙলাম।’
হ্যারিস এসে হাজির হলো। বিড়বিড় করে গাল দিচ্ছে কাউকে। ‘পন্টুন বোটটা নড়ছে না। ইঞ্জিনের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। আটকা পড়লাম। দ্বীপ থেকে আর বেরোতে পারব না।’
কী ঘটেছে, সংক্ষেপে হ্যারিসকে জানাল কিশোর। তিনজনে মিলে রাস্টিকে দাঁড় করাল। ধরে ধরে মেইন কেবিনের দিকে নিয়ে চলল।
‘শর্ট-সার্কিট করে জেনারেটরটাও অচল করে দিয়েছে!’ রাস্টি জানাল। ‘মেরামত করতে বসেছিলাম আমি আর হ্যারিস, এ সময় তোমাদের চিৎকার শুনলাম।’
‘জেনারেটরটা নষ্ট হওয়ার আগে রেডিওতে কথা বলছিলাম রবিনের সাথে,’ হ্যারিস বলল। ‘কথা বলতে বলতেই পাওয়ার চলে গেল, রেডিও অফ। রবিন আর মুসা ফক্স ডেনভারের ফিশিং বোটে আটকা পড়েছে। জাহাজটা কোথায় আছে, রবিনের কাছ থেকে জানার সুযোগ পাইনি, তার আগেই বিদ্যুৎ চলে যাওয়াতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।’
‘জাহাজের অবস্থান জানতে হবে না,’ কিশোর বলল। ‘মরিস মরিসনকে অনুসরণ করলেই আমাদেরকে জাহাজের কাছে নিয়ে যাবে।’
‘কীভাবে অনুসরণ করবে?’ বিল জানতে চাইল। ‘তুমিই তো তখন বললে, ওকে ধরার একমাত্র উপায় এখন আরেকটা এয়ারবোট জোগাড় করা। ইতিমধ্যেই দশ মিনিট সময় নষ্ট করে ফেলেছি আমরা। আমাদের চেয়ে দশ মিনিটের পথ এগিয়ে আছে ও।’
‘তা ঠিক!’ চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কিশোর।
‘রাস্টিকে পাঁচ মিনিট সময় দাও,’ বিল বলল। ‘জেনারেটরটা ঠিক করে ফেলুক। রেডিওতে কোস্ট গার্ডকে খবর দেয়া যাবে।’
এ ছাড়া আর কোন উপায়ও দেখল না কিশোর। চুপ হয়ে গেল। হই-হট্টগোলে অন্য অতিথিদেরও ঘুম ভেঙে গেছে। কেবিন থেকে বেরিয়ে আসছে তারা। হাতে লণ্ঠন। গায়ে রেইন কোট।
রাস্টির ভাঙা হাতটা পরীক্ষা করল টনি ওয়াকার। ‘হাড্ডিটা ঠিকমত বসিয়ে দিতে পারব আমি। পেইন কিলার আছে?’
‘আছে,’ হ্যারিস জানাল।
হাসপাতালে নিতে সময় লাগবে। তাই টনির কথায় রাজি হয়ে গেল রাস্টি।
প্রবল গতিতে ঝাপটা মারছে বাতাস। সেইসাথে ভারি বৃষ্টি। যেন মার্বেলের মত আঘাত হানছে চোখেমুখে। প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় সেসব উপেক্ষা করছে কিশোর। ওর বন্ধুরা মারাত্মক বিপদের মধ্যে আছে। ওদের সাহায্য করা দরকার। কিন্তু কীভাবে?
‘তোমার জন্যে আমার খারাপ লাগছে, কিশোর,’ বাইরে এসে বলল বিল।
‘থ্যাংকস।’
ঠিক এই সময় বাতাসের শব্দকে ছাপিয়ে আরেকটা শব্দ ক্ষণিকের জন্য কানে এল কিশোরের। ইঞ্জিনের। ভুল শুনেছে ভেবে গুরুত্ব দিল না। কিন্তু আবার শোনা গেল শব্দটা। বাড়তেই থাকল। না, ভুল শোনেনি ও। বুকের মধ্যে লাফ দিয়ে উঠল হৃৎপিণ্ডটা। চিৎকার করে উঠল, ‘হাইড্রোপ্লেন!’
পনেরো
ওপর দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। প্লেনের ছোট্ট রানিং লাইটটা চোখে পড়ছে। ঝোড়ো বাতাসকে উপেক্ষা করে কালাহান’স-কী’তে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ঢেউয়ে উত্তাল পানিতে নামতে গিয়ে কেঁপে উঠল হাইড্রোপ্লেন। ডকের দিকে দৌড়ে গেল কিশোর। ককপিট থেকে নেমে এলেন রাস্টির বন্ধু ব্রেক জনসন। ‘এই তুফানের মধ্যে প্লেন ওড়ানো! মনে হচ্ছিল রোডেও খেলছি।’
‘তারমানে মজাই পেয়েছেন,’ চোখ থেকে বৃষ্টির পানি মুছল কিশোর। ‘কিন্তু এ সময় এখানে কেন আপনি? ঝড়ের মধ্যে শুধু শুধু প্রাণ হাতে করে উড়াল দেননি নিশ্চয়?’